ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

বাঁধ কেটে পানি থেকে বাঁচান

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৪
বাঁধ কেটে পানি থেকে বাঁচান ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দক্ষিণ সাকুচিয়া, মনপুরা, ভোলা থেকে: বাঁধ পানি থেকে বাঁচানোর দাবি তুলেছেন দ্বীপের পানিবন্দি মানুষেরা। বর্ষা মৌসুমের শুরু হতে না হতে দ্বীপের বহু মানুষ জোয়ারের পানিতে ভাসছে।

মাসে দু’বার পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে সাজানোর ঘরবাড়ি। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিতে থাকে। পানির কারণে জমিতে আমন আবাদ হবে না, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, বাড়ির ভিটে ক্ষয়ে যাচ্ছে।   

উপকূলের দ্বীপ মনপুরার সর্বদক্ষিণের দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের মানুষের এখন জোয়ারের পানির সঙ্গেই বসবাস। খাওয়া-দাওয়া, হাট-বাজার করা, কাজে যাওয়া সবই নির্ভর করছে জোয়ারের পানির ওপরে। পানিবন্দি মানুষদের অনেকেই উঁচু এলাকার স্বজনদের বাড়ি থেকে ভাত রান্না করে বাড়িতে নিয়ে আসছেন। পানির কারণে কেউ ঘরে বন্দি হয়ে পড়ছেন, কেউবা বাইরে। সবার অপেক্ষা পানি সরে যাওয়ার।

দক্ষিণ সাকুচিয়ার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে বাংলানিউজ দেখতে পেয়েছে, জোয়ারের পানি সেখানকার মানুষদের নিত্যদিনের বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো ঘরেই পানি, আবার কখনো ঘর থেকে বের হলেই পানি। রাস্তা ডুবেছে। এই বর্ষায় যে ফসলি মাঠে আমন আবাদের ধুম পড়ে যাওয়ার কথা, সেখানে সকাল-দুপুর-বিকালে থই থই পানি। রাস্তার ওপরে উঠে এসেছে গোয়াল ঘর। গরু-মহিষের জন্য খাবার দেওয়া হয়েছে রাস্তার ওপরে।

সমুদ্র মোহনায় এই জনপদের তিন দিকে বইছে মেঘনার উত্তাল তরঙ্গ। বর্ষা শুরু হতে না হতেই এখানকার মানুষ নানামূখী দুর্যোগের মধ্যে পড়তে শুরু করে। ঘূর্ণিঝড় এলে মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। তবে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ হয়ে এসেছে জোয়ারের পানি।

বয়সী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, এবার জোয়ারের পানির চাপ অনেক বেড়েছে। বিগত বছরগুলোতে সমস্যা এতোটা ভয়াবহ ছিল না।

দক্ষিণ সাকুচিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম মিজি বলেন, বাড়ির চারপাশে পানি। ঘরেও পানি। বাড়ির দরজায় কোমর পানি। ওই পানি পেরিয়ে বাড়িতে আসা যাওয়া করতে হয়। জমি পানিতে ডুবে থাকার কারণে আমন আবাদ করতে পারছেন না। তিনবার বীজতলা তৈরির চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। এবার আমন আবাদ করা সম্ভব হবে কি-না জানেন না।

ইউনিয়নের প্রধান সড়কের দক্ষিণ প্রান্তে তালতলার দোকানদার নূর উদ্দিন বলেন, ২০ দিন ধরে চুলা জ্বলেনি। পরে চুলা চৌকির ওপর উঠিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাষাবাদে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমন আবাদের সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চাষিরা মাঠে নামতে পারেননি।

ইউনিয়নের সিরাজগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনে সেই পানি অতিক্রম করে বহু মানুষ ছুটছেন হাটে-বাজারে কিংবা কর্মস্থলে। সিরাজগঞ্জ বাজারে কথা হলো স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। তারা জানালেন, জোয়ারের পানিতে বাড়ির ভিটে ধ্বসে যাচ্ছে। নড়বড়ে হয়ে পড়ছে ঘরের ভিত্তি। বহু সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।

পানিবন্দি মানুষেরা জানালেন, গত বছরের চেয়ে এবার জোয়ারের পানিতে এলাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে যাতায়াতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। পুকুরের মাছ চলে যাচ্ছে। বাড়ির ভিটে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। জোয়ারের প্রবল চাপে জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে যেতে পারছেন না। ফলে তাদের পরিবারে দেখা দিচ্ছে আর্থিক সংকট।
 
সরেজমিনে পানিবন্দি এলাকা ঘুরে অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই এলাকার মানুষদের পানি থেকে বাঁচাতে এবার নতুন বাঁধ হলেও বর্ষার আগে তার কাজ শেষ না হওয়ায় প্রবল জোয়ারের চাপে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অন্যদিকে পুরোনো বাঁধের সঙ্গে নির্মিত স্লুইজ গেটগুলো যথাযথভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় জোয়ারের পানি ঢুকে তা বের হতে পারছে না।  

পানি সরানোর দাবি তুলে এলাকার মানুষ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বাঁধ চেয়েছিলাম। কিন্তু সে বাঁধ তো হলো না। এখন বাঁধ কেটে দিয়ে আমাদের পানি থেকে বাঁচান। কিছু অংশে বাঁধ থাকার কারণে জোয়ারের পানি ঢুকলে তা আর বের হতে পারে না। এর চেয়ে বাঁধ না থাকলে জোয়ারের পানি আসবে, আবার ভাটায় নেমে যাবে। চাষাবাদে কোনো সমস্যা হবে না।

দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অলি উল্লা কাজল বাংলানিউজকে বলেন, এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সর্বদক্ষিণে অবস্থানের কারণে দ্বীপ মনপুরায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে এ ইউনিয়ন। এখানকার প্রায় ২২ হাজার মানুষ বর্ষা এলেই ঝুঁকির মুখে পড়ে। এবারের পরিস্থিতি ভয়াবহ।

তিনি বলেন, যে বেড়িবাঁধ নির্মিত হচ্ছে, তা কোনোভাবেই সমুদ্র মোহনার এই এলাকা রক্ষা করতে পারবে না। এলাকাটি ঝুঁকিমুক্ত করে এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে পূর্ণাঙ্গ বেড়িবাঁধ দিতে হবে। ব্লক, জিও ব্যাগ ও পাইলিং না দিলে এই বাঁধ বার বার ভাঙনের মুখে পড়বে। বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুটের স্থলে ১৪ ফুট এবং ঢাল ২০ ফুটের স্থুলে ৩০ ফুট করতে হবে। তাহলে বাঁধ টেকসই হবে।        
  
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০২০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।