ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, শুরুতেই ক্ষতিপূরণে ঘাপলা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৫
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, শুরুতেই ক্ষতিপূরণে ঘাপলা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মগডেইল, মাতারবাড়ি, মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছেনি ক্ষতিপূরণের টাকা।

ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে একটি ‘কুচক্রী মহল’ প্রায় ২৩ কোটি টাকা লোপাট করেছে।

আর এই অনিয়ম ধরা পড়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

এদিকে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের শুরুতে এই জটিলতায় প্রকল্প এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণ স্থগিত রয়েছে।

ফলে চরম সংকটে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ঘরে তিন বেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। প্রকল্প এলাকার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম মগডেইল ঘুরে এ বিষয়ে নানা তথ্য জানা গেছে।   

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্প এলাকার চিংড়ি ঘের মালিক, লবণ মিল মালিক, রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার ষড়যন্ত্রে ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনের জন্য ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে। একপর্যায়ে ওই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয় কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রতিরোধ কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। প্রকল্প এলাকায় জমি লিজ নিয়ে যারা মাছের ঘের করেছিলেন, তারা নিজেদের জমি ও বিপুল অংকের আর্থিক ক্ষতি দেখিয়ে টাকা তুলে নিয়েছেন।

স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, শুরুর দিকে নিজেদের জমির প্রকৃত দলিলসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। এজন্য ক্ষতিপূরণের অর্থ (অ্যাওয়ার্ড মানি) প্রদানের দায়িত্বে থাকা সরকারি দপ্তর থেকে মোটা অংকের ‘কমিশন’ চাওয়া হয়। কেবলমাত্র এই কমিশন যাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে, তাদেরই ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়। আর এই সুযোগে প্রকৃত কাগজপত্র না থাকার পরও একটি ‘কুচক্রী মহল’ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৩ কোটি টাকা উত্তোলন করে।

আরো অভিযোগ রয়েছে, ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানে দুর্নীতি শুরু হয় ৭ ধারা নোটিশ থেকে। টাকা পেতে হলে জমির মালিককে অবশ্যই সরকারের কাছ থেকে এই নোটিশ পেতে হবে। এতে জমির পরিমাণ ও ক্ষতির বিবরণ উল্লেখ থাকে। এটি ‘৭ ধারা নোটিশ’ হিসেবে পরিচিত। প্রত্যেক নোটিশের জন্য নেওয়া হয়েছে ২০০ করে টাকা।

ক্ষতিপূরণের ফাইল সরকারি দপ্তরে জমা দেওয়ার পূর্ব শর্ত ছিল জমির খাজনা পরিশোধের রসিদ অবশ্যই জমা দিতে হবে। আর এই খাজনার নামে মাতারবাড়ি ভূমি অফিসে শুরু হয় দুর্নীতি। ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের কাছ থেকে স্থানীয় হিসেবে এক কানি (৪০ শতাংশ) জমির জন্য ৫০০ করে টাকা নেওয়া হয়। এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ দেওয়া হলে কানি প্রতি ৪০ টাকা করে খাজনা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য সরকারি দপ্তরে ফাইল জমা দেওয়ার পর ‘কমিশন’ দাবির মধ্য দিয়ে আরেক দুর্নীতি শুরু হয়। ২০ শতাংশ হারে ‘কমিশন’ না দিলে ফাইল নড়ে না। প্রকৃত জমির মালিকেরা সব কাগজ যথাযথভাবে দিয়েও টাকা পাননি। অন্যদিকে জমি ইজারা নিয়ে তৈরি করা ঘেরের মালিকেরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহজেই টাকা পেয়ে যান। ২০০০ নম্বরের ফাইল ১ নম্বরের আগেই অনুমোদিত হয়ে যায়। একজন চিংড়ির ঘের করলেও একই প্রজেক্টে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে যান অন্তত ১০ জন।

অথচ ঘের মালিকেরা ৬ মাসের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে চিংড়ি চাষ করেন। ৬ মাস পর পর তাদের ইজারার মেয়াদ শেষ হয়। জমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া একজন জমির মালিকের চেয়ে ঘের মালিকের ক্ষতির মাত্রা অনেক কম।   

সূত্র বলছে, ভূয়া কাগজ তৈরি করে ক্ষতিপূরণের টাকা লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে। তবে তদন্ত চলছে ধীর গতিতে। আর অন্যদিকে জমির প্রকৃত মালিকেরা দিনের পর দিন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন দপ্তরে ঘুরেও টাকা পাচ্ছেন না। মাতারবাড়ির মগডেইল গ্রাম থেকে জেলা সদরে যাওয়া-আসার খরচও এখন তাদের অনেকের কাছে নেই।

বিদ্যুৎ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ও মাতারবাড়ির ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হওয়ায় আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এলাকার মানুষ তাদের ন্যায্য পাওনাটা চায়। শ্রমজীবী মানুষের ক্ষতিপূরণ দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকল্পের ভেতরে যাতে এলাকার মানুষেরা কাজের সুযোগ পেতে পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাতারবাড়ি শ্রমজীবী যুব উন্নয়ন সমিতির সভাপতি নওশাদুল ইসলাম বলেন, আমাদের সারাজীবনের সঞ্চয় এই প্রকল্পে চলে গেছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক বছর লাগবে। সরকারের কাছে এলাকাবাসীর দাবি, যেন ন্যায্য পাওনাটা তারা বুঝে পান। ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণ নিয়ে যে ঘাপলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাতারবাড়ি শ্রমজীবী যুব উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. কাসেম বলেন, সিন্ডিকেট করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত করে একটি মহল টাকা তুলেছে। যারা ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ফাইল জমা দিয়েছেন, তাদের কাছে ৩ শতাংশ থেকে শুরু করে ১২-১৩ শতাংশ হারে কমিশন দাবি করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। আমরা নির্বিঘ্নে ন্যায্য পাওনাটা পেতে চাই।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক রুহুল আমীন বলেন, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণ নিয়ে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে দায়ের করা সার্টিফিকেট মামলার তদন্ত চলছে। প্রকৃত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা যথাযথভাবে বিতরণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।