ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বইমেলা

জনস্রোতে মুখরিত বইমেলা

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
জনস্রোতে মুখরিত বইমেলা ছবি: রাজীব/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: স্রোতের মতো ছুটে আসছে মানুষ। ঠিকানা অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

শুক্রবারের সব পথ মিশে গেছে যেনো ১৯তম দিনের মেলায় এসে।

ছুটির এ দিনটিতে বইমেলার দুয়ার সকালে খুললেও শুরুতেই এতোটা ভিড় ছিলো না। বেলা যতো গড়াতে থাকে ভিড়ও বাড়তে থাকে। দুপুরের পর থেকে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না মেলা প্রাঙ্গণে! লেখক, পাঠক, প্রকাশক আর সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষের মহামিলনমেলায় পরিণত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এ দু’প্রাঙ্গণে ছিলো জনপ্লাবন। বানের স্রোতের মতো ছুটে এসেছে মানুষ।

সন্ধ্যার পর মেলায় দর্শনার্থীর ভিড় ছিলো লাগামছাড়া। একপর্যায়ে একাডেমি প্রাঙ্গণের প্রবেশমুখে স্থাপিত আর্চওয়ে দিয়ে প্রবেশ করাই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় থেকে পাশাপাশি দু’টি লাইন এসে থামে মেলার দুই প্রবেশমুখ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। অনেকেই অভ্যাসবশত প্রথমেই ঢুকে যান একাডেমি প্রাঙ্গণে। এখানে ঘুরেফিরে যারা বই কিনতে আগ্রহী তারা ছুটে যান উদ্যান অংশে, যেখানে নতুন বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশকরা।
 
কয়েকটি পরিবারকে দেখা গেছে খাবার নিয়ে মেলায় আসতে। উদ্যানের এক প্রান্তে মাঠে মাদুর বিছিয়ে তারা দুপুরের খাবার মেলাতেই সেরেছেন। তারপর আবার শুরু করেছেন মেলা ঘুরে ঘুরে বইকেনা।

বিকেলে মেলার উদ্যানে কথা হয় সাংবাদিক ও লেখক তুষার আবদুল্লাহ'র সঙ্গে। মেলার মূল্যায়ন জানতে চাইলে বলেন, এবার উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে মেলার পরিসর বেড়েছে। অনেক মানুষ এসেছে... তবুও স্বস্তিতে মানুষ বই কিনতে পারছে।

শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এদিন আগের দিনগুলোর মতোই সকাল ১১টায় খুলে দেওয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। তবে এর আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ভেসেছিলো সুরের মূর্ছনায়। সকাল ১০টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে অতিথি ছিলেন বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী। বিচারক হিসেবে ছিলেন শিল্পী কল্যাণী ঘোষ, সুজিত মোস্তফা ও আবু বকর সিদ্দিক। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় প্রথম হয়েছেন তাহসিন রহমান, দ্বিতীয় হয়েছেন সুদীপ দত্ত অহন ও তৃতীয় হয়েছেন ফাবিহা লামিছা তাহা। খ-শাখায় প্রথম হয়েছেন নিপা আক্তার মীম, দ্বিতীয় হয়েছেন অগ্নিতা শিকদার মুগ্ধ ও তৃতীয় হয়েছেন নামিরা মুশকান (শান্তনা)।

‘যে দীপ জ্বেলেছিল দীপন’
বইমেলায় মানুষের ঢল আর উৎসবমুখর পদচারণার ভিড়েও ছিলো শোকের আবহ। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত কালো ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। সেখানে জাগৃতি প্রকাশনের সত্বাধিকারী দীপনের উজ্জ্বল ছবির ওপর লেখা ছিলো, ‘যে দীপ জ্বেলেছিল দীপন’।

