ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

ঈদ-আনন্দ ফেরেনি দ্বীপের জেলেগ্রামে!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৪
ঈদ-আনন্দ ফেরেনি দ্বীপের জেলেগ্রামে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর জ্ঞান, হাজীর হাট, মনপুরা, ভোলা থেকে: চুলোয় হাড়ি ওঠেনি কারও ঘরে। সকালে কেউ কেউ আগেরদিন রান্না করা আলু ভাত খেয়েছেন।

অনেকে আবার দিনের প্রথম প্রহরের অনেকটা পেরিয়ে গেলেও কোন খাবার পাননি। দু’চার ঘরে সামান্য সেমাইয়ের আয়োজন। সেজন্যে আবার দেনা করতে হয়েছে। কোন ঘরেই ঈদের বিশেষ কোন আয়োজন ছিল না। যোগাড় হয়নি নতুন কাপড়। গ্রামজুড়ে ছিল না ঈদের আমেজ।

দেশের সর্বদক্ষিণে দ্বীপ জেলা ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার মেঘনা তীরের জেলেগ্রাম চর জ্ঞান এভাবেই ঝিমিয়ে ছিল ঈদের দিন।

ঈদের দিন ভোর থেকে এ গ্রামে অবস্থান করে বাসিন্দাদের ঈদ-আয়োজনের খোঁজখবর নিয়েছে বাংলানিউজ। ঈদ এখানকার নারী-পুরুষ ও শিশুদের জীবনে বিশেষ কোন অর্থ বয়ে আনেনি। অন্যদিনগুলোর সঙ্গে ঈদের দিনের পার্থক্য খুঁজে পান না তারা।
 
ঈদের একদিন আগে ঈদ-প্রস্তুতির খবর নিতে এই গ্রামে গিয়েছিল বাংলানিউজ। তখন তথ্য মিলেছিল জেলেগ্রামের বাসিন্দারা ঈদের কোন প্রস্তুতি নিতে পারছেন না। পূরণ করতে পারছেন না ছেলেমেয়েদের নতুন পোষাকের আবদার। মাত্র একদিন পর আজ ঈদের দিনে তারই প্রতিফলন ঘটল। অতিবাহিত হল খেয়ে না খেয়ে থাকা একটি দিন।    
 
চর জ্ঞানের বাসিন্দা ইসলাম। পাঁচ ছেলেমেয়ের বাবা। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ঈদের আগে কয়েকটি দিন অনেক চেষ্টা করেছেন ঈদের জন্য কিছু অর্থকড়ি জমাতে। কিন্তু পারেন নি। নদীতে জাল ফেলে মেলেনি ইলিশ। এ ক’দিনে বাড়তি রোজগারের বদলে বেড়েছে দেনার বোঝা। ফলে পাঁচ ছেলেমেয়ে, ঘরে থাকা মেয়ের জামাই এবং স্ত্রীর জন্য কোন নতুন কাপড় কিনতে পারেন নি। ঘরে আয়োজন করা সম্ভব হয়নি বিশেষ কোন খাবারের।

ঈদেরদিন ভোর থেকেই ইসলামের মনটা খুব খারাপ। ঘরেই শুয়ে ছিলেন। এমনকি ঈদের নামাজ পড়তে যেতেও চাইলেন না। অবশেষে নামাজে গেলেন। তবে ঈদের দিন জেলেগ্রামের বেড়ির পাশে তার ছোট্ট খড়ের ঘরটা ছিল একেবারেই নিষ্প্রাণ।

চর জ্ঞান জেলেগ্রামের শিশু জান্নাত, আল আমীন, হাসনাইন ঈদের নতুন কাপড় চেয়েছিল বাবা জাকির হোসেনের কাছে। মা শেফু বেগমের কাছেও বায়না কম ধরেনি। কিন্তু পায়নি। ঈদের দিন উদোম শরীরে ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল গ্রামের রাস্তায়।

শেফু বেগম বলেন, নতুন কাপড় না পেয়ে ছেলেমেয়েরা ঈদের আগের দিন থেকে কেঁদেছে। নতুন কাপড় তো দূরের কথা, সেমাইও রান্না করে দিতে পারেনি। নদীতে মাছ নেই। তিনবেলা ভাতই খেতে পারছি না। ঈদের খরচ পাই কই।

