ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

ভয়াল ২৯ এপ্রিল, আতঙ্ক কাটেনা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪
ভয়াল ২৯ এপ্রিল, আতঙ্ক কাটেনা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চিরিংগা, চকরিয়া, কক্সবাজার থেকে: বাঁশের বেড়া আর বালুর বস্তা ফেলে কোথাও বেড়িবাঁধ রক্ষার চেষ্টা চলছে। আবার কোথাও যথাযথ কাজ না হওয়ায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও বাঁধ টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।



ঝুঁকিপূর্ণ সাইক্লোন শেল্টার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বহু গ্রাম থেকে সাইক্লোন শেল্টার অনেক দূরে। কোথাও আশ্রয় নেওয়ার জন্য একটা শেল্টার নির্মাণ করা হলেও সেখানে পৌঁছানোর মতো রাস্তা হয়নি। আবার অনেক স্থানে নেই সবুজবেষ্টনীর নিরাপত্তা।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দেশের পূর্ব-উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে এ সব তথ্য পেয়েছে বাংলানিউজ।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, কাঠগড়, সীতাকুণ্ডু, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, কক্সবাজারের চকরিয়া ঘুরে মিলেছে মানুষের সংকটের চিত্র। সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ২৩ বছর পরেও উপকূলের মানুষের বিপন্নতা কাটেনি।

১৯৯১ সালের এই দিনে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের নাম ছিল ‘ম্যারি এন’। মহাপ্রলয়ঙ্করী ও স্মরণকালের ভয়াবহ ছিল এ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এতে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের ৩০০ কিলোমিটার এলাকা।

ঘূর্ণিঝড় ও সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দ্বিগুণ। মারা যায় ২০ লাখ গবাদি পশু। গৃহহারা হয়েছিলেন ৫০ লাখ মানুষ।

সেদিনের গল্প শুনেছে বাংলানিউজ
এবার এই ভয়াবহতম দিনটির ঠিক আগ মুহূর্তে স্বজন হারানো মানুষদের কাছ থেকে সেই রাতের গল্প শুনেছে বাংলানিউজ। সেই কালো রাতে ঝড়ের ছোবলে মায়ের কোল থেকে হারিয়েছিল দুধের শিশু, ভাই হারিয়েছিল অতি আদরের বোন, স্বামী হারিয়েছিল প্রিয়তমা স্ত্রীকে, স্বজন হারানোর কান্না আর লাশের স্তূপে পরিণত হয়েছিল সমুদ্রপাড়সহ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর নদীর তীর।



টগবগে তারুণ্যের সব হারানো সেই সব মানুষদের অনেকেই বার্ধক্যে ন্যূয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার দুঃসহ সেই স্মৃতি নিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু, সেই শোকগাথা এইসব এলাকার মানুষদের জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।   সেই ভয়াল রাতের ভয় এখনও এইসব এলাকার মানুষদের তাড়িয়ে ফেরে।

কথা বলতে গিয়ে অনেকের চোখ ভিজে ওঠে। সন্ধ্যা ৭টায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। রাত ৮টায় বাড়িঘরে পানি ঢোকে। ৯টায় বাড়িঘর আর মানুষজন ভাসিয়ে নিতে শুরু করে। কেউ গাছ ধরেছেন, কেউ ভেসে গেছেন। রাত ১টার দিকে ভাটার টানে অধিকাংশ মৃতদেহ সমুদ্রে চলে যায়। এইসব দৃশ্য সমুদ্রপাড়ের মানুষদের স্মৃতিতে এখনও স্পষ্ট।

চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী হাজী নূর মোহাম্মদ বলছিলেন, তাদের যৌথ পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৬। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে তার বাবা-মা ও পাঁচ ছেলেমেয়ে ছিল। শুধু বাবা ও এক ছেলের লাশ পেয়েছিলেন তিনি। বাকিদের কোনো সন্ধান মেলেনি।

বদরখালীর এই এলাকাটিতে মাত্র পাঁচ শতাংশ বাড়ি অবশিষ্ট ছিল। বাকিগুলো উড়ে যায়।


বদরখালী বাজার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ফিশারি ঘাটে চায়ের দোকানে আলাপকালে সেইদিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন অনেকেই। মোজাফফর আহমেদ, নাসির উদ্দিন, মো. হাশেম, আলী হোসেনসহ উপস্থিত প্রায় সবাই ওই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখেছেন। এখন আর তারা সেদিনের কথা মনে করতে চান না।

অরক্ষিত ১৮০ কিলোমিটার উপকূল
সেই ভয়াল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কথা মনে পড়লে এখনও ভয়ে শিউরে ওঠেন চট্টগ্রাম সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার মানুষ। বিপর্যয়ের পরের বছর চট্টগ্রাম শহর রক্ষায় উদ্যোগ নেয় সরকার। সাগরের তীর ঘেঁষে নির্মাণ করা হয় ২৩ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ। এখন সেই শহর রক্ষা বাঁধ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বাঁধের কোথাও ফাটল দেখা দিয়েছে। আবার কোথাও কোথাও মাটি সরে গেছে।  

এলাকা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে, ১৯৯১ সালের পর থেকে দীর্ঘ ২৩ বছরেও উপকূলবাসী পায়নি দুর্যোগ থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৮০ কিলোমিটার উপকূল অরক্ষিত। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলের ১৮০ কিলোমিটারেই বনায়ন নেই। এছাড়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধও মজবুত নয়। ফলে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের প্রায় দেড় কোটি মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র বলছে, ১৯৬৫ সালেই পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলে ১৯৯৩ থেকে ৯৬ সালের মধ্যে ৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে নতুন করে বেড়িবাধঁ নির্মাণ করা হয়।
প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি এলাকায় এক কিলোমিটার সি-ওয়াল, পতেঙ্গা থেকে হোসেন আহমদ পাড়া পর্যন্ত পাথরের ব্লক, সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ২৩ কিলোমিটারের মধ্যে ২৩টি স্লুইসগেটের প্রায় সবগুলোই এখন অকেজো।

