ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

দায়সারা অনুসন্ধান

চট্টগ্রামে জঙ্গী কর্মকান্ড নিয়ে অন্ধকারে পুলিশ

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৪
চট্টগ্রামে জঙ্গী কর্মকান্ড নিয়ে অন্ধকারে পুলিশ

চট্টগ্রাম: উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে প্রায় দু’মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও চট্টগ্রামে হিযবুত তাহরীর ছাড়া আর কোন উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠনের সক্রিয় থাকার কোন তথ্য পায়নি পুলিশ। এমনকি সক্রিয় হিযবুত তাহরীরের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক নিয়েও কোন তথ্য নেই নগর পুলিশের কাছে।



তবে রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন জঙ্গীকে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেয়ার পর এখন পুলিশ বলছে, চট্টগ্রামে জেএমবি’র অস্তিত্ব থাকতে পারে। জেএমবিসহ সক্রিয় জঙ্গী সংগঠনগুলোর বিষয়ে তথ্য জানতে এখন নগর পুলিশ নতুন করে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে।


এছাড়া চট্টগ্রামে সক্রিয় ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতাদের কারও সঙ্গে আল কায়েদা কিংবা অন্য কোন আর্ন্তজাতিক উগ্রপন্থী সংগঠনের যোগাযোগ আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এক্ষেত্রে পুলিশ মুফতি ইজহারুল ইসলাম ও তার ছেলে হারুন ইজহার এবং মাঈনুদ্দিন রুহিকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল, শুধুমাত্র হিযবুত তাহরীর চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্ন কিছু কর্মকাণ্ড করে। কিন্তু তিন জঙ্গীকে ছিনতাইয়ের পর আমরা ধরে নিয়েছি, চট্টগ্রামে জেএমবিও সক্রিয় আছে। এখন তাদের সম্ভাব্য আস্তানা, কর্মকান্ড, কানেকশনসহ সামগ্রিক বিষয় আমরা খতিয়ে দেখব।

২০১৩ সালের ২৭ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের পক্ষে বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া এনালাইসিস এন্ড রিসার্স/গোপনীয়) এস এম আইনুল বারি বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার কার্যালয়ে জঙ্গী সংগঠন সংক্রান্তে প্রতিবেদন প্রেরণ প্রসঙ্গে একটি চিঠি (স্মারক নম্বর-১৪২৯৩) পাঠান।

চিঠিতে সাতটি সংগঠনের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। সংগঠনগুলো হচ্ছে, নিষিদ্ধঘোষিত হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), হিযবুত তাহরীর ও জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাওহিদ, আল্লাহর দল ও দাওয়াত-ই-ইসলাম। এছাড়া অন্য কোন উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের অস্তিত্ব আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখতে বলা হয়।

চিঠিতে কোন সংগঠনের অস্তিত্ব কিংবা কার্যক্রম পরিলতি হলে তাদের জেলা ও উপজেলা কমিটির নামের তালিকা (ফোন নম্বরসহ), গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রোফাইল, অন্য কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইস্যুভিত্তিক কোন কর্মসূচীতে সংশ্লিষ্ট আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেয়া হয়।

এছাড়া চিঠিতে প্রতি তিন মাস পর পর উগ্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম, এ সময়ের মধ্যে রুজু করা মামলার তালিকা (এজাহারের কপিসহ), গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের ছবিসহ প্রোফাইল এবং মামলার হালনাগাদ তথ্য নিয়মিতভাবে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

যেসব কর্মকর্তার কার্যালয়ে জঙ্গী সংক্রান্ত প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়  তারা হলেন, সদর দপ্তরের সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি, সকল জেলা বিশেষ শাখা ও রেলওয়ের পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম ও খুলনার সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সুপার এবং রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটের সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের উপ-পুলিশ কমিশনার।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২৭ আগস্ট জারি করা আদেশের কপি চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এসে পৌঁছে গত ২৯ আগস্ট। ওইদিনই সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে নগরীর ১৬টি থানার ওসি এবং উপ-পরিদর্শকদের বরাবরে দ্রুত প্রতিবেদন চেয়ে দু’টি চিঠি (স্মারক নম্বর ১৪২৯৮ ও ১৪২৯৯) পাঠানো হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সদর দপ্তরের চিঠির প্রেক্ষিতে ২৯ আগস্ট থেকেই জরুরি ভিত্তিতে টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে এ বিষয়ে কাজ শুরু করার জন্য থানার ওসিদের নির্দেশ দেয় সিএমপি। পাশাপাশি একজন পরিদর্শক, একজন উপ-পরিদর্শক ও তিনজন সহকারী উপ-পরিদর্শকের সমন্বয়ে টিম গঠন করে কাজ শুরু করে নগর পুলিশের বিশেষ শাখা। নগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিমও একইসঙ্গে কাজ শুরু করে।

সূত্র জানায়, অনুসন্ধানের শুরুতেই পুলিশের কাছে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন আসে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নগরীতে গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তালেবানের আদলে জঙ্গি তৈরি করতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় তরুণ যুবকদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত প্রশিণ নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, অক্টোবরের শেষদিকে সদর দপ্তরে সিএমপি’র পক্ষ থেকে একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সেখানে হিযবুত তাহরীর মাঝে মাঝে পোস্টার সাঁটানো এবং ঝটিকা মিছিল বের করে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বাংলা টিমের কার্যক্রমের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতায় নগর পুলিশের জঙ্গী সংগঠনের বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায় বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছিলাম। তাদের কর্মকান্ড চট্টগ্রামে নেই। হিযবুত তাহরীরের কিছু কর্মকান্ড আছে। ’

তবে হিযুবত তাহরীর সংগঠনটির নেতৃত্বে চট্টগ্রামে কারা কারা আছেন, সংগঠনটির কার্যক্রম কারা পরিচালনা করেন এসব বিষয়ে কোন তথ্য আপাতত পুলিশের কাছে নেই বলে জানান বনজ কুমার মজুমদার।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে জিহাদের আহ্বান জানিয়ে আল কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির বক্তব্যের পর নগর পুলিশ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর চট্টগ্রামের নেতাদের বিষয়ে খোঁজখবর শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রামের ধর্মভিত্তিক দলের নেতাদের মধ্যে কারা আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সেই তথ্যও পাবার চেষ্টা করে পুলিশ।

প্রাথমিকভাবে হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি ইজহারুল ইসলাম, তার ছেলে মুফতি হারুন ইজহার এবং ১৯ দলের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দিন রুহির আর্ন্তজাতিক যোগাযোগ ভাল বলে তথ্য পায় পুলিশ।

পুলিশের কাছে তথ্য আছে, লস্কর ই তৈয়বার সঙ্গে কানেকশনের অভিযোগে ২০১০ সালে একবার মুফতি হারুন ইজহার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের ডাউকি এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া লস্কর-ই তৈয়বার দুটি জঙ্গি নাজের ওরফে নাজের পারবন এবং শফিক ওরফে সাহাফাজ শামসুদ্দিন সেদেশের পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তাদের সঙ্গে ২০০৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে মুফতি হারুনের কয়েক দফা বৈঠক হয়। এমনকি তারা মার্কিন ও ভারত দূতাবাসে হামলারও পরিকল্পনা নিয়েছিল। এরপর মুফতি হারুন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

তার পিতা মুফতি ইজহারের মাদ্রাসায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের জন্ম হয়েছিল বলেও অভিযোগ আছে। দেড় দশক আগে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের প্রাণনাশ চেষ্টার অভিযোগে আটক হওয়া কয়েকজন জঙ্গি জানায়, তারা মুফতি ইজহারুল ইসলামের লালখান বাজার মাদ্রাসাতেই ট্রেনিং নিয়েছিল।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, মুফতি ইজহার কার্যত আত্মগোপনে আছেন। হারুন ইজহারকে আমরা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কিন্তু শাপলা চত্বরের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ায় খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। মাঈনুদ্দিন রুহি পলাতক আছে। আমরা তাকে খুঁজছি। তাকে পাওয়া গেলে অনেক তথ্য মিলবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।