ঢাকা, সোমবার, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

ন্যাড়া পাহাড়-উপকূলে সবুজায়ন

মহিউদ্দিন মাহমুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
ন্যাড়া পাহাড়-উপকূলে সবুজায়ন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: নির্বিচারে গাছকাটা, অপরিকল্পিত বনজসম্পদ আহরণ, পাহাড়কাটা, অবাধে বন্যপ্রাণী হত্যাসহ নানান কারণে বাংলাদেশের বনভূমি উজাড় হচ্ছে। হারানো বন, বন্যপ্রাণীদের ফিরে পেতে কাজও চলছে।

সবুজায়নে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে অনেক বন।

সম্প্রতি, চট্টগ্রামের চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কক্সবাজারের ইনানী সংরক্ষিত বন এলাকা, শীলখালী গর্জন সেম্পল প্লট, নুনিয়ারছড়া ম্যানগ্রোভ বন, টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, টেকনাফের ম্যানগ্রোভ বন, মহেশখালী উপজেলার  সোনাদিয়া দ্বীপ, মহেশখালী ম্যানগ্রোভ বাগান এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে।

গাছ, পাহাড়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আন্তরিকতা, সৃষ্টিশীল উদ্যোগ, কঠোরভাবে অপরাধ দমনের পাশাপাশি স্থানীয়দের বিকল্প কর্মসংস্থান, সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে সফলতার কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কাজে আরো গতি ও ব্যাপকতা একান্তভাবে প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করছেন।

চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
১৪ সেপ্টেম্বর সোমবার। দুপুর গলিয়ে সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক থেকে নেমে সুনশান নীরবতার মধ্যে চুনতি অভয়ারণ্যে প্রবেশ করছি। বনের যতই গহীনে যাচ্ছি, ততই অন্য রকম একটা ভালোলাগা অনুভূতি কাজ করছে। যেদিকে চোখ যায়, যতদূর; মনে হয়, সবুজের সমুদ্র।

চুনতি অভয়ারণ্যটি চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও লোহাগাড়া এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার ৭টি ইউনিয়ন চুনতি, আধুনগর, হারবাং, পুঁইছড়ি, বাঁশছড়ি, বাঁশখালী, বড়হাতিয়া এবং টইটং জুড়ে বিস্তৃত।

১৯৮৬ সালে ৭ হাজার ৭৬৪ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি নিয়ে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এ বনাঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাণী এশীয় হাতি। এছাড়া বন্যশুকর, বানর, হনুমান, মায়া হরিণ, সাম্বারসহ অন্যান্য প্রাণী দেখা যায়। উদ্ভিদের মধ্যে গর্জন, চাপালিশ, বাঁশ, বেত উল্লেখযোগ্য।

এক জরিপ অনুযায়ী, এ অভয়ারণ্য এলাকায় ১৬০ প্রজাতির পাখি, ৯৮ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী, ৩৩ প্রজাতির সরীসৃপ, ২২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৩ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ৬৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়।

১৯৮৬ সালে এটি অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হলেও অবৈধভাবে গাছকাটা, পাহাড়কাটা, জনবসতি স্থাপনের ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ অভয়ারণ্য। এ এলাকায় ৬ হাজার মানুষের আবাস।

বন বিভাগ স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে এ বন রক্ষার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে নতুন করে সবুজায়নের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে।

বনজ সম্পদের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি স্থানীয়দের নিয়ে কম্যুনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ (সিপিজি) গঠন করে সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ অভয়ারণ্য রক্ষার চেষ্টা করছে বন বিভাগ। সিপিজি’র মাধ্যমে বন পাহারা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি বিকল্প উপার্জনের উপকরণও দিচ্ছে বনবিভাগ। বনবিভাগকে এ কাজে সহযোগিতা করছে বেসরকারি সংস্থা আইপিএসি, জিআইজি, আরণ্যক ফাউন্ডেশন ও ইউএসএআইডি।

বনবিভাগের দাবি, সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তারা মানুষকে বন উজাড়করণ থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। একই সঙ্গে এ মানুষগুলোকে বন রক্ষার কাজে লাগাতে পেরেছেন।

সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে উপকারভোগী মরিয়ম আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আগে আমরা বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর ছিলাম। এখন আমরা বিকল্প কাজ করে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমরা বুঝতে শিখেছি, এটা আমাদের বন, এ বন ধ্বংস করার জন্য নয়।

সহব্যবস্থাপনা এমন একটা পদ্ধতি, যেখানে স্থানীয়দের নিয়ে বন পাহারা দেওয়া হয়, তাদের সচেতন করা হয়; বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি, বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়।

এখানে ভিসিএফ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে জিআইজেড কর্তৃক ৬০ হেক্টর এবং নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পে ১৩০ হেক্টর সামাজিক বনায়নের কাজ চলছে।

চুনতি সহব্যবস্থাপনা কমিটির কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে ইকুয়েটর পুরস্কারে ভূষিত হয়।

ইনানী রক্ষিত বনএলাকা
পরের দিন ১৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। সকালে কক্সবাজার থেকে সমুদ্র সৈকত ধরে আমরা টেকনাফের দিকে রওয়ানা হলাম। সমুদ্রের গর্জন, বাতাসের শব্দ, চোখ জুড়ানো, হৃদয় মাতাল করা দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ইনানী রক্ষিত বন এলাকার সোয়ানখালীতে আসলাম। সোয়ানখালী দিয়ে বনের ভেতরে যেতে থাকলাম।

পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা এ বন। বিশাল এলাকা জুড়ে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে সবুজে ঢেকে দেওয়া হয়েছে এক সময় বন উজাড় হয়ে যাওয়া পাহাড়গুলোকে। একটা উঁচু পাহাড়ে উঠলে দূরে দেখা যায় প্রাকৃতিক বন।

