ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

প্রিয়জনের ফেরার প্রতীক্ষায় ১২ বছর

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৯
প্রিয়জনের ফেরার প্রতীক্ষায় ১২ বছর স্বজনের প্রতীক্ষায় কেটে দীর্ঘ ১০ বছর তারপরও অপেক্ষা। ছবি: বাংলানিউজ

ভোলা: সাগরে ট্রলার ডুবেছে, মরদেহের সন্ধান মেলেনি। তাই কারো প্রতীক্ষা স্বামীর জন্য, কারো বা ভাই আবার কারো সন্তানের জন্য। একদিন জীবিত ফিরবে তাই এ অপেক্ষা। এভাবে ১২ বছর কেটে গেলেও আজো ফিরে আসেনি কেউ। তবুও তারা ফিরে আসবেন এমন প্রতীক্ষা স্বজনদের।

ভোলা সদরের ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিডরে নিখোঁজ নয় জেলে পরিবারে এমন অপেক্ষার প্রহর যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও সন্ধান মেলেনি সেই ৯ জেলের।

অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাদের মরদেহ পাওয়া যায়নি। তারা বেঁচে আছেন না কি মারা গেছেন তা জানেনা কেউ। তবে তাদের পরিবারের সদস্যরা আজো তাদের প্রতীক্ষায় আছেন। প্রিয়জনের কথা মনে করে কেঁদে উঠেন স্বজনরা। যেন এ কান্নার শেষ নেই।

পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের না পেয়ে এসব পরিবারে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। স্বজনদের হারিয়ে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে কাটছে তাদের।

স্বজনের প্রতীক্ষায় কেটে দীর্ঘ ১০ বছর তারপরও অপেক্ষা।  ছবি: বাংলানিউজ

চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে গিয়ে জানা যায়, জসিম মাঝির ট্রলার নিয়ে সিডরের কয়েকদিন আগে মাছ শিকারের গিয়েছিলেন ভোলার চন্দ্রপ্রসাদ গ্রামের নয় জেলে। মাছ শিকার শেষে কারো নতুন ঘর তৈরি, কারো বিয়ে বা সন্তানের বইখাতা আর স্কুলে ভর্তি করানোর কথা ছিল। কিন্তু সিডরের ঝড়ে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হয়েছেন বজলু, রুবেল, জসিম, নুরু, সহিদুল, ইব্রাহিম, মামুন, জামাল আর রুবেল নামে নয় জেলে। তারা ফিরে না আশায় অসমাপ্ত কাজগুলোর কিছুই করা হয়নি তাদের। স্বজনকে না পেয়ে ১২ বছর চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। এখনও তাদের মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। কেউ কেউ আবার তাদের ফেরার অপেক্ষায় এখন পথ চেয়ে আছেন।

নিখোঁজ বজলু মালের স্ত্রী মনোয়ারা ১২ বছর ধরে স্বামীর অপেক্ষায় আছেন, তার দাবি স্বামী একদিন জীবিত ফিরে আসবেন। স্বামীর প্রতীক্ষায় আজো পথ চেয়ে আছেন তিনি।

মনোয়ারা বাংলানিউজকে বলেন, ৫ মেয়ে রেখে স্বামী মাছ শিকারে গিয়ে সিডরে ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ হন। অন্যের বাড়ি কাজ করে একবেলা খাওয়ালেও দুই বেলা না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আর ঋণ নিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এখনও তিন মেয়ে রয়েছে, তাদের বিয়ে দিবো কিভাবে। স্বামী থাকলে এমন দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না।

স্বজনের প্রতীক্ষায় কেটে দীর্ঘ ১০ বছর তারপরও অপেক্ষা।  ছবি: বাংলানিউজ

নিখোঁজ রুবেলের মা আমেনা খাতুন। তার বিশ্বাস ছেলে ফিরে আসবে, তাই এখনও ছেলের জন্য অপেক্ষা। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে ঠিক করে রেখেছি, বিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল, কথা ছিলো মাছ শিকার করে বাড়িতে ফিরলেই আনন্দ-উৎসব করে বিয়ে দেবো, কিন্তু কিছুই হলো না, ছেলে ফিরে এলো না।

নিখোঁজ জেলে জসিমের ভাই নাছির বাংলানিউজকে বলেন, ট্রলারডুবির পর থেকে বিভিন্নস্থানে ভাইয়ের সন্ধান করেছি, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাইনি।  

একই গ্রামের খালেক মাঝির ছেলে নুরু উদ্দিনও ছিলেন ওই ট্রলারের জেলে। সিডরের পর থেকে তিনিও নিখোঁজ। সন্ধান মেলেনি তার। তার বোন মমতাজ বাংলানিউজকে বলেন, যেখানেই থাকুক না কেন ভাই ফিরে ফিরে আসবেই, তার মরদেহ পাওয়া যায়নি, তাই সে বেঁচে আছে।

স্বজনের প্রতীক্ষায় কেটে দীর্ঘ ১০ বছর তারপরও অপেক্ষা।  ছবি: বাংলানিউজ

তিনি আরও বলেন, স্বামীর অপেক্ষা করে নুরুর স্ত্রী রাবেয়া অন্যত্র বিয়ে করেছেন। কিন্তু রেখে গেছে দুই ছেলে। তাদের দেখা-শোনা করার কেউ নেই, অসহায় ছেলেদের ভরণ পোষনের কষ্টে দিন কাটছে তাদের।

নিখোঁজ স্বজনদের অভিযোগ, সিডরের ঝড়ে নিখোঁজ হলেও সরকারের দপ্তর থেকে তাদের কোনো সাহায্য করা হয়নি। তাদের খোঁজ খবরও নেয়নি কেউ।

বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৯
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।