ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জোয়ারে ভেসেছে দ্বীপের ঈদ-আনন্দ!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৪
জোয়ারে ভেসেছে দ্বীপের ঈদ-আনন্দ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দক্ষিণ সাকুচিয়া, মনপুরা, ভোলা থেকে : জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে দ্বীপের ঈদ-আনন্দ। পানিতে ডুবন্ত চুলো জ্বালানো সম্ভব হয়নি।

ঈদ-সকালে রান্না হয়নি সেমাই-ফিরনি। বহু মানুষ এই বিশেষ দিনটিতে যেতে পারেননি স্বজনদের বাড়িতে। এমনকি বহু বাড়ির মানুষরা এঘর থেকে ওঘরেও যেতে পারেননি। ফলে ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে।

এ চিত্র দ্বীপ জেলা ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার সর্বদক্ষিণে দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের। এখানকার প্রায় ২২ হাজার মানুষের ঈদ ভেসেছে জোয়ারের পানিতে। সমুদ্র মোহনায় জেগে থাকা এই ইউনিয়নের দক্ষিণে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে লোকালয়ে। ডুবেছে বহু বাড়িঘর। আমনের বীজতলা, রাস্তাঘাট, বাড়ির উঠোন এমনকি ঘরের মেঝে পর্যন্ত থাকছে পানির নিচে।

ঈদের পরের দিন দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে জোয়ারে ভাসা বিপন্ন মানুষদের ম্লান হয়ে যাওয়া ঈদ উদযাপনের তথ্য। পানিতে ডুবে থাকা বাড়িঘরের বাসিন্দারা বলেছেন, এবার ঈদ হয়নি। ঈদের দিন দূরের স্বজনদের কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, এঘর থেকে ওঘরে প্রতিবেশির খোঁজখবর নিতে যাওয়াও সম্ভব হয়নি।

বানভাসি মানুষরা জানান, গত চারদিন ধরে জোয়ারের পানি বাড়ছে। রাতে আর দুপুরে দু’বার করে জোয়ারের পানিতে ডুবছে বাড়িঘর। জুলাইয়ের ১২ তারিখে পুর্ণিমার জো’তে জোয়ারের প্রবল চাপে এই এলাকার নতুন বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ওই সময় প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে জোয়ারের পানিতে ভাসে মানুষগুলো। সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার জোয়ারের চাপ বেড়েছে।

ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাজমা বেগম। স্বামী শিপন খা। কর্মজীবী মানুষ। যখন যে কাজ পাওয়া যায়, তা-ই করে সংসার চালান। জোয়ারের পানিতে তার অনেক ক্ষতি হয়েছে। চুলো ডুবে থাকার কারণে ঈদের দিন ঘরে সেমাই রান্না করতে পারেননি। যেতে পারেননি আশপাশের বাড়িঘরে।

পাশের বাড়ির আমেনা বেগম। স্বামী নাসির মাঝি। মাছধরে জীবিকা চলে। জানালেন, জোয়ারে পানি তাদের বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি করেছে। চুলো ডুবে গেছে পানিতে। বাড়ির ভিটার মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এখন চুলা উঁচু করে বানিয়ে কোনমতে রান্নাবান্না করতে পারছেন। তবে রোযার বেশিরভাগ সময় পানি পেরিয়ে দূরের উঁচু এলাকার বাড়ি থেকে রান্না করে আনতে হয়েছে। যেদিন রান্না হয়নি, সেদিন চালিয়ে নেওয়া হয়েছে শুকনো খাবার দিয়ে।

ইউনিয়নের সিরাজগঞ্জ বাজারের পাশের গ্রামের বাসিন্দা রুহুল আমীর পাটোয়ারী জানালেন, এই এলাকার বহু মানুষের ঘরে এবার ঈদ হয়নি। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকায় যাতায়াত সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। কিছুদিন আগে এই এলাকা জোয়ারের পানিতে ডুবেছিল। সে কারণে অনেকেই ঈদের আগে অর্থ সংকটে পড়েছিল। সেই চাপ সামলে উঠে কিছু মানুষ ধারদেনা করে ঈদের প্রস্তুতি নিলেও তাদের ঈদের আনন্দ মাটিতে মিশেছে।

ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল হান্নান বলেন, ঈদের দিন যে উৎসব হওয়ার কথা, তা এবার এই এলাকার মানুষ দেখেনি। জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে থাকাই এর অন্যতম কারণ। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৫০টি পরিবারের মধ্যে সবাই জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কোন বিশেষ বরাদ্দ নেই। তবে ঈদ উপলক্ষে ওয়ার্ডের ১২০ পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাউল দেয়া হয়েছে। মানুষের পানির কষ্ট পুষিয়ে নিতে আরও সহায়তার দাবি তার।

দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অলি উল্লা কাজল বাংলানিউজকে বলেন, রোযার মধ্যে একবার জোয়ারের পানি এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। আবার ঈদের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আবার ডুবেছে বাড়িঘর। ইউনিয়নের ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২২ হাজার মানুষই কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

ফলে এলাকার অধিকাংশ মানুষের ঘরেই ঈদের আনন্দ ছিল না। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কিংবা ঈদ উদযাপনের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের কোন ধরণের সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রথমবার পানি উঠলে আড়াই টন চাউল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই চাউল মাত্র ১০ কেজি করে ২৫০ জনকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আরও সাড়ে আট টন চাউল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তবে তা এখনও উত্তোলন করা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।   

তিনি বলেন, সমুদ্র মোহনার এই ইউনিয়নটি সারাবছরই ঝুঁকির মুখে থাকে। এর ওপর কয়েকদিন আগে জোয়ারের প্রবল চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এই বর্ষায় ইউনিয়নের প্রায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিহিন অবস্থায় রয়েছে। এরফলে জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর ডুবে ব্যাপক ক্ষতি করছে।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময় : ০৪৩২ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।