ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

‘ইশকুলে যামু ক্যামনে?’

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৪
‘ইশকুলে যামু ক্যামনে?’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর কলাতলী, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু উপস্থিতি প্রায় শতভাগ বলে সরকার দাবি করলেও উপকূলের দ্বীপাঞ্চলের শিশুদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।

এসব দুর্গম এলাকার বহু ছেলেমেয়ে এখনো স্কুলের বাইরে।

ইচ্ছা থাকলেও এসব শিশুদের অভিভাবকেরা তাদের কাজে পাঠাচ্ছেন।

এসব শিশুদের কেউ মাছ ধরতে যাচ্ছে, কেউবা মাটি কাটছে কিংবা অন্য মজুরির কাজে শ্রম দিচ্ছে। জীবিকার তাগিদে বড়দের সঙ্গে শিশুরাও কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। পড়ার সুযোগ নেই বলে অনেকের আবার প্রাথমিকেই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।

দ্বীপ জেলা ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার কলাতলী ও চর নিজামের চিত্র এমনই। সরেজমিন ঘুরে এইসব চরে বহু শিশুর সঙ্গে দেখা মেলে, যারা জীবনে একবারও স্কুলের চৌকাঠে পা রাখেনি।

নদী তীরবর্তী এলাকায় ঘুরে চোখে পড়ে ১২-১৩ বছরের বহু শিশু মাছধরা নৌকার প্রধান চালক। মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সে এরা এক একজন দক্ষ মাঝি। অনেকে ঘাটের কুলি, হোটেল সাহায্যকারী, গরু মহিষের রাখাল, মাছধরার জাল-নৌকা মেরামতকারী কিংবা নির্মাণ কাজের যোগালি।

চর কলাতলীর আবাসন বাজারে এক হোটেলের সাহায্যকারী রিয়াজ উদ্দিন। বয়স সর্বোচ্চ ১৪ বছর। একদিকে পরিবারের আর্থিক সংকট, অন্যদিকে লেখাপড়ার সুযোগ নেই। সে কারণে পঞ্চম শ্রেণির পর তার লেখাপড়া এগোয়নি। সংসার চালাতে বাবাকে সাহায্য করতে যোগ দিয়েছে হোটেলের সাহায্যকারী হিসাবে। রিয়াজ খুব সহজ করেই বলে দিল, ‘আয় করি, সংসার চালাই, স্কুলে যামু ক্যামনে?’ 

চর কলাতলীর আবাসন বাজারে পেঁছাতেই পড়ন্ত বিকেলে ঘাটে চোখে পড়ল স্কুল গমনোপযোগী বহু শিশু পরের জোয়ারে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ জাল বুনছে, কেউ নৌকা ঠিকঠাক করছে। মনির (৮), সাইফুল (১২), রিপন (১০), দুলালসহ (১৫) আরো অনেকে জানায়, তারা কখনো স্কুলে যায়নি। তবে চরের এইসব ছেলে শিশুদের চেয়ে মেয়ে শিশুদের স্কুলে উপস্থিতির হার বেশি বলে শিক্ষকেরা জানালেন।

চর কলাতলী ও চর নিজামের বিভিন্ন এলাকায় শিশু ও তাদের অভিভাবকরা জানালেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, যোগাযোগ সমস্যা আর পরিবারে আর্থিক সংকট, এই তিন কারণে এই দ‍ুটি চরের বহু শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। প্রাথমিকের পর লেখাপড়া চালিয়ে নিতে চর কলাতলীতে কিছুদিন আগে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় চালু হয়েছে স্থানীয় উদ্যোগে। কিন্তু চর নিজামে এখনো ভরসা ওই একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ষষ্ঠ শ্রেণি কিংবা তার উপরের ক্লাসে পড়তে হলে চরের বাইরে যেতে হয়।

স্থানীয় সূত্র বলছে, চরের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ শিশু স্কুলে যেতে পারছে। বাকিরা স্কুলে যায় না। এক্ষেত্রে যাতায়াত ও অভিভাবকদের অসচেতনতা প্রধান ক‍ারণ বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।

চর কলাতলীতে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে রয়েছে স্থান ও আসবাবপত্র সংকট। শিক্ষকেরা তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে মেঘনা নদী পার হয়ে ওপার থেকে আসেন। অনেক সময় শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ক্লাসের সময় শেষ হয়ে যায়।

কলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নাজমুল হুদা বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, অভাবের তাড়নায় চরের বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে পারে না। যেসব ছেলেমেয়ের নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়ার বয়স হয়নি, তারা ছোট জাল নিয়ে খালে কিংবা ফসলি জমিতে জমে থাকা পানিতে মাছ কিংবা কাঁকড়া ধরে। স্কুলে নাম থাকলেও বহু শিশু বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখে। আবার জোয়ারের পানিতে চর ডুবে থাকলে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না।

চর কলাতলীর মনির বাজারে কিছুদিন আগে স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে চর খালেক নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মাত্র ৫২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে এখানে। এরমধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১৯জন, সপ্তম শ্রেণিতে ১৪ জন এবং অষ্টম শ্রেণিতে ১৯ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। শিক্ষকেরা স্থানীয় ব্যবসাসহ অন্যান্য কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ৫ জন শিক্ষকের মাধ্যমে বিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে।

এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক চন্দ্র দাস বাংলানিউজকে বলেন, চরের যেসব ছেলেমেয়েরা অধিক কষ্টে প্রাথমিক অতিক্রম করে তারা কোনভাবেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ পায় না। এ কারণেই এখানে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কোনমতে একটি নড়বড়ে টিনশেড ঘর তুলে সামান্য কিছু ফার্নিচার নিয়ে শুরু হয়েছে এ বিদ্যালয়ের কাজ। এমপিওভূক্তিসহ অন্যান্য সরকারি সহায়তা চান এই বিদ্যালয় পরিচালনাকারীরা।

চর কলাতলী মনপুরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, চর কলাতলীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও শিক্ষকেরা নিয়মিত স্কুলে যেতে পারেন না। কারণ এদের বসবাস নদীর অন্যপাড়ে। চরে আরও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চর খালেক নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করাও জরুরি।        

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০২৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।