ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

ফলোআপ: জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষ বেড়েছে ভোলায়

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪
ফলোআপ: জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষ বেড়েছে ভোলায় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বালিয়াকান্দি, ধনিয়া, ভোলা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ার আর নদীভাঙনে মানুষ ছুটছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বাড়িঘর হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা হারিয়ে ফেলছে জীবিকা নির্বাহের পেশাটিও।

মাথায় ঘরের আসবাবপত্র, হাতে শিশু সন্তানটিকে ধরে নিঃস্ব মানুষদের ঠিকানা হচ্ছে শহরে। বাপ-দাদার ভিটে, ফসলি জমি, বহু পুরনো বাগান, এমনকি প্রিয় স্বজনদের সঙ্গে যুগ যুগের বাঁধন ছিন্ন করে মানুষগুলো চির বিদায় নিচ্ছেন নিজ এলাকা থেকে।
 
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত এক বছরে দ্বীপ জেলা ভোলায় মেঘনার ভাঙন ও জোয়ারের চাপ বেড়েছে। এরফলে গত এক বছরে বেড়েছে স্থানচ্যুত মানুষের সংখ্যাও। ভোলা সদরের দ্বীপ রামদাসপুর, কাছিয়া, ধনিয়া, দৌলতখানের ভবানীপুর, মনুপরার আন্দিরপাড়, দক্ষিণ সাকুচিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু মানুষ অন্যত্র চলে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের অধিকার যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এসব ভূমিহীন মানুষদের খাসজমি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। প‍ুনর্বাসন সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বড় দুর্যোগ হলে সামান্য ত্রাণ সহায়তা ছাড়া তাদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। ফলে তারা যুগের পর যুগ নিগ্রহের শিকার হয়।   

ভোলা সদর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে মেঘনা তীরের কাছিয়া ও ধনিয়া ইউনিয়নের বহু মানুষ জীবিকা ও বাঁচার ঠাঁই খুঁজতে অন্যত্র চলে গেছে। এই দু’টি এলাকা থেকে গত এক বছরে অন্তত আড়াই হাজার মানুষ শহরে চলে গেছে। এসব পরিবারের প্রধান প্রথমে শহরে গিয়ে কাজ খুঁজে, থাকার জায়গা ঠিক করেন। পরে স্বজনদের নিয়ে চলে যান।

দীর্ঘ এক বছর পর মেঘনা তীরের এই এলাকা ঘুরে বাংলানিউজ স্থানান্তরিত মানুষের তথ্য জানতে পেরেছে। এক বছর আগে ঝুঁকির মধ্যে থাকা পরিবারগুলোকে এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানান্তরিত হওয়া মানুষদের কিছু অংশ দূরের শহরে পাড়ি জমিয়েছে, অনেকে আবার জীবিকার প্রয়োজনে কাছাকাছি কোথাও জমি ভাড়া নিয়ে ঘর বানিয়ে থাকছে।

কাছিয়া ও ধনিয়া ইউনিয়নের একাধিক জনপ্রতিনিধি নদীভাঙন ও জোয়ারে স্থানচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন। তারা জানান, এক বছরে নদীভাঙনে বহু এলাকা বিলীন হয়েছে। এসব এলাকার মানুষেরা সরে গেছে অন্যত্র। নদীকেন্দ্রিক জীবিকার কারণে অনেকে এলাকা ছাড়তে পারছেন না। এরা বাড়ি হারানোর পর থাকছে দূরে কোথাও জমি ভাড়া নিয়ে বাড়ি করে।  

রামদাসপুরের নিঃস্ব ওয়াহিদ আলী মাঝির ছোট ভাই খুরশিদ মাঝি পরিবার পরিজনসহ এলাকা ছেড়ে নোয়াখালী বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। সব হারানোর পর একদিন কারো কাছে না বলে নিভৃতেই এলাকা ছেড়ে চলে যান খুরশিদ। এখানে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও সেখানে তার পেশা দিনমজুরি। সেখানে তার মানবেতর জীবন চলছে। স্থানচ্যুত মানুষ হিসাবে তার যে ধরনের সহায়তা পাওয়ার কথা, তা পান নি। অথচ এক সময় তার অনেক সহায় সম্পদ ছিল।  

একই এলাকার আরেকজন বজলুর রহমান দালাল। তার ফুফাতো ভাই নূর ইসলাম দালাল এই এলাকা ছেড়ে নোয়াখালীর হাজীমারা বেড়িবাঁধের পাশে ঠাঁই নিয়েছেন। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭ জন। এরমধ্যে একজন ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। রামদাসপুরে তার জীবিকা ছিল মাছধরা। কিন্তু সেখানে দিনমজুরি করে সংসার চালাতে হচ্ছে।

রামদাসপুরের ওয়ার্ড মেম্বার মো. দুলাল সাজি জানালেন, দ্বীপ রামদাসপুর থেকে গত পাঁচ বছরে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ জীবিকা ও থাকার জায়গার সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছে। গত এক বছরেও এলাকা ছেড়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। ভাঙনের তীর থেকে মানুষেরা ভেতরে এসে ঘর বানায়। যখন কোন উপায় থাকে না তখন তারা চলে যায় অন্যত্র।   
   
জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার প্রসঙ্গে বলেন, একটি চর ভেঙে যাওয়ার পর বিপরীতে আরেকটি চর জেগে উঠলে ভিটেহারা মানুষেরা সেখানে ঠাঁই খোঁজে। কিন্তু নতুন চরে তাদের অধিকার মেলে না। রামদাসপুর চর থেকে খানিক দূরে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা নতুন চর জেগে উঠেছে। কিন্তু ওই চরে রামদাসপুরের ভিটেহারা মানুষের ঠাঁই মিলছে না। চরটি দাবি করছে ভোলা ও নোয়াখালী। এ নিয়ে চলছে মামলা।

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ও পক্ষিয়া, দৌলতখানের সৈয়দপুর এবং ভোলা সদরের ধনিয়া, কাছিয়া ও পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ গত বছরের বর্ষায় প্রায় ৪ মাস পানিবন্দি ছিল। এ সময় মানবেতর জীবন কেটেছে জোয়ার কবলিত এলাকার মানুষদের। বোরহানউদ্দিন উপজেলার সদরের অনেক অংশ এবার নতুন করে প্ল‍াবিত হয়। এবারের জোয়ারের পানিতেও ওইসব এলাকা প্লাবিত হয়। এরফলে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছে।       

দৌলতখান ও ভোলা সদরের কয়েকটি এলাকার লোকজন জানান, জোয়ার আর ভাঙনে বহু মানুষ পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। বহু মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে ছুটেছে। নদীভাঙন নিয়ে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোস্ট ট্রাস্টের দাবি, ভাঙন এলাকায় গত বছর পর্যন্ত অন্তত লক্ষাধিক লোকের পেশা বদল হয়েছে। এবারও বহু মানুষ বাড়ি হারিয়েছে। এরা এলাকার বিভিন্ন বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে কিংবা বাইরে কোথাও কাজের সন্ধানে গেছে।
  
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।