অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: প্রায় ফাঁকা রাজধানী, বিপরীত চিত্র কেবল প্রাণের মেলায়। ছুটির ভিড় সারি সারি হয়ে ঘুরছে মেলার এপার-ওপার।
এ চিত্র শুক্রবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ৫ম দিনের। সকাল থেকে দুপুরে শিশুপ্রহর, বিকেল থেকে সন্ধ্যা সদলবলে ভিড়। স্টলে জটলায় বিক্রিও বেশি, আর তাই বিক্রেতাদের মুখে হাসি।
ভিড়চিত্রে খুশি প্রকাশকরা
তাম্রলিপি প্রকাশনীর পরিচালক তাসনুভা আদিবা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের আজ শিশুক্রেতাই বেশি। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নতুন বই ‘ক্রেনিয়াল’ শুধু নয়, গতবারের বই ‘বাপ্পার বন্ধু’র চাহিদা এবারও বেশি। আহসান হাবীবের ‘কেঁচো খুড়তে অ্যানাকোন্ডা’ বইটি ভালো বিক্রি হয়েছে।
‘এছাড়া গুলতেকিন খানের ‘আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম’ বইটির প্রকাশনা উৎসব চলছিল বলে ক্রেতাদের আগ্রহ রয়েছে। মেলা শুরু হওয়ার পর থেকে আজই সবচে বেশি জমেছে এবং বিক্রিও বেশি। অবশ্য প্রতিবারই ছুটির দিনের অপেক্ষায় থাকি আমরা’- বলেন তিনি।
‘প্রিয়মুখ’ প্রকাশনের পক্ষে জেবা বাংলানিউজকে বলেন, বাচ্চাদের বই বিক্রি হয়েছে সারাদিন। ১১টা থেকেই ক্রেতা পেয়েছি। আলী আজম বাবলার ‘বায়োস্কোপ’ নাহার আহমেদের ‘ডিজিটাল ভূত’, জান্নাতুন নাঈম প্রীতির ‘পেন্সিলে আঁকা গল্প’ আগ্রহ তৈরি করেছে।
‘জ্যোৎস্না পাবলিশার্স’ প্রকাশক স্বপন কুমার দত্ত বাংলানিউজকে বলেন, দিনটি এমন হবে- জানতাম। সারাদিনে ভিড় দেখেই ভালো লাগছিল। আস্তে আস্তে মেলা জমে উঠেছে। প্রতিবারই আমরা ছুটির দিন ও শিশুপ্রহরের অপেক্ষা করি।
সকাল-দুপুর শিশুরাজত্ব:
শুক্রবার সকালটি ছিল এবারের মেলার প্রথম শিশুপ্রহর। শিশুদের জন্য বাংলা একাডেমি এবার বেশ কয়েকটি নতুন বই প্রকাশ করেছে। ছোটদের অভিধান-এর নতুন সংস্করণ, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সম্পাদিত আমার প্রথম লেখা, আখতার হুসেন সম্পাদিত হাবীবুর রহমান কিশোর রচনাসংগ্রহ, সৈয়দ শামসুল হকের বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা বইয়ের সাধারণ ও ব্রেইল সংস্করণ, আসাদ চৌধুরীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বেবী মওদুদের রাসেলের গল্প, শাহজাহান কিবরিয়ার আফ্রিকার রূপকথা এবং চালাক শিয়াল ও বোকা শিয়াল।
অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা এ পর্যন্ত মেলায় ২১টি শিশুতোষ বই প্রকাশ করেছে বলেও একাডেমিকে অবগত করেছে।
অমর একুশে উদযাপনে সকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। প্রধান অতিথি হিসেবে প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী।
প্রতিযোগিতা ক-শাখায় ২৬৫ জন, খ-শাখায় ২২৫ জন এবং গ-শাখায় ৭২জন সর্বমোট ৫৬২জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
মেলায় সেতুমন্ত্রী ও ডিএমপি কমিশনার
মেলার হালচাল দেখে গেলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
মেলায় চারুলিপি প্রকাশনী থেকে এসেছে মন্ত্রীর নতুন বই ‘যখন সাংবাদিক ছিলাম’। মন্ত্রী বললেন, এ বই নতুন নয়। পুরনো লেখার নতুন মুখ। আমি যখন সাংবাদিক ছিলাম তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লিখতাম। ওগুলোরই একটি সংকলন। সামনের মেলায় তার পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন নিয়ে নতুন উপন্যাস আসবে বলেও জানালেন।
আছাদুজ্জামান মিয়া মেলার চিত্রে সন্তুষ্ট। সবাইকে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন।
![](files/Bookfair_01_453139272.jpg)
অন্যতম আকর্ষণ গুলতেকিন খান
এদিন মেলায় অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিলেন গুলতেকিন খান। হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী হিসেবে নয়, এবার নিজের কবিতার বই নিয়ে এসেছেন তিনি। এ গুলতেকিন যেন অন্য গুলতেকিন, গুলতেকিনের গুলতেকিন!