কিছুদিন আগে উগ্রবাদীদের চাপাতির কোপে প্রাণ যায় দীপনের। সে শোকেই দীপনের ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন ঢাকা কলেজের বন্ধুরা গঠন করেছেন ‘দীপন স্মৃতি সংসদ’। তারাই অনেকগুলো ব্যানার টাঙিয়ে দেন বইমেলা প্রাঙ্গণে।

বইমেলায় তথ্যমন্ত্রী
চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদফতরের প্রকাশিত আনম আমিনুর রহমানের ‘বাংলাদেশের বন্য প্রাণী’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালক লিয়াকত আলী খান, বন ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক খোরশেদ আলম, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহবুবার রহমান।

হাসানুল হক ইনু বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করেই করতে হবে। বইটিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার নানা উপকরণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে এ বইটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

পিতা-পুত্রের বই
শুক্রবার মেলায় এসেছে কবি আমিনুর রহমান সুলতান ও তার পুত্র সিজন নাহিয়ানের দু’টি বই। আশির দশকের অন্যতম কবি আমিনুর রহমান সুলতান। কবিতা তার নিত্যসঙ্গী হলেও প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য, নাটক ও শিশুসাহিত্যেও রয়েছে তার পদচারণা। এদিন ‘পুথিনিলয়’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে শিশু-কিশোর উপযোগী বই ‘বাড়ির নাম ৩২ নম্বর’। বইটিতে জানা যাবে, কীভাবে ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি ৩২ বাড়িতে পরিণত হল। জানা যাবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এই বাড়ির অজানা অনেক স্মৃতিকথা। লিপি প্রকাশন এনেছে সিজন নাহিয়ানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘একাকিত্বের রঙ’।

বইপোকাদের মিলনমেলা
বিকেলে বইমেলার অদূরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন প্রাঙ্গণে ছিলো বইপ্রেমী পাঁচ শতাধিক মানুষের মিলনমেলা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয় গ্রুপ ‘বইপোকারদের আড্ডাখানা’ ও অনলাইন বুকশপ সর্বনাম ডট কমের যৌথ আয়োজনে মনোজ্ঞ এ আয়োজন।
 
এতে বইপোকা গ্রুপের সারাদেশের সক্রিয় কর্মীরা বই ও সাহিত্যনির্ভর নানা আলোচনায় মেতে ওঠেন। আলোচনা ও আনন্দ আড্ডা শেষে বইপোকাদের আড্ডাখানা ও সর্বনাম ডট কমের মাসব্যাপী বুক রিভিউ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে অটোগ্রাফসহ বই তুলে দেন কথাসাহিত্যিক পলাশ মাহবুব।

১৯তম দিনে ২৩৬টি বই
বাংলা একাডেমির তথ্যমতে শুক্রবার মেলায় এসেছে ২৩৬টি বই। এর মধ্যে গল্প ৩৪, উপন্যাস ৪০, প্রবন্ধ ১০, কবিতা ৫৪, গবেষণা ৩, ছড়া ৫, শিশুতোষ ৯, জীবনী ৬, রচনাবলী ১, মুক্তিযুদ্ধ ৯, বিজ্ঞান ৭, ভ্রমণ ৪, ইতিহাস ৬, রাজনীতি ১, চিকিৎসা ১, রম্য ৫, ধর্মীয় ৪, অনুবাদ ৩, সায়েন্স ফিকশন ৩ ও অন্যান্য ৩১।

উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে অনন্যা থেকে আল মাহমুদের ‘সাহসের সমাচার’, অবসর থেকে হাসান ইকবালের ‘ভাষা নারী ও পুরুষপুরাণ’, আগামী থেকে ড. চিত্তরঞ্জন দাসের ‘ভিক্টোরিয়া থেকে নায়াগ্রা: জানা-অজানার পথে পথে’, সুবর্ণ এনেছে আলী ইমামের ‘চিরকালের গল্প’, কাকলী এনেছে রকিব হাসানের ‘উইন্ডি উডের রহস্য’, ঐতিহ্য এনেছে ড. সুলতানা জেসমিনের ‘বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও নারী শিক্ষা’, কথাপ্রকাশ এনেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘চীনে আমরা পাঁচজন’, চন্দ্রদ্বীপ এনেছে আহসান হাবীবের ‘কমিক্স পটলা কেবলা’, শামীম পাবলিশার্স এনেছে সেলিনা হোসেনের ‘ যখন বৃষ্টি নামে’, ‘মিহিরুনের বন্ধুরা’, ইতিপ্রকাশন এনেছে আনিসুল হকের ‘গল্পের জালি’, অনুপম প্রকাশনী এনেছে আব্দুল্লাহ আল মুতীর ‘রচনাসমগ্র: বিচিত্র বিজ্ঞান’, বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে মফিদুল হকের ‘ভ্রমণ কথা সমাজ কথা’, অন্যপ্রকাশ এনেছে নাসরিন জাহানের ‘নিঃসঙ্গতার পাহারাদার’, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স এনেছে আসাদ চৌধুরীর ‘ স্মৃতির শেকড় ও ডানা’, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ এনেছে ‘ত্রিপুরার বাংলা কবিতা’, জোনাকী প্রকাশনী এনেছে রবীন্দ্র গোপের ‘মুজিব আমার অন্তরে বাহিরে’, চন্দ্রছাপ এনেছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘তোমাদের জন্য ছড়া’, নবরাগ প্রকাশনী এনেছে আসফউদ্দৌলা ‘দুদিনের দিনলিপি’, দোয়েল প্রকাশনী এনেছে আলমগীর খোরশেদের কবিতার বই ‘চন্দ্রমুখী’।

মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘রাধারমণ দত্ত: মৃত্যুশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শুভেন্দু ইমাম। আলোচনায় অংশ নেন মাহফুজুর রহমান, বিশ্বজিৎ রায় ও নৃপেন্দ্রলাল দাশ। সভাপতিত্ব করেন কবি মোহাম্মদ সাদিক।

প্রাবন্ধিক বলেন, প্রথম জীবন থেকে রাধারমণ তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিলেন। সহজিয়া মতের প্রতি অনুরাগ পিতার সূত্রে বাল্যকালেই লাভ করেছিলেন। সহজিয়ারা মনে করেন তাদের সম্প্রদায়ের আদিগুরু রূপ গোস্বামী। কৃষ্ণ বৃন্দাবনে যে রকম মধুর লীলা প্রকাশ করেন তার অনুকরণ করে মুক্তিলাভ করা  এই সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য।

তিনি আরও বলেন, রাধারমণ সহস্রাধিক বাউল সঙ্গীত রচনা করেছেন। এর কিছু মুদ্রিত আছে। তার বৈশিষ্ট্য ছিলো, যখন তিনি ভাবাবিষ্ট হতেন, তখন তিনি সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন। তার শিষ্যেরা সঙ্গীতগুলো মুখস্থ করে নিতেন।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সিদ্দিকুর রহমান পারভেজের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ ও হাসান আরিফের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘শ্রুতিঘর-এর শিল্পীরা অংশ নেন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আকবর আলী সাঁই, দেলোয়ার হোসেন বয়াতি, অমিয় বাউল, পাগলা বাবলু খান, রুশিয়া খানম, রাফসান বাউল, বাউল মিলন, আমজাদ দেওয়ান, জামাল দেওয়ান, বিমল বাউল ও রকিবুল ইসলাম রাকিব।

শনিবারের আয়োজন
শনিবার মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় ও চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেবেন বদিউর রহমান, গোলাম কুদ্দুছ ও শুভাশিস সিনহা। সভাপতিত্ব করবেন কামাল লোহানী। এছাড়া প্রতিদিনকার মতো সন্ধ্যায় রয়েছে নাচ-গান-কবিতা আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি  ১৯, ২০১৬
এডিএ/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad