ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বইমেলা

গ্রন্থমেলার ১২তম দিন

ছুটির দিনে বইমেলা, পারিবারিক মিলনমেলা

সাজেদা সুইটি ও সৈয়দ ইফতেখার আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
ছুটির দিনে বইমেলা, পারিবারিক মিলনমেলা ছবি: দীপু মালাকার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: খেলনা-চুড়ির মেলা নয়, বাহারি নানা পণ্য নয়, সুস্বাদু খাবারের পসরাও নয়। কেবল বই আর বই, হরেক স্বাদের বই।

বইমেলাও যে পারিবারিক উপভোগ্য-আয়োজন হতে পারে সে প্রমাণই যেনো পাওয়া গেলো পুরো দিনটিতে।
 
শুক্রবার মেলার ১২তম দিনটি (১২ ফেব্রুয়ারি) যেনো হয়ে ওঠে পারিবারিক মিলনমেলা। শত পরিবারের প্রাণবন্ত আনাগোনা-কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে প্রাণের মেলা।
 
মেলার ফটক খোলার অপেক্ষা অবশ্য সেভাবে করতে হয়নি এদিন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকেই প্রাঙ্গণে কার্যক্রম শুরু। সকালে শিশুপ্রহর থাকায় বিরতিতেও মেলা ঘুরেছেন অনেকে।
 
বিকেলে যথারীতি মেলার শুরুতে টিএসসি-দোয়েল চত্বরের এমাথা-ওমাথায় দেখা যায় বইপ্রেমীদের জোয়ার। টানা পাঁচটি ঘণ্টা থাকলো ছুটির দিনের উপচে পড়া ভিড়।
 
৭২ বছর বয়সী মা হাজেরা খাতুন ও শিশুকন্যা শবনম সোহেলীকে নিয়ে সস্ত্রীক মেলায় এসেছেন রবিউল আলম। শনির আখড়া থেকে সকালেই এসেছেন তারা।
 
মা নিয়েছেন ধর্মীয় বই, স্ত্রী রান্নার, মেয়ে নিয়েছে ছড়া ও ছবির বই আর আমি নিলাম একটি অভিধান, বলেন রবিউল।
 
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে বলেন, ছুটির দিনে একটু ঘুরি আমরা। আর বইমেলা ভালো জায়গা। কয়দিন ধরেই শুনছি, এবার ভালো আয়োজন। তাই মাকেও সঙ্গে নিয়ে এলাম।
 
শনির আখড়ার আরেক দম্পতি জাহাঙ্গীর মৃধা ও রেবা এসেছেন দুই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। তাদেরও সবার নিজেদের পছন্দের বই কেনা হয়েছে। মেলার দুই অংশের মাঝখানে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। বইগুলো ব্যাগ থেকে বের করে দেখালেন। গল্প, উপন্যাস, ছড়ার বই কিনেছেন তারা।
 
ধানমন্ডি থেকে এসেছেন দুই বোন- মিথিলা ফারজানা ও রাহেলা ফারহানা। তারাও ব্যাগভর্তি বই কিনে ফিরছিলেন। বাংলানিউজকে বলেন, এ কয়েকদিন আসতে পারিনি। আজ এলাম। বারবার আসার সুযোগ হবে না। তাই বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু কিনলাম।  
 
ব্যাগে উঁকি দিয়ে দেখা মেলে- বাংলা একাডেমির অভিধান, হুমায়ূন আহমেদের দু’টি বই, আনিসুল হকের একটি ও তিনটি ছবির বই।
 
মেলায় মুহম্মদ জাফর ইকবাল
শেষ পর্যন্ত দেখা মিললো তার। এতোদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেলায় এলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই ভিড় জমে যায়।
 
তাম্রলিপি’র অদূরে দাড়িয়ে হাসিমুখে গল্প করলেন সবার সঙ্গে। এমনিতেই তার বইয়ের চাহিদা অনেক, তাকে দেখে ‘ক্রেনিয়াল’ বইটি কেনার হিড়িক লেগে যায়। বিশেষ করে, শিশুদের আনন্দ ছিলো অনেক বেশি।
 
কারও আবদার ফেলার পাত্র নন তিনি, তাই ছবি তোলায় মনোযোগীরা তাকে ঘিরে রাখেন দীর্ঘসময়।
 
এছাড়া জিএম কাদের, আব্দুল জব্বার, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ বেশ ক’জন পরিচিতজনকে ঘিরেও ভিড় দেখা যায়।
 
এদিনের নতুন বই
বাংলা একাডেমি থেকে জানানো হয়েছে, মেলার ১২তম দিনে নতুন বই এসেছে ২৮০টি। এর মধ্যে গল্পের ৪৫, উপন্যাস ৪৩, প্রবন্ধ ১৭, কবিতা ৮৩, গবেষণা ৩, ছড়া ১১, শিশুসাহিত্য ৪, জীবনী ৪, মুক্তিযুদ্ধ ১১, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ৪, ইতিহাস ২, রাজনীতি ১, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ৪, কম্পিউটার ৩, রম্য/ধাঁধা ২, ধর্মীয় ২, অনুবাদ ৫, সায়েন্স ফিকশন ১৩ ও অন্য ২০টি।
 
এদিনের নতুন বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আহমদ মনসুরের ধর্মগ্রন্থ ‘বহুবিবাহ ইসলাম ও মুহাম্মদ (স)’, কবি বাচ্চু আলীর কবিতা ‘কষ্টের কুন্ড’, রকিব হাসানের গোয়েন্দা কাহিনী ‘নরকের পিশাচ’, ‘কিশোর মুসা রবিন বেহালা চোর’, ‘কিশোর মুসা রবিন আজব ভূত’, ‘হিমছড়ি’, ‘হাসকির গর্জন’, ‘মুখোস রহস্য’, ‘কিশোর মুসা-রবিন ভুতের বাড়ির রহস্য’, ‘কিশোর মুসা-রবিন শয়তানের দ্বীপ’, ‘কিশোর মুসা-রবিন ভয়াল দুর্গ’, রহস্য উপন্যাস ‘নরবলি’, ‘বিষধর’, আনিসুল হকের গল্পগ্রন্থ ‘পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী আপনার জন্য’, রফিকুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ’, পীর হাবিবুর রহমানের উপন্যাস ‘লজ্জাবতী’, মোহিত কামালের কিশোর উপন্যাস ‘দুখু’, ফরিদা আকতারের আত্ম-উন্নয়নমূলক ‘সফল বাবা-মা’, ফজলে আহমদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প ‘ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, ‘সেলিনা হোসেনের নিঃসঙ্গতার মুখর সময়, সেলিনা হোসেনের শিশুতোষ গল্প ‘অন্যরকম যাওয়া’, গুলবদন বেগমের উপন্যাস ‘হুমায়ুন নামা’, এসএম জাকির হুসাইনের ধর্মীয় বই ‘কোরআনের আলোকে নামাজের অজানা রহস্য’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের শিশুতোষ বই ‘ইঁদুর এবং দুষ্টু হাতি’, আবুল আহসান চৌধূরী ‘লালন সাঁই ও বাঙালি সমাজ’, শামসুল আরেফীনের মুক্তিযুদ্ধের অতীত গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিল-এর অংশ ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার দুর্লভ দলিল’ প্রভৃতি।
 
সকাল-দুপুর গ্রন্থমেলা যেনো শিশুরাজ্য
এদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিলো শিশুপ্রহর।
 
এর আগে, সকাল সাড়ে ৯টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার।
 
বিচারক ছিলেন আনিসুর রহমান তনু, ইয়াকুব আলী খান ও সাগরিকা জামালী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
 
প্রতিযোগিতায় দুই শতাধিক প্রতিযোগী অংশ নেয়। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
 
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন শিশুকিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতা কমিটির আহ্বায়ক রহিমা আখতার কল্পনা।
 
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে নজরুলচর্চা: অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান। আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহীত উল আলম, কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজ এবং কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
 
প্রাবন্ধিক বলেন, বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে নজরুল-বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গুণগত মানে কয়টি গ্রন্থ কালের বিচারে উত্তীর্ণ হবে, সেটি সময় বলে দেবে। এই বাজারি সভ্যতায় নজরুলচর্চা যেনো নজরুল ব্যবসায় পরিণত না হয়, সংশ্লিষ্টদের সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। কারণ, নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, চেতনার আলোকবর্তিকা।
 
আলোচকরা বলেন, এখন সৃজনশীল অনুবাদের প্রক্রিয়ায় বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ সমন্বয়বাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম ও জীবনদর্শন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
 
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নজরুলচর্চা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বিশেষ করে নজরুলের অমর রচনাকর্ম ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, ফারসি এমনকি স্প্যানিশ-পর্তুগিজ ভাষায়ও অনূদিত হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে বাংলার নজরুল পৌঁছে যাবেন সারা বিশ্বে।
 
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীহার দে আকাশের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সুরের আলো সঙ্গীত একাডেমী’র শিল্পীরা। এছাড়াও সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী খালিদ হোসেন, লিলি ইসলাম, নাশিদ কামাল, সালাউদ্দীন আহমদ, লীনা তাপসী ও আবদুল ওয়াদুদ।
 
অনুষ্ঠানে যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন, দীপক কুমার দাস (তবলা), হাসান আলী (বাঁশি), আবু কামাল (বেহালা), ফিরোজ খান (সেতার) ও মো. আজিজুর রহমান (কী-বোর্ড)।
 
শনিবার মেলা ১১টা থেকে ৮টা
 
শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) মেলার ১৩তম দিনে।
 
গ্রন্থমেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় ও চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। অমর একুশে উদ্যাপন উপলক্ষে সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বটি।
 
প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া, নাট্যজন মাসুম রেজা ও শাহিদা খাতুন।
 
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধচর্চা: অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।
 
আলোচনায় অংশ নেবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ড. মোহাম্মদ সেলিম এবং দিব্যদ্যুতি সরকার। সভাপতিত্ব করবেন বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

** লম্বা লাইনে বাড়ছে মেলার সৌন্দর্য
 
বাংলাদেশ সময়: ২১২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
এসকেএস/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।