বিকেলে সরব মূলমঞ্চ:
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী: অভিধান ও ব্যাকরণ কর্মসূচি, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকার। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক হাকিম আরিফ এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আহমদ কবির।
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলা একাডেমির অভিধান বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকেও অনন্যতার দাবিদার। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা-ইংরেজি অভিধান, বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান, তুর্কি-আরবি-ফারসি অভিধান, ছোটদের অভিধান এবং অতি সম্প্রতি প্রণীত আধুনিক বাংলা অভিধান একাডেমির অভিধান-সন্ধিৎসারই পরিচয়বহ।
তিনি বলেন, অভিধানের পাশাপাশি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ এবং বিজ্ঞান বিশ্বকোষের মতো মহাকায় কোষগ্রন্থ জ্ঞানান্বেষু মানুষের কাছে বিপুলভাবে আদৃত হয়েছে। তবে এখন পরিবর্তিত সময়ের দিকে লক্ষ্য রেখে এমন একটি অভিধানের প্রয়োজন যেখানে শব্দ চয়িত হবে সমকালীন প্রমিত ভাষার সাহিত্য থেকে, পৌনঃপুনিকতার বিচারে।
সন্ধ্যা প্রাঞ্জল সঙ্গীতে:
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বেগম রাহিজা খানম ঝুনুর পরিচালনায় বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস লিমিটেডের শিল্পীরা। শিল্পী আবদুল লতিফ শাহ্, শফি মণ্ডল, রণজিত দাস বাউল, মমতা দাসী বাউল, ভজন কুমার ব্যাধ এবং কোহিনুর আকতার গোলাপীর কণ্ঠে মাতেন অনুরাগীরা।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন বেণু চক্রবর্তী (তবলা), মোঃ শহিদুল ইসলাম (বাঁশি), এম এম রেজা বাবু (ঢোল), আবদুর রব হাওলাদার (দোতরা) এবং নির্মল কুমার দাস (মন্দিরা)।
মেলার ৫ম দিনে নতুন গ্রন্থের সমারোহ:
বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্য বলছে, এদিন নতুন বই এসেছে ২৫৬টি এবং মোড়ক উন্মোচন হয়েছে ১৪টি নতুন বইয়ের।
এদিন কবিতার বই সবচে বেশি এসেছে- ৬৪টি। এছাড়া গল্পগ্রন্থ ৪০, উপন্যাস ৪৯, প্রবন্ধ ৮, কবিতা ৬৪, গবেষণা ৪, ছড়া ৮, শিশুসাহিত্য ১৩, জীবনী ৮, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৪, নাটক ১, বিজ্ঞানভিত্তিক ৩, ভ্রমণ ৪, ইতিহাস ৫, রাজনীতি ৪, কম্পিউটার বিষয়ক ১, ধর্মীয় ২, অনুবাদ ১, অভিধান ৫, সায়েন্স ফিকশন ২, অন্যান্য গ্রন্থ ৩০টি।
দীর্ঘ লাইন আর হুমড়ি খাওয়া জনস্রোত:
প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী লাইনে দাঁড়িয়ে গ্রন্থমেলায় প্রবেশ করেছেন সাবিহা নুরুল। তিনি একটি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। লম্বা সারি-লাইনে যখন তার অবস্থান বাংলা একাডেমি ফটকের খানিক আগে, তখন গ্রন্থমেলায় প্রবেশের লাইন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ছাড়িয়েছে। এতো জনস্রোতই।