বাঁধ ঠেকাতে বালুর বস্তা, বাঁশের খুঁটি
সরেজমিন দেখা গেছে, পাউবো বালুর ভর্তি বস্তা ফেলে, বাঁশের খুঁটি-বেড়া দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করছে এই বাঁধ। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থান একেবারে ভেঙে গেছে। আবার পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে স্টিল মিল এলাকার হোসেন আহমদ পাড়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় পাথরের ব্লক দেওয়া হলেও অনেক স্থানে এসব পাথরের ব্লকও তছনছ হয়ে গেছে।

উত্তর পতেঙ্গা পশ্চিম হোসেন আহমদ পাড়ার বাসিন্দা মো. সোলায়মান বলেন, নির্মাণের পর প্রায় দীর্ঘ ২০ বছরে উল্লেখযোগ্য সংস্কার না হওয়ায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মিত বাঁধটি বিপন্ন হয়ে পড়ায় নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।

বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানলে পানিতে তলিয়ে যাবে চট্টগ্রাম। তাছাড়া এই বাঁধের মানুষদের দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেওয়ার মতো নিরাপদ কোনো স্থান নেই।

শহর রক্ষা বাধঁটি বিপন্ন হয়ে পড়ায় পুরো এলাকার মানুষের দিন কাটছে চরম আতঙ্কে। নিম্নচাপ কিংবা অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় সাগরে পানি বেড়ে গিয়ে তীরে ঢেউ আছড়ে পড়লে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে এখানকার মানুষদের। বাঁধের বাইরে থাকা বাসিন্দাদের জীবন আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকে জোয়ারের পানি ঠেকাতে ঘরের চারপাশে মাটি ফেলে উঁচু করে নিয়েছেন।

সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম ঝুঁকিতে
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের মানুষেরা ঝুঁকির মুখে থাকেন দুর্যোগ মৌসুমে। পশ্চিমে রহমতপুর ইউনিয়নের প্রায় চার কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

রহমতপুর ইউনিয়নের ২নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, রহমতপুর স্লুইসগেট থেকে আজমপুরের সীমানা পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। আট মাস আগে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকে এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। স্থানীয় উদ্যোগে কিছু বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। জলবায়ু ট্রাস্টফান্ডের আওতায় সন্দ্বীপের কিছু এলাকায় বাঁধের কাজ হলেও এই এলাকায় কোনো কাজ হচ্ছে না।


সন্দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তে সারিকাইত ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার বহু মানুষ ঝুঁকিতে থাকে সারা মৌসুম। এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, সব হারানো বহু পরিবার এখনও ভাঙন কবলিত এলাকার আশপাশেই বসবাস করছেন। তাদের বাড়ি অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো জায়গা নেই।


বাংলাবাজারের ঐতিহ্যবাহী মৎস্য বাজারটি বিলীন হওয়ার পথে। এ সব এলাকার বাঁধের পাশের গাছপালাও হারিয়ে গেছে।

বন নেই অধিকাংশ এলাকায়
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, উপকূলীয় বনায়ন না থাকায় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হয়েছিল। তাদের মতে, উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে মুসলিমাবাদ পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গাছ রয়েছে। পরবর্তী আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় কোনো বনায়ন নেই। হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায় কিছু বনায়ন থাকার পর কাট্টলী এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বনায়ন রয়েছে। আর বাকি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনীর চিহ্ন মাত্র নেই।


কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ছিল চকরিয়া সুন্দরবন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এই বনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন এলাকার মানুষ। বদরখালী বাজারে আলাপকালে অনেকেই বলছিলেন, ওই বনটি থাকলে ঘূর্ণিঝড়ে এই এলাকার এত ক্ষতি হতো না।   

নিরাপত্তার দাবিটাই প্রধান
প্রলয়ঙ্করী সেই ঘূর্ণিঝড়ের ২৩ বছর পরেও উপকূলের মানুষ দুর্যোগ থেকে বাঁচার নিরাপত্তা চেয়েই সরকারের কাছে দাবি তুলেছেন। সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, পতেঙ্গা, চকরিয়া, কুতুবদিয়া এলাকার ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত মানুষদের কাছে এখনও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দাবিটাই প্রধান হয়ে আছে। তারা বলেন, যা হারিয়েছি, তা কেউ ফেরত দিতে পারবে না। বাকি জীবনটা বেঁচে থাকার নিরাপত্তা চাই। শুধু ঘুর্ণিঝড়ের আগে-পরে নয়, সারাবছরই সরকারের সুনজর চাই।   


প্রলয়ঙ্করী সেই ঘূর্ণিঝড়ের ২৩ বছর পরেও উপকূলের মানুষ দুর্যোগ থেকে বাঁচার নিরাপত্তা চেয়েই সরকারের কাছে দাবি তুলেছেন। সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, পতেঙ্গা, চকরিয়া, কুতুবদিয়া এলাকার ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত মানুষদের কাছে এখনও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দাবিটাই প্রধান হয়ে আছে। তারা বলেন, যা হারিয়েছি, তা কেউ ফেরত দিতে পারবে না। বাকি জীবনটা বেঁচে থাকার নিরাপত্তা চাই। শুধু ঘুর্ণিঝড়ের আগে-পরে নয়, সারাবছরই সরকারের সুনজর চাই।   

বাংলাদেশ সময়: ০৬০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।