মাছধরা পেশায় নিয়োজিত আরেকজন বাবুল মিয়া। তার স্ত্রী লাইজু বেগম আক্ষেপের সঙ্গে বলছিলেন, আড়াই বছরের মেয়ে লিজার জন্য ঈদে কিছুই কিনতে পারেননি। শিশু বয়সেও অন্যের পরনে নতুন কাপড় দেখে ‘দে দে’ বলে লিজা তার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু মায়ের কিছুই করার নেই।

আঙ্গুর বিবি। স্বামী আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন অনেক আগেই। ছেলে আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে সংসার। সদস্য সংখ্যা পাঁচ। ঈদ করতে হয় বলে ঈদের আগেরদিন ৫০০ গ্রাম সেমাই, আড়াইশ’ গ্রাম চিনি, আর আড়াইশ’ গ্রাম বাদাম এনেছেন। একটা নারিকেল আনার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু টাকায় কুলোয় নি। এটাই এই পরিবারে ঈদের বিশেষ আয়োজন।                  
    
‘কেউর দু:খে ঈদ যায়, কেউর সুখে ঈদ যায়’ ঈদের দিনের কষ্টের কথা জানাতে গিয়ে এই বাক্যটি উচ্চারণ করলেন মাছধরা পেশায় নিয়োজিত আবদুর রব। ঈদের দিনের জন্য এককেজি খোলা সেমাই, এককেজি চিনি আর একটি নারিকেল এনেছিলেন। ছেলেমেয়েদের কিছু নতুন কাপড় দিয়েছে; তবে সেজন্য দেনা হতে হয়েছে প্রায় ১২শ’ টাকা।

ঈদে নতুন কাপড় পায়নি বলে ভোর থেকে কেঁদেছে ইউসুফ আলীর ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া মুক্তা। ওর ছিল ‘পাখি’ ড্রেসের শখ। কিন্তু পায়নি। ওর মা পারুল বেগম জানালেন, গুড়া চালের ফিরনি রান্না করতে খরচ একটু বেশি পড়ে বলে অল্প পরিমাণ সেমাই রান্না করেছিলেন। এটাই এই পরিবারের ঈদের আয়োজন।

ঈদের দিন ভোরে চর জ্ঞান জেলেগ্রামে ঢুকে চোখে পড়ে সুনসান নিরবতা। অধিকাংশ ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। দু’একটি খোলা দরজা পেলেও উকি দিয়ে কোন লোকের দেখা মেলেনি। কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউবা কাজের সন্ধানে বাইরে বের হয়ে গেছে। কেউ আবার গিয়েছে ঈদের নামাজ পড়তে। গ্রামের দোকানদার বাবুল মিয়ার ঈদের ভোরে প্রধান কাজ ছিল দোকানের মালামাল গোছানো। ঈদের আনন্দ তাকে ছুঁতে পারেনি।

ঈদের দিন ভোরে গোসল সেরে নতুন জামাকাপড় পড়া, এঘরে ও ঘরে স্বজনদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের রেওয়াজ থাকলেও এই জেলেগ্রামে সেটা চোখে পড়েনি। দলে দলে এঘর থেকেও ঘরে ছুটার কোন দৃশ্যই চোখে পড়েনি। ঈদের একদিন আগে পরিচিত হওয়া বাংলানিউজ প্রতিনিধির কাছে ছুটে এসে অনেকেই জানালেন তাদের ঈদের দিনের কষ্টের কথা।

দ্বীপ মনপুরায় ঈদের সকালে প্রধান খাবার গুড়া চালের ফিরনি, হাতে বানানো সেমাই (ছই পিঠা), বাজার থেকে কেনা সেমাই আর শরবত। দুপুরে পোলাও-মাংস-মাছ ইত্যাদি। ঈদের এই এলাকায় অনেক স্থানে এমন আয়োজন হলেও চর জ্ঞান জেলেগ্রামসহ বহু মানুষের ভাগ্যে এসব খাবার জুটেনি।

অর্থ সংকটের প্রধান কারণ কী, যার ফলে এবারে এসব মানুষের ঈদ হলো না? এমন প্রশ্নের জবাবে জেলেগ্রামের বাসিন্দারা জানালেন, নদীতে ইলিশ না ধরা পড়া। দিনের পর দিন নদীতে জাল ফেলেও জালে উঠছে না ইলিশ। মৌসুমে ইলিশ না পড়ায় জেলেরা দিন কাটাচ্ছে অতি কষ্টে। তার ওপর দাদনের কষাঘাতে এক একটি জেলে পরিবার নি:স্ব থেকে নি:স্ব হচ্ছে। আর তাই এবার ঈদ তাদের জীবনকে ছুঁতে পারেনি।   

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।