ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

ভাঙনকূলের স্কুলে কমছে পড়ুয়া!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪
ভাঙনকূলের স্কুলে কমছে পড়ুয়া! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রামদাসপুর, ভোলা থেকে: ভাঙনকূলের স্কুলগুলোতে কমছে পড়ুয়ার সংখ্যা। মেঘনার তাড়া খেয়ে বহু মানুষ বাড়ি-ঘর স্থানান্তর করছেন, সেই সঙ্গে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে স্কুল।

আর এরই প্রভাব পড়ছে পড়ুয়াদের ওপর। বাবা-মায়ের সঙ্গে বার বার থাকার জায়গা বদলের ফলে ওদের অনেকেই ঝরে পড়ছে। অনেকে লেখাপড়ায় খারাপ করছে, কিংবা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

এই নিয়ে শিক্ষকেরাও রয়েছেন বিপাকে।

দ্বীপ জেলা ভোলার ক্ষয়ে যাওয়া প্রাচীন দ্বীপ রামদাসপুরের অবস্থা এমনই। সেখানে মানুষের ব্যস্ততা দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, একটা নীরব দুর্যোগ মানুষদের তাড়িয়ে ফিরছে। মুখে কারও কিছু বলার প্রয়োজন নেই। প্রকৃতিই তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। ভাঙন ঘরের কিনারে আসার আগেই সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাড়ি-ঘর। ঘরের চালা-বেড়া খুলে অন্যত্র সরানো, গাছ কেটে ফেলা, পাকা ভবনে শক্ত হাতুরির আঘাত, এসব যেন এখন রামদাসপুরের স্বাভাবিক দৃশ্যপট।  

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভাঙন এখানকার জীবিকা ও মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থায় যেমন প্রভাব ফেলেছে, তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রেও চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের হাটের টোলঘরে স্কুল, ব্লাকবোর্ডবিহীন ক্লাস, স্কুলের মাঠে বেঞ্চ পেতে পড়ালেখা করানো- এসব রামদাসপুরের নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। একটিমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় চর থেকে নদীর ওপারে সরিয়ে নিতে হচ্ছে। ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে দু’টি সামনের জানুয়ারিতেই এখান থেকে চলে যাচ্ছে।
  
দক্ষিণ-মধ্য রামদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মো. রাব্বীর মন খারাপ। চতুর্থ শ্রেণীতে ওর ঘনিষ্ট বন্ধু মো. তারেককে পঞ্চম শ্রেণীতে এসে আর পায়নি। ভাঙনে পরিবার স্থানান্তরিত হওয়ায় তারেক আর স্কুলে আসতে পারেনি। এমন আরও অনেকজন বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। এ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেনীর আরিফ হোসেন, প্রথম শ্রেণীর সালমা বেগম, তৃতীয় শ্রেণীর লাইজু বেগম, মো. ইয়াসিন, পঞ্চম শ্রেণীর আরজু বেগমের নাম খাতায় থাকলেও ওরা আর আসতে পারছে না এই স্কুলে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙনের কারণে বিদ্যালয়ের পড়ুয়া সংখ্যা ২২০ থেকে ১৫৫-তে নেমে এসেছে। ভাঙন শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যস্ত করেছে। ছেলে-মেয়েদের পড়ানো হয় ব্লাকবোর্ড ছাড়া। চরের ২৭ দাগ বাজারের একটি টোলঘরে চালাতে হচ্ছে ক্লাস। মাত্র ভাঙা দু’খানা টেবিল রয়েছে। স্কুল চলে মাত্র ১২টি বেঞ্চ দিয়ে।

প্রধান শিক্ষক জানালেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর দু’বার স্থানান্তর করা হয়েছে। এখনই আরেকবার স্থানান্তরের সময় এসেছে। তবে সমাপনি পরীক্ষার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যালয়টি সরাতে হবে। প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে নদীর ওপারে মূল ভূখণ্ডে প্রধান শিক্ষকের নিজের গ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়ের জন্য জমিও দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক নিজেই।

২৭ দাগ বাজারে দক্ষিণ-মধ্য রামদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সীতারাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়টিও দু’বার স্থান বদল করেছে। জানুয়ারিতে এ বিদ্যালটিও সরিয়ে নেওয়া হবে ওপারে, রামদাসপুর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে কন্দবপুরে। আবদুর রহিম নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি স্কুলের জন্য ৩৩ শতাংশ জমি দিয়েছেন।

চর সীতারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এ বিদ্যালয়ে ২১৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে এখন আছে ১৫৩ জন। ভাঙন বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। দূরে স্কুল স্থানান্তর করা হলে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পুরানো ছেলে-মেয়ে যেতে পারবে। বাকিরা হয়তো অন্য স্কুলে যাবে, অথবা ঝরে যাবে।

ভোলা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙনের মুখে পড়া স্কুল সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা রয়েছে। স্কুল পরিবর্তনে ছেলে-মেয়েদের সাময়িক সমস্যা হলেও তারা সবাই যাতে বিদ্যালয়ে যেতে পারে, সে চেষ্টা আমাদের রয়েছে।              

রামদাসপুরের ২৭ দাগ বাজারের পশ্চিম পাশে চরের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এটির নাম রাজাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এটি অনেক আগেই ভাঙনের মুখে পড়েছে। কেবলই ভেঙ্গে ফেলা হলো বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনটি। সেখানে ছিল আটটি শ্রেণীকক্ষ। পাশের একটি টিনশেড ঘরের দু’টি কক্ষে এখন ক্লাস চলছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিদ্যালয়ের মাঠে বেঞ্চ পেতে ক্লাস নেন শিক্ষকেরা। বৃষ্টি হলে টিনশেড ঘরের চালা দিয়ে পানি পড়ে। ক্লাস বন্ধ থাকে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবির উদ্দিন খান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিষ্ঠাকালে এ বিদ্যালয়টি ছিল এখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রাজাপুর গ্রামে। প্রথমবার স্থানান্তর করা হয় রামদাসপুরের এই স্থানে। এখন দ্বিতীয়বার সরিয়ে ওপারে কন্দবপুর মৌজায় নেওয়া হচ্ছে। সেখানে একটি পরিত্যক্ত ভবনে বিদ্যালয়ের আরেকটি শাখা খোলা হয়েছে। মাত্র ১৬ জন শিক্ষক এপার-ওপারে দু’টি বিদ্যালয় চালাচ্ছেন।

অভিভাবকেরা জানালেন, ভাঙনের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকায় যেমন ব্যাঘাত ঘটছে, তেমনি ছেলে-মেয়েদের লেখাপাড়াও মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ভালো ছেলে-মেয়ে শিক্ষার অঙ্গণ থেকে ঝরে পড়ছে। ভেঙে যাচ্ছে তাদের জীবনের স্বপ্ন।   
 
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।