চট্টগ্রাম: মোহাম্মদ তানভীর হোসেন রুমেল; ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) মৎস্য ও সমুদ্র বিদ্যা ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
অপেক্ষায় আছেন মৌখিক ও শারীরিক পরীক্ষার জন্য।
শুধু এই ইনস্টিটিউট-ই নয়।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন,‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা যাতে সেশনজটে না পড়েন, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। কেননা তিন-চার মাসের ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত না হওয়া মানে দুই বছরের সেশনজটে পড়া। ’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা সহিংস হরতাল-অবরোধের কারণে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে সেশনজট আরও বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টানা রাজনৈতিক সহিংস কর্মসূচির জন্য জানুয়ারির মাঝামাঝিতে এসে কোনমতে লিখিত পরীক্ষা শেষ হলেও ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির সচিব ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার (একাডেমিক) এসএম আকবর হোছাইন বাংলানিউজকে জানান, ১৬ নভেম্বর শুরু হওয়া ভর্তি পরীক্ষা গত বছরের ২৫ নভেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় হরতাল-অবরোধের কারণে তা স্থগিত এবং পেছাতে হয়েছে। তাই পরীক্ষা-ই শেষ হয়েছে ২৬ ডিসেম্বরে।
এদিকে সাতটি অনুষদের মধ্যে দু-একটি ছাড়া সবগুলোর সাক্ষাৎকার শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ১৫ দিনের ভর্তি কার্যক্রম দেড় মাসেরও বেশি সময়ে শেষ না হওয়ায় উচ্চ শিক্ষার প্রবেশের আগমুহূর্তেই শিক্ষাজটে পড়তে হচ্ছে এই নবীন শিক্ষার্থীদের। রাজনীতির হিংস্র থাবার মুখে পড়ছে তাদের।
আবদুল্লাহ রূপসাহান নামের এইচ ইউনিটের এক ভর্তিচ্ছু বাংলানিউজকে বলেন,‘উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখনও পর্যন্ত ভর্তি হতে পারিনি। কখন ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হবে, ক্লাস-ই বা শুরু হবে কবে তা কিছুই বলতে পারছি না। ’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই সেশনজটের মুখে পড়লাম আমরা’-হতাশার সুরে যোগ করেন রূপসাহান।
জি ইউনিটে অর্থাৎ ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিশারিজের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া তানভীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন,‘আমরা সঠিক সময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে চাই। ’
বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও এ ইউনিটের সভাপতি আবদুল করিম চৌধুরী জানান, অনুষদে ভর্তির স্থগিত হওয়া মৌখিক পরীক্ষার সূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের সাক্ষাৎকার ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি নেয়া হবে।
এদিকে শুধু ভর্তি পরীক্ষার্থীরাই নয়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় আটকে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থীর। বছর শুরুর এই সময়টা বিভিন্ন বিভাগের সেমিস্টার ও চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়ার কথা থাকলেও কীভাবে হবে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত এক মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ৪৫টি বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে ছয় মাসেরও বেশি শিক্ষাজটের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষার দাবিতে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছেন।
চবি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কায়সার আহমেদ শাকিল বাংলানিউজ বলেন,‘হরতাল-অবরোধের কারণে পিছিয়ে আমাদের ৩০১ নম্বর কোর্সের ফাইনাল পরীক্ষা গত শুক্রবার (১০জানুয়ারি) নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই সূচি আবারও পরিবর্তন করা হয়েছে। ’
একই সঙ্গে এই বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ৫০৬ নম্বর কোর্সের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে বলে জানান মো. আবুল বাশার নামের আরেক ছাত্র।
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রুহুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন,‘জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া ফাইনাল পরীক্ষা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে তেমন শিক্ষাজট না থাকলেও এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ছয় থেকে সাত মাসের জটে পড়তে হবে। ’
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই কথা জানালেন, আইন বিভাগের শরীফুল ইসলাম, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতার তৃতীয় বর্ষের মনি আকতার ও অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র রূপক কর্মকারও।
তারা জানান, হরতাল-অবরোধে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলেও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তারা ক্লাসে ফেরেন না। শিক্ষকরাও উপস্থিত হতে পারছেন না।
ক্ষোভের সঙ্গে রূপক ও শরীফ অভিযোগ করেন,‘কিছু বিভাগ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বন্ধের দিন পরীক্ষা নিয়ে নিচ্ছে। তবে অনেকেই এ বিষয়ে উদাসীন, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চান না। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. তৌহিদ ওসমান বলেন,‘অবরোধ-হরতালে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকে। তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকে। ’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোক প্রশাসন বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন,‘দুই দল রাজনীতি করছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এখন আমরা তাকিয়ে আছি সরকারি আর বিরোধী দলের দিকে। তারা সমঝোতা করলে ফের ক্যাম্পাসে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। নয়তো দুর্বিসহ সেশনজটের কবলে পড়বে শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা যাতে সেশনজটে না পড়েন, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। কেননা তিন-চার মাসের ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত না হওয়া মানে দুই বছরের সেশনজটে পড়া। ’
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা একান্ত দরকার বলে মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক অস্থিরতার অতিসত্ত্বর সমাধান প্রয়োজন উল্লেখ করে ড. ইফতেখার চৌধুরী বলেন,‘দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব সহিংস কর্মসূচির বাইরে রাখতে হবে। কেননা দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যকরী ভুমিকা রাখছে। ‘
সেক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও জরুরি বলে মত দেন সমাজ বিজ্ঞানের এই শিক্ষক।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৪
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর