ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

দুর্যোগ বদলে দেয় জীবনের গতিপথ

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৪
দুর্যোগ বদলে দেয় জীবনের গতিপথ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর কলাতলী, মনপুরা, ভোলা থেকে: প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও নেই সাইক্লোন শেল্টার কিংবা মাটির কিল্লা। জোয়ারের পানি বাড়লে আশ্রয় নেওয়ার মতো স্থান নেই।

বাজারের উঁচু ভিটিও ডুবে থাকে পানিতে। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল পৌঁছায় না।

বাতাসের গতিবিধি লক্ষ্য করে আর নদীর ঢেউ দেখে দ্বীপের মানুষেরা নিজেদের পথ চলার নির্দেশনা ঠিক করেন। নদীর উত্তাল ঢেউয়ে যাত্রা বাতিল হয়।

দ্বীপ মনপুরার চর কলাতলীর মানুষেরা এভাবেই বেঁচে থাকেন। দুর্যোগের পর দুর্যোগ আসে, মানুষের বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়। কখনো ভাসায় জোয়ারের পানি, কখনো ওড়ে ঝড়ে। দুর্যোগের সময় রাজধানী, উপজেলা কিংবা জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এ এলাকা। প্রকৃতির বৈরিতায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সরেজমিনে চর কলাতলী ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে মিলেছে দুর্যোগ ঝুঁকির নানা তথ্য। বর্ষার ছয় মাস এ এলাকার মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। এ সময়ে বাইরের যেকোনো স্থান থেকে মনপুরা উপজেলা সদরে পৌঁছানোই কঠিন। আবার মনপুরা থেকে উপজেলার অন্যান্য দ্বীপে যাওয়া আরও ঝুঁকিপূর্ণ।

স্থানীয়রা জানালেন, বর্ষায় প্রতিদিন দু’বার জোয়ারে ডোবে বাড়ি-ঘর। এ ছয় মাসে অমাবশ্যা আর পূর্নিমার জো’তে পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তখন বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয় উঁচু স্থানে। নারী-পুরুষ ও শিশুরা দলে দলে ছোটে আশ্রয়ের সন্ধানে। এ সময় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে বাইরে যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। তখন মানুষের কষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায়।

চর কলাতলীর বাসিন্দা আবদুল মান্নান। বাড়ি চরের দক্ষিণ প্রান্তে। চরে ৮০ শতাংশ জমি কিনেছিলেন ৬০ হাজার টাকায়। একটি ছোট্ট বাড়িও করেছেন। জোয়ারের পানিতে বাড়ির গাছপালা নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বড় জোয়ারে গরু-ছাগলও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গত দু’বছর ধরে পানির চাপ অনেক বেশি।

চরের বাসিন্দা ইয়াসমিন বেগম। স্বামী সিরাজ হাজারী। চার বছর ধরে চরের পানির ভেতরে ভিটি উঁচু করে ছোট্ট বাড়ি বানিয়েছেন। কিন্তু দুর্যোগের মৌসুমে এখানে বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। ঘরের ভেতরেও ঢুকে যায় পানি। তখন চৌকির ওপর উঠে কোনোমতে সময় পার করতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় কখন পানি নেমে যাবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, দুর্যোগকালে এখানে আশ্রয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই উঁচু কোনো ভবন। চরের কেন্দ্রবিন্দু মনির বাজারে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেলটার নির্মিত হচ্ছে। এ বাজার থেকে খানিক উত্তরে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবন হচ্ছে। এগুলোর কাজ শেষ হলে হয়তো কিছু মানুষ আশ্রয়ের সুযোগ পাবেন। কিন্তু রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ থাকায় এ ভবন পর্যন্ত মানুষের পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে।

অফিস খাল বাজার, মনির বাজার, কবীর বাজার, চেয়ারম্যান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চরের রাস্তাগুলো অত্যন্ত নিচু। এগুলো ঠিক এখনও রাস্তা হয়ে হয়ে ওঠেনি। বলা যায় গ্রামের চলাচলের পথ। মনির বাজার থেকে অফিস খাল বাজারে যেতে দেখা গেল জোয়ারের পানি সামান্য বাড়তেই রাস্তা উপচে পানি আসছে। পথে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো।

মনপুরার ঝুঁকিপূর্ণ দ্বীপ চর কলাতলী মারাত্মক দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে দাবি এলাকার ইউপি মেম্বার মো. জাফর উল্লাহর। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, লোনা পানি প্রতি বছর এখানকার ফসল নষ্ট করছে। আমন ধান আবাদ হলেও তা পানিতে তলিয়ে যায়। এবার কেউ আমন ফলাতে পারেননি। বেশ কয়েকবার বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, বর্ষার পুরো ছয় মাস দুই-চার দিন পর পর ঝড় থাকে। প্রায় এক মাস ধরে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মনির বাজারে একটি সাইক্লোন শেলটার ও উত্তর খালেকনগরে একটি দোতলা স্কুল ভবন নির্মিত হচ্ছে। তবে তাতে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার লোক আশ্রয় নিতে পারবেন। অথচ চর কলাতলীর লোকসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। বর্ষাকালে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা অন্যতম দুর্যোগ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

চর কলাতলীর দুর্যোগ ঝুঁকি নিয়ে আলাপ হলো সাইক্লোন প্রিপারডনেস প্রোগ্রামের (সিপিপি) মনপুরা উপজেলা টিম লিডার দিলীপ মজুমদারের সঙ্গে। চরটি মারাত্মক দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকার বিষয়ে একমত পোষণ করে তিনি জানালেন, ওই চরে সিপিপির কোনো স্টেশন নেই। মোবাইলের মাধ্যম ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, যেকোনো বড় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকে কেন্দ্র করেই এ এলাকায় দুর্যোগ ঝুঁকি রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বেড়িবাঁধ না থাকায় চরটি বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। চর কলাতলীতে পাঁচটি সাইক্লোন শেল্টার ও পাঁচটি মাটির কিল্লার প্রস্তাব করা হয়েছে সিপিপি’র পক্ষ থেকে।

মনপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, এটা মেঘনা নদীর বুকে জেগে থাকা একটি দ্বীপ। প্রতিনিয়ত এ দ্বীপ দুর্যোগের মুখে থাকে। এখানকার মানুষদের দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, মাটির কিল্লা, বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রয়োজন।   

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।