১০ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে ইনানী সংরক্ষিত বন। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার হেক্টরকে বাফার জোন হিসেবে রাখা হয়েছে সামাজিক বনায়নের জন্য। বাকি এলাকা প্রাকৃতিক বন হিসেবে থাকবে।

বন সংরক্ষণ ও নতুন করে বনায়নের জন্য এখানেও সহব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

বনবিভাগ জানায়, ইনানী রক্ষিত বনাঞ্চলে ১৩৬৫ হেক্টর এলাকায় দেশিয় প্রজাতির চারা রোপন করে বন সমৃদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ১১০ হেক্টর ন্যাড়া বন এলাকা (উজাড় হয়ে যাওয়া বন) সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করা হয়েছে।

বনবিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এখানকার ন্যাড়া পাহাড়ে সবুজ বিপ্লব হয়েছে। একই সঙ্গে বন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শীলখালী গর্জন সেম্পল প্লট ও টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
সোয়ানখালী থেকে টেকনাফের দিকে আরো এগিয়ে গেলে শীলখালী গর্জন সেম্পল প্লট। ধ্বংসের পথে চলা শীলখালী গর্জন সেম্পল প্লটকেও সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রক্ষার কাজ করছে বনবিভাগ।

গর্জন বনকে রক্ষা করতে বিদ্যমান গর্জন গাছগুলোকে রক্ষার পাশাপাশি নতুন করে গর্জনসহ বিভিন্ন গাছের চারা রোপন করা হয়েছে।

নাফ নদীর কোল ধরে আরো সামনে এগুলো টেকনাফ বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। ঘুরে দেখা গেছে, এখনেও সহব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন রক্ষা ও বন সৃজনের কাজ চলছে।

২৮ হাজার ৬৮৮ একর বনভূমি নিয়ে টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এখানে ৫৩৬ প্রজাতি উদ্ভিদ ও ৬১৩ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।

বন বিভাগ জানায়, বন্যপ্রাণীর মধ্যে এশিয়ান হাতি, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, গন্ধ গোকুল, সজারু, শিয়াল, বন্য শুকর, বানর, হনুমান, ধনেশ পাখি, কাঠঠোকরা উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া উদ্ভিদের মধ্যে গর্জন, তেলশুর, চাপালিশ, সিভিট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বিকেলে নাফ নদীতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর রাতে আবার কক্সবাজার ফিরে আসলাম।

নুনিয়ারছড়া ম্যানগ্রোভ বন
৪০০ একরের নুনিয়ারছড়া ম্যানগ্রোভ বন। এখানে সংরক্ষিত বনের পাশাপাশি নতুন করে গাছ লাগানো হয়েছে এখানে। কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিবেশ সংরক্ষণ কেন্দ্র। প্রতিবেশ সংরক্ষণ কেন্দ্রের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ তৈরি করা হয়েছে মিউজিয়াম।

সোনাদিয়া দ্বীপ
১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার সকালে স্পিড বোর্ডে সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশে কক্সবাজার ছাড়লাম। বাঁকখালী নদী মহেশখালী চ্যানেল দিয়ে এগিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশে চলতে থাকলাম।

বাঁকখালী নদী ও মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় ঢেউগুলো তুলনামূলক একটু বড় ছিল। দারুন একটা অনুভূতি কাজ করছিল সবার মধ্যে।

ম্যানগ্রোভ বনের মধ্য দিয়ে আমরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সোনাদিয়া দ্বীপে পৌঁছালাম। দারুন একটা দ্বীপ! অনেকটা সেন্টমার্টিন দ্বীপের মতো।

দ্বীপে নেমেই সমুদ্র সৈকতে চলে এলাম। ঝাউবন, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে হারিয়ে গেলাম।

স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ১০ বছর ধরে তাদের বাপ-দাদারা এ দ্বীপে থাকছেন। দ্বীপে ১ হাজার ৭০০ লোক আছেন; যাদের প্রায় সবাই জেলে। সমুদ্রে মাছ ধরেন তারা।

১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রশস্ত সৈকত, সৈকত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ঝাউ গাছ, সুউচ্চ বালিয়াড়ি। এ দ্বীপটিকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্বীপে ঝাউ গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে।

পথে মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরঘাটে নামলাম। বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানান,  এখানে সংরক্ষণ ও নতুন করে বনায়নের মাধ্যমে ১৬ হাজার একর বন সৃষ্টি করা হয়েছে।

সহকারী বন সংরক্ষক রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রমসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সবুজায়ন করা হচ্ছে। ন্যাড়া পাহাড়ে সবুজ বিপ্লব হয়েছে। শুধু নতুন করে গাছ লাগানোই নয়, বিদ্যমান বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণও করা হবে।

উপ-বনসংরক্ষক আর.এস.এম. মুনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, উপকূলের বন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষকে রক্ষা করে। উপকূলের অনেক বন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমরা নতুন করে গাছ লাগানোর পাশাপাশি উপকূলীয় বন সংরক্ষণ করছি।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক মো. মকবুল হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের প্রয়োজনে বনকে রক্ষা করতে হবে। যদি সুরক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে বন নিজে নিজেকে তৈরি করে নেয়। উজাড় হওয়া বনে নতুন করে গাছ লাগানোর পাশাপাশি আমরা বিদ্যমান বনকে সুরক্ষিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

সহব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করলে বেশি ফল পাওয়া যাবে। সহব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনেক বেশি কার্যকর। আমরা এ থেকে সুফল পাচ্ছি।

সংরক্ষিত বনায়ন রক্ষায় অপরাধ দমনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
এমইউএম/এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।