উত্তরা দিয়াবাড়ি, রাজধানীর এই এলাকা মনোমুগ্ধকর পরিবেশের জন্য বেশ পরিচিত। এমন সুন্দর পরিবেশেই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছিল।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) জানাচ্ছে, এই ঘটনায় ২০ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও ১৭১ জন। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা উত্থাপন করেছে একটি গুরুতর প্রশ্ন, আর সেটি হল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ব্যবহৃত পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধবিমানগুলো এখনো কেন প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে? আর এই ঘটনার পেছনে কি শুধু প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা, নাকি দীর্ঘদিনের দুর্নীতিও দায়ী?
এফ-৭বিজিআই যুদ্ধবিমানটি চীনের চেংডু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের কর্তৃক তৈরি। এটি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ এর আধুনিকায়িত সংস্করণ। বাংলাদেশ ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে মোট ৩৬টি এফ-৭বিজিআই বিমান সংগ্রহ করে।
এই যুদ্ধবিমানগুলো মূলত ফাইটার কনভার্সন ট্রেনিং (ফাইটার কনভার্সন প্রশিক্ষণ) এবং সীমিত আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিমানগুলোর একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর ৯টি দুর্ঘটনার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি দুর্ঘটনায় পাইলট মারা গেছেন। ২০১৮ সালের মার্চে ঢাকায় এবং ২০২১ সালের জুনে বগুড়ায় আরও একটি দুর্ঘটনায় পাইলটের মৃত্যু হয়।
২০২৪ সালের ৯ মে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ওয়াইকে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। দুজন পাইলট প্যারাসুট ব্যবহার করে নদীতে পড়েন, তবে স্কোয়াড্রন লিডার অসীম জাওয়াদ মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে পুরোনো বিমান, যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি ও দুর্নীতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এফ-৭বিজিআই একটি এক-ইঞ্জিনবিশিষ্ট, তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমান যা আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম। এর রাডার দুর্বল, অস্ত্র সীমিত এবং ইঞ্জিনে ত্রুটি ঘটলে তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ হারায়।
তবে এই বিমান প্রশিক্ষণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলে দাবি করেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ মফিদুর রহমান।
বাংলাদেশে একজন যুদ্ধবিমান চালক হতে হলে মোট চারটি ধাপে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রথম ধাপেই রয়েছে প্রাথমিক সামরিক ও একাডেমিক প্রশিক্ষণ, যা দেওয়া হয় যশোরে অবস্থিত বিমান বাহিনী একাডেমিতে।
এরপর শুরু হয় প্রাথমিক উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ, যেখানে প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ বিমান পিটি-৬ বা সিজে-৬ ব্যবহার করে উড্ডয়ন শেখেন। এই প্রশিক্ষণটি পরিচালনা করে ফ্লাইং ট্রেনিং স্কুল, যশোর।
পরবর্তী ধাপে দেওয়া হয় উন্নত যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ। এই ধাপে ব্যবহার করা হয় কেএইট-ডব্লিউ বা ইয়াক-১৩০ নামের জেট বিমান, যা বগুড়ায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়।
সবশেষ ধাপটি হলো যুদ্ধবিমান রূপান্তর প্রশিক্ষণ। এই ধাপটি পরিচালিত হয় ঢাকার বঙ্গবন্ধু বিমান ঘাঁটিতে, যেখানে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয় এফ-সেভেন বিজিআই নামের যুদ্ধবিমান।
তবে এই ধাপ নিয়েই তৈরি হচ্ছে প্রশ্ন। কারণ, প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত এফ-সেভেন বিজিআই যুদ্ধবিমানটিকে অনেকে এখন ‘উড়ন্ত কফিন’ বলে আখ্যায়িত করছেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ইতোমধ্যে এই মডেলের বিমান ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।
অথচ বাংলাদেশের কাছে ইয়াক-১৩০ মতো তুলনামূলক আধুনিক প্রশিক্ষণ বিমান থাকা সত্ত্বেও এখনো চূড়ান্ত প্রশিক্ষণে পুরনো প্রযুক্তির এফ-সেভেন বিজিআই ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০১১ সালের চীন-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যুদ্ধবিমান কেনার সময় একাধিক অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব যুদ্ধবিমান কেনার সময় বিমান বাহিনীর প্রকৃত চাহিদা বিবেচনায় আনা হয়নি। চীন থেকে কম দামে বেশি সংখ্যক বিমান কেনার নামে সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এফ-৭বিজিআই যুদ্ধবিমানগুলোর জন্য বাংলাদেশ অ্যারোনটিক্যাল সেন্টারে যে মেরামত সুবিধা গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে অরিজিনাল যন্ত্রাংশের বদলে লোকাল অথবা নিম্নমানের চীনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২৫–২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪০ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সামরিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রয়েছে ৩৭ হাজার ৮১২ কোটি, কিন্তু উন্নয়ন ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহে মাত্র ৯১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই বরাদ্দে নির্দিষ্টভাবে এফ-৭বিজিআই বিমানের জন্য কোনো অংশ সংরক্ষিত নেই।
বঙ্গবন্ধু অ্যারোনটিক্যাল সেন্টারে এফ-৭বিজিআই বিমানের মেরামতের সুযোগ থাকলেও, অর্থ সংকট ও যন্ত্রাংশ ঘাটতির কারণে প্রয়োজনীয় মান রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এতে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে এবং বিমানের কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
দীর্ঘদিন ধরে অ্যাভিয়েশন বিটে কাজ করছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মুক্তাদির রশিদ রোমিও। এ দুর্ঘটনার বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, বিমানটি তেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না তবে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অ্যাভিয়েশন খাতের বরাদ্দ ওভারহোলিং না করে এভিয়েশন এরিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ করার ঝোঁক ছিল।
এতে সহজেই দুর্নীতির সুযোগ মেলে আর আজকের এই দুর্ঘটনা তারই ফল বলে মনে করছেন তিনি।
ওভারহোলিং অর্থ হলো একটি যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা যানবাহনের পুরোপুরি পরীক্ষা, মেরামত ও রিফিটিং করা, যাতে সেটি আবার নতুনের মতো কার্যক্ষম হয়। একটি যুদ্ধবিমান বা যাত্রীবিমান নির্দিষ্ট সময় পরপর ওভারহোলিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে ইঞ্জিন, বডি, ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা, ব্রেকিং সিস্টেম—সবকিছু খুঁটিয়ে পরীক্ষা ও মেরামত করা হয়।
ইয়াক-১৩০ এর মতো আধুনিক প্রশিক্ষণ জেট থাকলেও এফ-৭ বিজিআইয়ের উড্ডয়ন চালু রাখা হয় “খরচ কম” দেখিয়ে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতি ঘণ্টা ফ্লাইট ব্যয়ের হিসাবে এফ-৭বিজিআই তেমন সাশ্রয়ী নয়; বরং অকারণে জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেকেই মনে করেন, পুরনো বিমান চালু রাখার পেছনে রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট থেকে অনিয়ম করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ।
আজকের দুর্ঘটনার শিকার পাইলট ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার তৌকির ইসলাম। জানা গেছে, বিমানটি বারবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেইনটেইন্যান্সে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই “উড্ডয়নের জন্য উপযুক্ত” বলে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
ঘটনায় তদন্তে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আইএসপিআর জানায়, দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য এরইমধ্যে বিমানবাহিনীর একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া ঘটনার তদন্তের বিষয়ে জোর দিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা জানান, এ ঘটনায় ‘ভালো রকমের তদন্ত’ করা হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) ঘটনা পরিদর্শনকালে তিনি এ কথা বলেন।
পিএ