ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

সাপের পরিচর্যায় দিন কাটে হিমেলের

এসএমএ হাসনাত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৫
সাপের পরিচর্যায় দিন কাটে হিমেলের ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খবরটা অত্যন্ত গোপন ছিল! কিন্তু গ্রামে ঢোকার পর বুঝলাম গোপন আর গোপন নেই। ‘হিমেলদের বাড়ি’ কোন দিকে-জানতে চাইলে জনৈক উৎসুক গ্রামবাসীর পাল্টা প্রশ্ন ‘ওহঃ! সাপের খামার দেখতে এসেছেন?’ বাড়িটির দিক নির্দেশনা নিলাম।

এখন কোনো আগন্তুক এই গ্রামে এলে গ্রামবাসী ধরেই নেয়, তিনি সাপের খামারে যাবেন।

হালকা-পাতলা গড়নের হিমেলকে দেখে মনে একটু ধাক্কা খেলাম। সদ্য কৈশোর পার করা এক যুবক। পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গী সাংবাদিক বদরুল আলম চৌধুরী। পরিচয় জানতে পেরে আপন মনে কি যেন ভেবে হাতটি বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।

সঙ্গী সাংবাদিক বললেন, আমি ও হিমেল নাদামপুর স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুলে থাকতেই একটু ভাবুক টাইপের ছেলে ছিল সে। কিন্তু তার মাথায় ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগের চিন্তা ঘুরপাক খেতো। তা কিন্তু জানতাম না।

হিমেলের পুরো নাম ওবায়দুর রহমান হিমেল। তার পিতা মুজাহিদুর রহমান, পেশায় স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর মাতা জোবেদুন নাহার, একজন গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়।

সাপের খামার করবে-এ কথায় প্রথমে সায় দেননি তার মা। হিমেলের ভাষায়, মাকে একবার গভীর রাতে এনিমেল প্লানেট টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সাপের খামারের ডকুমেন্টারি দেখ‍াই। তিনি আশ্বস্ত হলেও সহজাত স্বভাবসুলভ আচরণে অজানা আতঙ্কে সর্বদা শংকিত ছিলেন। কিন্তু বাবা বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। এখন পরিবারে সবারই সহযোগিতা পাচ্ছি।

সাপের খামারের চিন্তা মাথায় কিভাবে এলো- এই প্রশ্নের উত্তরে হিমেল জানান, ২০০৮ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে সাপের খামার সম্পর্কে নিবন্ধ পড়ে উৎসাহ বোধ করি। ২০১৩ সালে আমাদের দেশে বাইরে থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরির জন্য ১৪ হাজার কোটি টাকার সাপের বিষ আমদানি করা হয়- এমন তথ্য জানার পর সাপের খামার করার চিন্তাটা মাথায় আসে।

আমরাও পারি ওষুধ শিল্পের জন্য সাপের বিষ উৎপাদন করতে। এসময় সাপ নিয়ে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ফিল্ম কিংবা ইন্টারনেটে ব্যাপক পড়াশুনা করি। খামার ব্যবস্থাপনা, বিষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, সাপের প্রজনন, পরিচর্যা সম্পর্কে জানতে থাকি। পাহাড়ের সাপ সংগ্রহকারী সাপুড়েদের সাথে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করি। পরবর্তীতে বাবাকে সঙ্গী করে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল কোবরা ভেনম’ নামে একটি বিষধর সাপের খামার গড়ে তুলি।  

হিমেল বলতে  থাকেন, প্রথমের দিকে গ্রামবাসী তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। সাপুড়ে, বেদে বলে ডাকতো। এমনও কথা শুনতে হয়েছে ‘শেষ পর্যন্ত সাপের ব্যবসা করতো হলো’। সেই সাথে ছিল কুসংস্কারের ভয়াল থাবা। কিন্তু এখন দেখেন, সবাই আমার সাথে।

উৎসুক জনতার ভিড়ের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এটা একদিনে হয়নি। বেশ কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে।   এলাকায় এখন আর কেউ সাপ মারে না। কারও বাড়িতে সাপ ধরা পড়লে আমাদের খবর দেয়। আমরা গিয়ে সাপটি উদ্ধার করে খামারে নিয়ে আসি।

গ্রামে কারো বাড়িতে সাপ আছে-এমন সংবাদ পেলেই ছুটে য‍াই। পরে সেই বাড়ির বাসিন্দাদের সহযোগিতায় তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসি খামারে।

মূলতঃ মানুষের হাত থেকে বিপন্ন সাপকে বাচাঁতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন হিমেল। ফলে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘সর্পপ্রেমী মানুষ’ হিসেবে।

কোবরা, শঙ্খিনী জাতের দেশি জাতের সাপ নিয়ে গড়ে তুলেছেন খামারটি। প্রতিদিন সাপের খাবার সংগ্রহ, সময়মতো সাপের খাবার দেয়া, সপ্তাহান্তে সাপের বাক্স পরিষ্কার করা, পরিষ্কার পানি দিয়ে সাপের শরীর ধোয়ার কাজ করতে করতেই তার দিন পার হয়ে যায়।

