ঢাকা, সোমবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩২, ১৬ জুন ২০২৫, ১৯ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ড. ইউনূসকে বই-কলম দিয়ে কী বার্তা তারেক রহমানের

সাগর আনোয়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৫০, জুন ১৫, ২০২৫
ড. ইউনূসকে বই-কলম দিয়ে কী বার্তা তারেক রহমানের লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত শুক্রবার (১৩ জুন) বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে শুক্রবার (১৩ জুন) বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে তারেক রহমানকে ড. ইউনূসের ‘প্রধানমন্ত্রী’র সমপর্যায়ের অভ্যর্থনা এবং একইসঙ্গে সরকার ও বিএনপির যৌথ বিবৃতি প্রকাশ রাজনীতিতে স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

এর বাইরেও এই দুই নেতার বৈঠকে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে দেওয়া দুটি বই ও কলম সবার দৃষ্টি কেড়েছে।  

কী লেখা আছে বই দুটিতে? নিজেদের দল, পরিবার-সংশ্লিষ্ট অথবা অন্য কিছু না দিয়ে প্রফেসর ইউনূসকে কেন তারেক রহমান এই বিশেষ দুটি বই উপহার দিলেন? এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা কৌতূহল।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলমের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে পরিবেশ আন্দোলনের নেত্রী গ্রেটা থুনবার্গের লেখা ‘নো ওয়ান ইজ টু স্মল টু মেইক এ ডিফরেন্স’ এবং মনা আরশি ও কারেন ম্যাকার্থি উলফ সম্পাদিত ‘ন্যাচার ম্যাটারস: ভাইটাল পোয়েমস ফ্রম দ্য গ্লোবাল মেজরিটি’ নামের দুটি বই উপহার দেন। সঙ্গে দেন একটি কলম।   

জানা গেছে, ‘নো ওয়ান ইজ টু স্মল টু মেইক এ ডিফরেন্স’ বইটি ২০১৯ সালে সুইডেন থেকে প্রকাশিত হয়। মাত্র ৬৮ পৃষ্ঠার এই বইটি গ্রেটা থুনবার্গের ১৬টি ভাষণ ও বক্তৃতার সংকলন।  

বইটির বিভিন্ন বক্তৃতায় গ্রেটা পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষার গুরুত্ব এবং পরিবেশ রক্ষার এই দায়িত্ব যার যার অবস্থান থেকে এখনই শুরু করার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘কেউই এই দায়িত্ব পালন ও পৃথিবীকে রক্ষা করার আন্দোলনের ক্ষুদ্র অংশীজন নয়। যে কেউ, সে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, এই আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। ’

বইটিতে স্কুল পড়ুয়া গ্রেটা থুনবার্গের পরিবেশ রক্ষায় তার স্কুলত্যাগের ঘটনা এবং প্রতিদিন সুইডেনের সংসদ ভবনে একাই প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকার কথাও তুলে ধরেছেন। কীভাবে কলকারখানা পরিবেশকে দূষিত করছে, কীভাবে এর থেকে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে এবং সেটা যে সরাসরি আন্দোলনের মাধ্যমে সম্ভব তাও তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।  

তিনি বইটিতে লিখেছেন, প্রতি শুক্রবার স্কুল শেষে তিনি সুইডিশ সংসদের সামনে যেতেন। আর ভাবতেন পড়াশোনা করে কী হবে যদি আমাদের কোনো ভবিষ্যতই না থাকে। স্কুলেও এই বিষয়বস্তু পড়ে কী হবে, যদি চমৎকার বিজ্ঞান ও স্কুলের পড়ালেখা আমাদের সমাজ ও রাজনীতিবিদদের জাগাতে না পারে।  

গ্রেটা আরও লেখেন, অনেকে বলতো সুইডেন ছোট্ট একটি দেশ। এই ছোট্ট দেশের আমরা কে কী করছি তার কোনো প্রভাব পড়বে না বিশ্বে। কিন্তু আমরা যদি বাচ্চারা স্কুলে না গিয়ে প্রতিদিন গণমাধ্যমের হেডলাইন হই, তাহলে চিন্তা করেন কী হতে পারে। এটাই হবে যা আমরা চাই। এখনই সময় আইন ভাঙার। এখনই সময়ের বিদ্রোহের।   

এই বইটি প্রকাশের পর সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে ও প্রচুর বিক্রি হয়। এরপর গ্রেটা থুনবার্গ ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার না পেলেও গ্রেটা ২০১৯ সালে বিকল্প নোবেল হিসেবে পরিচিত ‘রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। একই বছর তিনি টাইম ম্যাগাজিনের ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ হন।  

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘ন্যাচার ম্যাটারস: ভাইটাল পোয়েমস ফ্রম দ্য গ্লোবাল মেজরিটি’ বইটিও ড. ইউনূসকে উপহার দেন। মনা আরশি ও কারেন ম্যাকার্থি সম্পাদিত বইটি প্রকৃতি ও প্রাণ সুরক্ষা আন্দোলন নিয়ে কবিতার সংকলন।  

এই বইটিতে পশ্চিমা ধারণার বাইরে এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষদের বাস্তুসংস্থান ভাবনা, পরিবেশ আন্দোলনে অবদান ও নিজেদের চিন্তাভাবনা তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রফেসর ইউনূসের ‘থ্রি জিরো’ ধারণার একটি হলো ‘শূন্য কার্বনের পৃথিবী’। তারেক রহমান মূলত এই বইগুলো উপহার দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, বিএনপিও জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ নিয়ে পশ্চিমা ধারণা ও এশিয়া-আফ্রিকাকেন্দ্রিক সম্যক ধারণা রাখে। যদি বিএনপি ক্ষমতায় যায় তাহলে ড. ইউনূসের শূন্য কার্বন ধারণার পাশাপাশি তার চিন্তা-ভাবনা  দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে বা তাকে দেশ গড়ার কাজে লাগাবে।  

এ বিষয়ে লন্ডনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইমরান আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, বই ও কলম উপহার বিষয়টির সঙ্গে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত। প্রথমত, নলেজ ওয়ার্ল্ডে কলমকে মনে করা হয় জ্ঞানের প্রতীক এবং বইকে মনে করা হয় শ্রেষ্ঠ উপহার। কলমের কথা পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ উল্লেখ করেছেন, এমনকি শপথও করেছেন। কিন্তু এখানে বই ও কলম উপহারের দেওয়াটাকে ‘ইন-বিটউইন দ্য লাইন’ পড়া উচিত। আদতে বই ও কলম উপহারের মাধ্যমে এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে যে, আপনার ক্ষেত্র আসলে একাডেমিয়া এবং রাজনীতি আসলে আপনার ক্ষেত্র না।  

ইমরান আহম্মেদের মতে, জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের ‘নো ওয়ান ইজ টু স্মল টু মেইক এ ডিফরেন্স’ ও ‘ন্যাচার ম্যাটারস: ভাইটাল পোয়েমস ফ্রম দ্য গ্লোবাল মেজরিটি’ বই দুটিকে খুব সচেতনভাবেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এই দুটি বইয়ের ধারণা আসলে প্রফেসর ইউনূসের ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এগুলোকে দিয়ে তাকে এমন বার্তাও দেওয়া হয়ে থাকতে পারে যে, একই ধরনের চিন্তা আসলে ভিন্নভাবেও করা যায়। আসলে এমন উপহারের মাধ্যমে তারেক রহমান যেমন একদিকে প্রফেসর ইউনূসের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন, আবার একইসঙ্গে তাকে তার প্রকৃত ক্ষেত্রও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।