ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

বিধ্বস্ত চারিপাড়া দাঁড়াতে পারেনি!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৪
বিধ্বস্ত চারিপাড়া দাঁড়াতে পারেনি! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চারিপাড়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী : বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে ফসলি মাঠে। তলিয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর।

ডুবছে রাস্তাঘাট। পুকুরের মাছ থাকছে না। জমিতে আবাদ হচ্ছে না। চলাচলে যোগ্য এক টুকরো পথ অবশিষ্ট নেই। বহু মানুষ কর্মহীন। জীবিকার খোঁজে এরই মধ্যে বহু মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটেছে। গ্রামের পর গ্রাম মানুষের ঘরে হাহাকার। সব হারানো মানুষেরা কোনভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না।

উপকূলের জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের ছয় গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ এমন হাজারো সংকটের মধ্যে বেঁচে আছে। ইউনিয়নের রামনাবাদ লাগোয়া প্রান্তিক এই জনপদের অবস্থাপন্ন মানুষেরাও এখন পথে বসেছে।

এককালে সবুজে ভরে ওঠা গ্রাম বিরান পড়ে আছে। এককালে ২-৩ ফসলি উর্বরা জমি ফসলহীন বছরের পর বছর। বার বার আবাদের চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে চাষাবাদ ছেড়ে অন্য পেশায় জীবিকার পথ খুঁজছেন চাষিরা।

বহু বছর ধরে সবুজে ভরে থাকা এই জনপদের বিপন্ন অবস্থার প্রধান কারণ রামনাবাদ তীরের বাঁধ বার বার ভেঙে যাওয়া। আলাপ করতেই সবার আঙ্গুল ওঠে বিধ্বস্ত বাঁধের দিকে।

গ্রামবাসীর কণ্ঠে অভিযোগের সুর। বিপন্ন অবস্থায় থাকা বাসিন্দারা বলেছেন, টাকা বরাদ্দ হয়, কাজও হয়; কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। নদী থেকে লবন পানি প্রবেশ বন্ধ হয় না, মানুষের দুর্ভোগও কমে না।

রামনাবাদ নদীর তীরে বিধ্বস্ত বাঁধের তীরে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় চারিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা পঁয়ষট্টি বছর বয়সী মোসলেম আলী শিকদার জানালেন, এই বয়সে নদীর তীরে পাঁচবার বাঁধ তৈরি করতে দেখেছেন।

প্রথমবার মোটামুটি শক্ত ও উঁচু বাঁধ হলেও পরের বাঁধগুলো টেকসই হয়নি। আর সে কারণেই প্রথমবার তৈরি করা বাঁধের চিহ্ন এখনও রয়েছে গেছে আর পরের বাঁধগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই এলাকাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে শক্ত একটা বাঁধের দাবি তার।

এতটা বিধ্বস্ত-বিপন্নতার মধ্যে ছবি তোলা আর তথ্য সংগ্রহে বিরক্ত গ্রামবাসী আমজাদ হাওলাদার অনেকটা ক্ষোভের সুরেই বলেন, সরকার বরাদ্দ দেয়। কিন্তু পথে পথে সব শেষ হয়ে যায়। আমরা কিছুই পাই না। বরাদ্দের অর্ধেকও মাঠে খরচ হয় না। ঠিকঠাক মত কাজ হলে সমস্যা অনেকটাই কমে যেতে পারে। আমাদের এত দুর্ভোগে থাকতে হবে না।

চারিপাড়াসহ বিপন্ন ছয় গ্রামের অবস্থান বোঝার জন্য হয়তো কারও সঙ্গে কথা বলারই প্রয়োজন নেই। শুধু গ্রামের পথ ধরে হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে এর বিপন্ন চেহারা। রাস্তার ওপরে ছোট্ট কালভার্ট পরিণত হয়েছে বড় খালে।