খামারে বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর গোখরা সাপ রয়েছে। একেকটি প্ল্যাস্টিকের খাঁচার মধ্যে একটি করে সাপ পালন করা হচ্ছে। খামারের বেশির ভাগ সাপই স্থানীয়ভাবে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

কিন্তু সাপের খামারের উদ্যোক্তা হিমেলের কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হচ্ছিল সরকারি সিদ্ধান্তহীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা। সাপের খামার স্থাপনকারীদের জন্য সরকারের তহবিলে জাতিসংঘের দেয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা থাকলেও সামান্য সহযোগিতা তো দূরের কথা, পদে পদে হতে হচ্ছে অপদস্থ।

পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে খামারের অনুমোদন ও লাইসেন্সের জন্য এখনও ঘুরছি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন হিমেল।

বিশেষ করে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের কথা। সাপের প্রধান খাদ্য ব্যাঙ ধরে ধরে খাওয়ালে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে-এ আশংকায় কর্মকর্তারা কেউ রাজি হচ্ছিলেন না অনুমোদন দিতে। কিন্তু হিমেল তাদের বুঝালেন, তিনি নিজেই বিশেষ কৌশলে ব্যাঙের প্রজনন বৃদ্ধি করে নিকটস্থ জলাশয়ে ব্যাঙের সংখ্যা বাড়াবেন। এখন কর্মকর্তারাও খুশী!

সাপের বিষ বিদেশে রপ্তানির জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সরকার বেসরকারি উদ্যোগে সাপের বাণিজ্যিক খামার স্থাপনের জন্য ২০টি শর্ত দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।

হিমেল তার সাপের খামারটি নিবন্ধনের জন্য গত বছর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। এখন পর্যন্ত খামারটি নিবন্ধন করা হয়নি। সম্প্রতি সাপ খামারী ও খামার নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সাপ খামারীরা সাপের খামার স্থাপন করতে পারবে; কিন্তু বিষ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিক্রয় করতে পারবে না।

এখন হিমেলের খামারে স্থায়ী-খণ্ডকালীন কর্মী মিলিয়ে আছেন সাতজন। খামার ও বিষ সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিনারিজ কিনতে প্রয়োজন অর্ধ কোটি টাকার মতো।

সারাবিশ্বে ২০০৮ সালে পাঁচ হাজার ৭৭৫ কেজি সাপের বিষের চাহিদা ছিলো। প্রতিবছর সেটা পাঁচভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি বছরে আট হাজার ১২৬ কেজি চাহিদা রয়েছে। এই হারে চাহিদা বাড়তে থাকলে ২০২২ সালে তা দাঁড়াবে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকায়।

হিমেল গর্ব করেই বলছিলেন, আমার দেশ সেরা। কারণ আমাদের দেশের মাটি, আবহাওয়া সবই সাপের খামার গড়ে তোলার জন্য দারুণ উপযোগী। কিন্তু পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশে খামার তৈরি ও আবহাওয়া উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে প্রচুর খরচ করতে হয়।

খামার থেকে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার বিষ উৎপাদন করা সম্ভব বলে তরুণ এই উদ্যোক্তা জানিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় বিষ উৎপাদনসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারছেন না তিনি।

সাপ ধরতে ও পালন করতে লাঠি, টং, হাত মোজা, গ্ল্যাভস, পায়ে বড় বুট ব্যবহার করা হয়। বিষধর এই সাপ নিয়ে খেলা জীবনের সঙ্গে বড় বাজি। যখন তখন ঘটতে পারে মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা। তাই জেলার হাসপাতালে দরকার সাপের কামড়ের এন্টি ভ্যাকসিন।

হিমেল বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অনান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সাপের খামার করে বিষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা অনেক সহজ। এতে খরচও অনেক কম। সরকারের সহযোগিতা ও খামারের নিবন্ধন পেলে আমরা এ সাপের খামারের বিষ সংগ্রহ করে দেশের ওষুধের চাহিদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবো। পাশাপশি অর্জন করতে পারবো বৈদেশিক মুদ্রা।

সাপ দেখতে প্রায় প্রতিদিনই খামারটিতে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। কোন সাপ বিষাক্ত, সাপ ছোবল দিলে কি করা উচিত, কিভাবে বাঁধন দিতে হয় ইত্যাদি ব্যাপারে ধারণাও পাচ্ছেন এসব মানুষ।

মানুষের বর্বরতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর বনজঙ্গলের অভাবে প্রায় বিলুপ্তির পথে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। এসব বিবেচনায় এ ধরনের খামার একদিকে যেমন সাপ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে, তেমনি এর বিষ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে।

লেখকঃ সংবাদ কর্মী ও উন্নয়ন কর্মী, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৫
জেডএম/

** কবুতর পালনে স্বাবলম্বী ইঞ্জিনিয়ার সামাদ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।