ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

টিফিনে সরকারি বিস্কিট, তৃষ্ণা মেটাতে জল নেই

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৪
টিফিনে সরকারি বিস্কিট, তৃষ্ণা মেটাতে জল নেই

বাহেরচর, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী থেকে: টিফিনে সরকারি বিস্কিট মেলে, তৃষ্ণা মেটাতে মেলেনা এক ফোঁটা জল। আশপাশের বাড়ি থেকে খাবার পানি আনতে হয়।

টয়লেটের কাজ সারতে হয় রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ে। ক্লাস আর বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ সবই চলে টিনশেড একটি লম্বা ঘরে। এখানে বছরের পর বছর বিনা বেতনেই শিক্ষাদান করছেন শিক্ষকরা।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর বাহেরচর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে আমলীবাড়িয়া গ্রামের মজিদবাড়িয়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থা এমনই। ১৯৯১ সালে স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল এই বিদ্যালয়টি। পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করলেও বিদ্যালয়টি প্রায় দুই যুগেও সরকারিকরণ হয়নি। আশপাশে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে এ বিদ্যালয়েই আসছে প্রায় আড়াইশ’ শিশু-কিশোর।

দেশের দক্ষিণে সাগরপাড়ের উপজেলা রাঙ্গাবালীর শিক্ষাচিত্র এমনই। এখানে শিক্ষায় সংকটের শেষ নেই। স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের চেষ্টায় গড়ে ওঠা প্রাথমিক বিদ্যালয় যুগে যুগেও সরকারি হয়না। প্রত্যন্ত এলাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয় পায়না এমপিওভূক্তির সুবিধা। নেই ভবন, খাবার পানি কিংবা টয়লেট সুবিধা। প্রান্তের শিক্ষার মান উন্নয়নে নজর পড়ে না সরকারের। ফলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকছে এই জনপদ।   



প্রত্যন্ত এলাকার এ বিদ্যালয়টি সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ দেখতে পায়, একটি টিনশেড ঘরে চলছে বিদ্যালয়ের সব কাজ। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে নেই কোনো পার্টিশন। বিদ্যালয়ের ভেতরে খুঁটি পুঁতে তার ওপর তক্তা লাগিয়ে বানানো হয়েছে বেঞ্চ। এরপরও বসার স্থান সংকটের কারণে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে হয় দুই শিফটে। টিনশেড ঘরের এক প্রান্তে তিনখানা চেয়ার পেতে শিক্ষকদের বসার জায়গা করা হয়েছে।

বিদ্যালয়ের সামনে রাস্তার পাশে কলাগাছের শহীদমিনার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। শিক্ষক-ছাত্রদের উদ্যোগে অন্যান্য বছরের মতো এবারও এক টুকরো খালি জায়গা পরিষ্কার করে কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার বানানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের ছাপ এখনও স্পষ্ট। সীমিত আয়োজনে এ বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানও হয়। তবে এজন্য সাহায্য-সহযোগিতা মেলে সামান্যই।

বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগের সুরে বলেন, ‘সরকার মোগো টিফিনের বিস্কুট দেয়। হেই বিস্কুট খাইয়া মোরা পানি পাইনা। স্কুলে নাই টয়লেট। শিক্ষার ওপর সরকার এতো গুরুত্ব দেয়। মোরা তো সুফল পাই না। ’

বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে উপস্থিত হন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম হাওলাদার। তিনি বাংলানিউজকে জানালেন, প্রত্যন্ত এই এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯১ সালে। চারজন শিক্ষক দিয়ে পরিচালিত এ বিদ্যালয়ে পাশের হার শতভাগ। তারপরও বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ হয়নি। ফলে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না।



বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, নিজেরা কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি বলে লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝি। সে কারণেই এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি। বেতন না পেলেও একটা ভাল কাজের তৃপ্তি রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানালেন, বিদ্যালয়ের জন্য ৪৫ শতাংশ জমি রয়েছে। জমিদানসহ স্থানীয়দের অর্থায়নে স্কুল ঘরটি তৈরি করা হয়েছে। ৬০ ফুট লম্বা ও ১৫ ফুট চওড়া ঘরে চলছে সব কাজ। সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সময় আবেদন করা হলেও কোনো সাহায্য মেলেনি।           

এদিকে রাঙ্গাবালী উপজেলার যোগাযোগ বিছিন্ন দুর্গম চরমোন্তাজ ইউনিয়নের লক্ষ্মীবেষ্টিন আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি নয় বছরেও এমপিওভুক্ত হয়নি। বিদ্যালয়েল শিক্ষকরা বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বিদ্যালয় সূত্র বলছে, লক্ষ্মীবেষ্টিন আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্গম এবং দারিদ্র্যপীড়িত চরাঞ্চলের বঞ্চিত ছেলে/মেয়েদের শিক্ষিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিনে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও নোরাড এর আর্থিক সহায়তায় ফিমেল সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাসিসট্যান্ট প্রজেক্টের আওতায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা জানান, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রায় তিন বছর ধরে প্রকল্প থেকে ৮ জন শিক্ষক-কর্মচারির বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। এরপর প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারি ৬ বছর ধরে বিনা বেতনে পাঠদান করিয়ে আসছে। বর্তমানে বেতন ভাতা না পেয়ে তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।

চরমোন্তাজ ইউনিয়নের প্রায় ১২টি গ্রামের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়টিতে লেখাপড়া করছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাধিক। উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই বিদ্যালয়টি ২০১২ সালে ফলাফলের দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থান করে। ২০১৩ সালে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট  (জেএসসি) পরীক্ষায় ২৪ জন ছাত্রছাত্রী অংশ নিয়ে সবাই উত্তীর্ণ হয়। কোনো কারণে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে এ জনপদের শত শত ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বিদ্যালয়টি টিকে আছে।

এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মাদ সোলায়মান বলেন, বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে আমরা বেতন-ভাতা পাচ্ছিনা। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হলে লেখাপড়ার মান উন্নত হবে, শিক্ষার্থীরা আরো ভালো ফলাফলে করবে।
 
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি এ কে আবু সামছুদ্দিন (আবু মিয়া) বলেন, বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় খুব সমস্যা হচ্ছে। শিক্ষকরা বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

রাঙ্গাবালী উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে নিযুক্ত গলাচিপা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, এটা বাংলাদেশ সরকার জানেন। এটা সরকারের ব্যাপার। আমরা কিছু যানিনা।

এ ব্যাপারে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়নুল আবেদীন বলেন, আমি বিদ্যালয়টি সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি। ওই বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হওয়া উচিত। এবং বিদ্যালয়টি যাতে খুব দ্রুত এমপিওভুক্ত হয় সে জন্য আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।

বাংলাদেশ সময়: ০২৫০ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।