সন্ধ্যায় মেলা হয়ে ওঠে প্রচণ্ড ভিড়ের প্রতিচ্ছবি। মূলত এ মাসে প্রথম ছুটির দিন থাকায় মানুষের এমন হুমড়ি খাওয়া ভিড়- বলাবলি করছেন সবাই।
অন্যদিকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য ও অন্যপ্রকাশের পাশাপাশি স্টল। তাদের একটি বই হাতে নিতে তিনস্তরে ভিড় দেখা গেলো। অন্যসব স্টলগুলোতেও ঠিক এতোটা না হলেও গমগমে ভাব যেন এদিন অতি সাধারণ হয়ে ওঠে।
ধুলার মেলা
প্রথম জনস্রোতেই ধুলার মেলায় রূপ নিয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ নিয়ে নানা অসন্তুষ্টি দেখা গেছে আগতদের অনেকের মধ্যে।
মেলায় আসা চাকরিজীবী রূপন কুমার অভিযোগের সুরে বলেন, মেলায় ধুলা হবে- এটা আয়োজকদের আগেই বোঝা উচিত ছিল। ধুলা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। শিশুপ্রহরের পর প্রায় দুই ঘণ্টা মেলার কার্যক্রমে বিরতি ছিল। সে সময় পর্যাপ্ত পানি দেওয়া, কার্পেট বিছানো যেত। শ্বাসকষ্ট, ডাস্ট এলার্জির রোগীরা সমস্যায় পড়েছেন বেশ।
আগতরাই যখন আয়োজক:
সোহরাওয়ার্দীর পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে বেশ জটলা। মাইকে শব্দ কানে আসছে, প্রজেক্টরে দেখানো হচ্ছে- রাস্তা পারাপারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতামূলক বিষয়। মুগ্ধ হতে হলো- যখন টের পাওয়া গেল যে, মাইকে অনবরত বলে যাওয়া ব্যক্তিটি সাধারণ একজন আগত।
এক পুলিশ সদস্য বাংলানিউজকে বলেন, যারা আসছেন, তারাই নিজেদের অভিজ্ঞতা মাইকে সবাইকে জানাচ্ছেন। আমরা বললে যতটা কাজ হবে, তারা নিজেরা নিজেরা বললে, কাজ তার চেয়ে বেশি হবে।
শনিবারের সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা:
এ সকালও হবে শিশুদের: শনিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুদের অভিভাবকসহ স্বাচ্ছন্দ্যে বই কেনার সুবিধায় শিশুপ্রহর ঘোষণা করেছে বাংলা একাডেমি।
শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা: সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই। প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন খায়রুল আলম সবুজ, অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম এবং অপরেশ কুমার ব্যানার্জী।
বিকেলে আলোচনা: বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী: ফোকলোর কর্মসূচি, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান থাকছে।
এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ড. ফিরোজ মাহমুদ। আলোচনায় অংশ নেবেন অসীমানন্দ গঙ্গোপাধ্যায়, শাহিদা খাতুন, নন্দলাল শর্মা এবং সাইফুদ্দীন চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: শনিবার সন্ধ্যাটিও থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৬
এসকেএস/এমজেএফ/এসএইচ