পথ চলার জন্য গ্রামবাসীর উদ্যোগে সেখানে দেওয়া হয়েছে বাঁশের সাঁকো। এমন সাঁকো রয়েছে চারটি। আরও কয়েকটি সাঁকো ছিল; সেগুলো গ্রামবাসী সংস্কার করেছে। সাঁকো দিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ ও শিশুরা যাতায়াত করে। রাস্তার দু’ধারে শত শত একর ফসলি জমি বিরান। কোথাও জমে আছে পানি। অন্যসব এলাকা থেকে এই এলাকাটি যেন একেবারেই আলাদা।

গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, বহুদিন ধরে সাজানো বাড়িগুলো একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পানিতে ডুবে থাকা অনেক ঘর মাটির সঙ্গেই মিশে গেছে। হাঁস-মুরগি খামার, গবাদি পশুর ঘর, সবজির ক্ষেত, পুকুরের মাছ কিছুই নেই। রাস্তার পাশের ঘর থেকে রাস্তায় উঠতেও অনেক বাড়ির সঙ্গে দেয়া হয়েছিল সাঁকো। প্রত্যেক বাড়িতেই ধ্বংস স্তুপের ছাপ স্পষ্ট। বসতবাড়ির ভিটে থেকে মাটি সরে গেছে। গাছপালা মরে গেছে। বাড়ির আঙিনা থেকে বাড়তি উপার্জনের পথটুকুও বন্ধ হয়ে গেছে।

হিসেব দেখালেন লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মজিবর রহমান।

তিনি জানালেন, ইউনিয়নের চার ও পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের ছয়টি গ্রামের অবস্থা শোচনীয়। গ্রামগুলো হচ্ছে : চারিপাড়া, বানাতী, এগারো নম্বর হাওলা, ধনজুপাড়া, চৌধুরীপাড়া ও নয়াকাটা। এইসব গ্রামের ৯০০ পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার।

তিনি বলেন, রামনাবাদের তীরে সাড়ে কিলোমিটারে বেড়িবাঁধ নেই। ২০১০ সাল থেকে এই অবস্থা। বেশ কয়েকবার মেরামত করা হলেও তা টেকসই হচ্ছে না। নদীর প্রবাহ রোধ না করে বাঁধ দেওয়া হলে তা টেকসই হবে না। নদী ভরাট হয়ে পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। জোয়ারের পানি উপচে ফসলি মাঠ ও বাড়িঘর ডুবিয়ে দিচ্ছে। এক সময় এই এলাকায় ধানসহ বিভিন্ন ধরণের ফসল হলেও এখন তা চাষিদের কাছে স্বপ্ন।

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র বলছে, বাঁধ না থাকায় রামনাবাদ নদী থেকে লবন পানি প্রবেশ করছে। এরফলে ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৫১৫ একর জমিতে কোন ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। বহু নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট তীব্র। গত বর্ষায় ইউনিয়নের চার হাজার ৩৯৬টি পরিবারের মধ্যে ১৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশেষ কোন সহায়তা আসেনি।

নদীতীরের এই ইউনিয়নের ছোট পাঁচনং, বড় পাঁচনং, নাওয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া ধঞ্জুপাড়া, এগারোনং হাওলা, পশরবুনিয়া, হাচনাপাড়া ও মুন্সিপাড়া গ্রামে কোন সাইক্লোন শেলটার নেই।

ফলে এই এলাকার মানুষ প্রায় সারা মৌসুম দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকে। এইসব এলাকায় অন্তত চারটি সাইক্লোন শেলটার নির্মাণের প্রস্তাব করেছে ইউনিয়ন পরিষদ।

পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা বলেন, অবিলম্বে এই বিপন্ন এলাকার মানুষের পূনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। ঘরহারা মানুষদের পুনর্বাসনে আবাসন প্রকল্প নিতে হবে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সড়ক পূননির্মাণ করতে হবে। এসব প্রস্তাব লিখিত আকারে উর্ধ্বতন মহলে পাঠানো হলেও কোন সাড়া নেই।       
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।