ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

হয়রানির বিচার চান খালাস পাওয়া বদনি

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৪
হয়রানির বিচার চান খালাস পাওয়া বদনি

চট্টগ্রাম: হয়রানির বিচার চান দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় খালাস পাওয়া আলোচিত আসামী মরিয়ম বেগম ওরফে বদনি মেম্বার (৪৭)। প্রায় ২০ বছর ধরে ইউপি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বদনি মেম্বারকে দেখতে শুক্রবার দিনভর তার বাড়িতে দলে দলে ভিড় করেছে এলাকার মানুষ।



বদনির সঙ্গে খালাস পাওয়া একই এলাকার অন্যান্য আসামীদের কেউ ঘুরছেন মাজারে, কেউ পীরের দরগাহে আর কেউ সাংবাদিকের নাম শুনলেই চলে গেছেন আড়ালে।

শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে সিইউএফএল সংলগ্ন আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর কুট্টাপাড়া এলাকায় বদনি মেম্বারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে রীতিমত সমাবেশের মত জটলা।
বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, ছোট ছোট শিশু উঠানে ঘিরে রেখেছে বদনিকে। কেউ একটু ছুঁয়ে দেখছেন, কেউ জড়িয়ে ধরছেন আর কেউ তিনি খালাস পাওয়ায় শুকরিয়া আদায় করছেন।

বদনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে এলাকার মেম্বার। মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমি খালাস পেয়েছি শুনে ভোর থেকে মানুষ আসছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উঠানে মানুষ আর মানুষ। এখনও গোসল করতে পারিনি। ’

শুধু এলাকার মানুষ নয়, বদনির পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও দেখা গেছে খুশির বন্যা। তার মেয়ে পরিচয়ে একজন বললেন, গতকাল (রায়ের দিন) সকালে যখন আম্মা আদালতে যাচ্ছিল আমরা সবাই কান্না করছিলাম। আল্লাহর উপর বিশ্বাস ছিল। আম‍ার আম্মা দোষী নন। তিনি খালাস পাবেন এই বিশ্বাস আমাদের ছিল।

বদনি বলেন, আম‍ার পক্ষে কি দশ ট্রাক অস্ত্র, এত অস্ত্র আনা সম্ভব ? আমি কিছু জানতামও না। এ ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নয়। তারপরও শুধু শুধু আমাকে এ মামলায় আসামী করা হয়েছে। চার মাস জেলে ছিলাম। দশ বছর ধরে আমাকে কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছে। অনেক টাকাপয়সা খরচ হয়েছে।  

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বদনি বলেন, ‘বিনা দোষে আমি জেল খেটেছি। আমাকে যারা এই হয়রানি করেছে আমি তাদের বিচার চাই। আমি আল্লাহর কাছেও বিচার চাই, বান্দার কাছেও বিচার চাই। ’

জানা গেছে, একই এলাকায় বদনিসহ ১৭ জন ছিলেন এ মামলার আসামী। তাদের কেউ শ্রমিক, কেউ দিনমজুর, কেউ এলাকার সাধারণ মানুষ। এদের মধ্যে ১৬ জনই খালাস পেয়েছেন। শুধুমাত্র শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদের সাজা হয়েছে।

শুক্রবার বিকেলে বদনির বাড়ি থেকে বেরিয়ে একই এলাকায় আরেক আসামী ফজল আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, তিনি সকালেই আধ্যাত্মিক সাধক মোহছেন আউলিয়ার মাজার জিয়ারতের জন্য গেছেন। রায়ে খালাস পেলে তিনি ওই মাজারে যাবেন বলে মানত করেছিলেন।

একই এলাকায় মুজিবুর রহমান প্রকাশ ভুলু’র বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতেও অনাগ্রহ দেখান। এমনকি ভুলু’র সেল ফোনের নম্বর চাইলেও তারা দেননি।

পরে ভুলু’র সেল নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আনোয়ারার গহিরায় তিনি এক পীরের দরগাহে আছেন। মামলায় খালাস পাওয়ার পর তিনি পীরের দরগাহ জিয়ারত করার সিদ্ধান্ত নেন।

ভুল’র বাড়ির সামনে খালাস পাওয়া আরেক আসামী আরজু মিয়া প্রকাশ আরজু পাগলাকে গিয়েও পাওয়া যায়নি। তার পরিবারের সদস্যরাও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে অনাগ্রহ দেখান।

বদনি মেম্বার বাংলানিউজকে বলেন, যাদের আসামী করা হয়েছিল তারা দিনে আনে দিনে খায়। মামলা চালাতে গিয়ে অনেকে দিনান্তে পেটের ভাতও জুটাতে পারেনি। অনেকে নিয়মিত মামলায় হাজিরাও দিতে পারেনি।

স্থানীয় দোকানদার মনির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, লোকগুলো আসলেই অসহায়। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে আবার কোন ঝামেলায় পড়ে কিনা, সেজন্যই তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি খালাসের সময় ধরা পড়ে।

এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসি আহাদুর রহমান বাদি হয়ে অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় ৪৩ জনকে এবং চোরাচালানের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (বি) ধারায় ৪৫ জনকে আসামী করে পৃথক দু’টি মামলা মামলা দায়ের করেন।

এতবড় অস্ত্রের চালান খালাসের ঘটনায় বিস্ময়করভাবে আসামী করা হয় ট্রলার মালিক, ঘাট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, ট্রলারের সারেং, মাঝিমাল্লা, স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ এলাকার সাধারণ মানুষকে।

২০০৫ সালে আসামীদের বিরুদ্ধে বিচারও শুরু হয়। ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।

সিআইডির এএসপি ইসমাইল হোসেন প্রথম দফা অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তিনি তদন্ত শেষের আগেই বিদায় নেন। পরে সিআইডি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মনিরুজ্জামান চৌধুরী ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তদন্তভার গ্রহণ করেন। মনিরুজ্জামানের তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের নাম, উলফার প্রসঙ্গ, একের পর এক স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর বিষয়।

মনিরুজ্জামানের দাখিল করা সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামী হন সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১১ জন প্রভাবশালী।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান অস্ত্র  চোরাচালান মামলায় ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং অস্ত্র আইনে দায়ের হওয়া মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেন।  

রায়ে দেখা গেছে, আগে যাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র তিনজন এবং মনিরুজ্জামানের অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত ১১ জন সাজা পেয়েছেন।

রায়ে অস্ত্র চোরাচালান মামলায় ৩৮ জন আসামী বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আর অস্ত্র আটক মামলায় ৩৬ জন বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী ও চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, যেসব নিরীহ লোকজনকে অহেতুক হয়রানি করা হয়েছে, তারা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতে পারবেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।