ঢাকা: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পলায়ন ও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাজধানীজুড়ে শুরু হয়েছে টানা দাবির আন্দোলন। যৌক্তিক দাবিগুলোর পক্ষে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি থাকলেও, অনিয়ন্ত্রিত আন্দোলন জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।
সাধারণত রাজধানী বা দেশের কোথাও কোনো সভা-সমাবেশ বা অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করার আগে নিরাপত্তা বাহিনী তথা পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। রাজধানীতে এমন কোনো কর্মসূচি আয়োজনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু দাবিওয়ালারা তাদের কর্মসূচির জন্য অনুমতি নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা করছে না, এমন অভিযোগ উঠেছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
ডিএমপির একাধিক সূত্র জানায়, নিয়মিতভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হলেও প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে সমাবেশ, মিছিল কিংবা সড়ক অবরোধ করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোই অনুমতি না নিয়েই কর্মসূচি পালন করছে। পুলিশ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় নয়, কিন্তু বাহিনীর পক্ষে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ বলছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যদি অনুমতি না নিয়ে কর্মসূচি পালন করে, তাহলে ছোট সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকেই আগে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
আন্দোলন করছে কারা
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রথম এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা অটোপাসের দাবি তোলে। ২০ আগস্ট সচিবালয় ঘেরাও করে রাখার পর মিছিল নিয়ে শত শত পরীক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে। দাবি মেনে নিলে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সচিবালয় ছাড়েন শিক্ষার্থীরা।
২৩ অক্টোবর আবারও একদল শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল পুনরায় প্রকাশ এবং এ সংক্রান্ত ত্রুটি সংশোধনের দাবিতে সচিবালয়ে প্রবেশ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় সেখান থেকে ৫৩ জনকে আটক করা হয়।
বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর কিছু সদস্য চাকরির সংস্কারের জন্য কার্যত বিদ্রোহ শুরু করে। তারা সচিবালয় অবরুদ্ধ করে রাখে। ২৫ আগস্ট রাতে সেখানে সেনাবাহিনী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ হয়, এতে বহু মানুষ আহতও হয়। পরে সেখানে থেকে চার শতাধিক আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর শুরু হয় চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের আন্দোলন। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন কারণে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ৩০ জানিুয়ারি প্রেসক্লাব, সচিবালয়, হাইকোর্ট এলাকা ৫ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখার পর বিকেল ৪টায় তারা সরে যান।
পর পর নিজেদের দাবি পক্ষে আন্দোলন, বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বিশেষ করে শাহবাগ অবরোধে রাখে রিকশা-অটোরিকশা চালক, রেলশ্রমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম সাত কলেজ, সাবেক বিডিআর সদস্য থেকে শুরু করে শিক্ষক, ছাত্র, চিকিৎসকরাও। অনেক সময় এসব আন্দোলনের যৌক্তিকতা থাকলেও তা সংগঠিতভাবে অনুমতির মাধ্যমে হয়নি, বরং শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দখল করে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলেছে।
গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তির মত, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ‘অটো পাস’ দাবি মেনে নেওয়ায় মূলত বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান কারণ। এটি প্রমাণ করেছে, আন্দোলন করলেই কিছু দাবি পূরণ হচ্ছে। এমন একটি ধারণা সবার মাঝে তৈরি হয়েছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্রুপ সড়কে নেমেছে।
এরপর ঢাকায় ঘটে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা। বিশেষ করে ঢাকা কলেজ বনাম সিটি কলেজের সংঘর্ষ। নিউমার্কেট ও এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় বারবার শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজের সঙ্গে আইডিয়াল কলেজেরও পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ হয়েছে। এসব কারণে যানজট সৃষ্টি হয়, যা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীজুড়ে।
জাতীয় প্রেসক্লাব, সচিবালয়, শাহবাগ, তেজগাঁও— প্রতিটি জায়গা দাবিদারদের উপস্থিতিতে প্রায় প্রতিদিনই মুখর থাকছে। কোনোদিন শিক্ষার্থীরা, কোনোদিন চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য, কখনো ইন্টার্ন চিকিৎসক, আবার কখনো ময়লা পরিষ্কারকারী শ্রমিকেরা রাস্তায় বসে পড়ছেন।
চলতি এপ্রিলে তেজগাঁও পলিটেকনিকের ছয় দফা দাবি, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আন্দোলন, সর্বশেষ পিএসসির সংস্কারের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো বিচার ‘দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের’ মাধ্যমে করার দাবিতে ১২ আগস্ট শাহবাগ অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চ এবং সনাতন ছাত্র ও নাগরিক সমাজের ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর আবারও সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধসহ আট দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করা হয়। ধর্মীয় উপাসনালয়, ঘর-বাড়িতে হামলার অভিযোগ এনে তা বন্ধ ও নিরাপত্তা দেওেয়াসহ ৮ দফা দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ। এতে সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ভাতা বাড়ানোর দাবিতে ২২ ডিসেম্বর শাহবাগে বেসরকারি ট্রেইনি চিকিৎসকরা বিক্ষোভ করেন।
৬ দফা দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে ১৬ এপ্রিল। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করন তারা। দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসের পর ২৩ এপ্রিল তারা আন্দোলন স্থগিত করে।
ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে জানুয়ারির শেষ দিকে টানা আন্দোলন করেন শিক্ষকরা। অষ্টম দিনে রোববার দুপুরে তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পুলিশ তাদের বাধা দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
৯ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন সাবেক বিডিআর সদস্য এবং নিহত পরিবারের স্বজনেরা। শাহবাগ থানার সামনে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তারা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দাবির ভারে ন্যুব্জ ঢাকা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের দ্বিধান্বিত ভূমিকা
অভিযোগ উঠেছে, এসব ব্যাপারে পুলিশের দ্বিধান্বিত ভূমিকা ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুধু নির্দেশনামূলক বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে— সাধারণ মানুষ যেন ভোগান্তিতে না পড়ে, সেজন্য কর্মসূচি ঘোষণাকারীদের শুধু তাদের দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস পেয়ে আয়োজন থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও পুলিশ গরম পানি ছিঁটাচ্ছে, কোথাও লাঠিচার্জ করছে। কিন্তু যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হস্তে দমনের বাস্তব চিত্র খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ কেবল নির্দেশনার মধ্যেই অবস্থান করছে, কার্যকর কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বহু ভুক্তভোগী।
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থ বার্তা
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব শুধু জনগণের দাবি-দাওয়া পূরণ করা নয়— এমন গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যথাযথভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার সংশ্লিষ্টরা। ফলে সুযোগ পেয়ে আন্দোলনের নামে কিছু গ্রুপ নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে মাঠে নেমে পড়েছে। সরকারের উচিত ছিল শুরুতেই তাদের অবস্থান শক্তভাবে জানিয়ে দেওয়া, যাতে জনমনে বিভ্রান্তি না ছড়ায়।
বিশেষজ্ঞের মত
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নমনীয়তা একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে জনদুর্ভোগ বাড়ায়। সঠিক বার্তা, কঠোরতা এবং আইনশৃঙ্খলার সমন্বয়ে চলমান আন্দোলন ও জনদুর্ভোগের মধ্যে ভারসাম্য আনা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের চার মেয়াদে যারা নিজেদের বৈষম্য, নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার মনে করেছেন, তারাই এখন মাঠে নেমেছেন। অনেকে সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেও এসব আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ছয় মাসে বিভিন্ন দাবিতে ১৩৬টি আন্দোলনের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। শেখ হাসিনার সরকার সাধারণত যেকোনো আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করলেও, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার অপেক্ষাকৃত নমনীয়। ফলে মাত্র ছয় মাসেই এতো সংখ্যক আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে আন্দোলনের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা।
জননিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গত আগস্টে সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন ‘যমুনা’র আশপাশে সকল প্রকার কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় গত ১৩ মার্চ। কিন্তু সেই নির্দেশ বারবার লঙ্ঘন করেছেন আন্দোলনকারীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ আরও কয়েক মাস পরেই এক বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। অথচ রাস্তায় এখনো দাবি নিয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত। এই অবস্থায় সভা-সমাবেশের নামে যারা বিশৃঙ্খলা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে কঠোর হস্তে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি যারা শান্তিপূর্ণভাবে দাবিদাওয়া জানাতে চায়, তাদেরকে পুলিশের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা উচিত— এভাবেই রাষ্ট্রের ভারসাম্য ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক।
ডিএমপির কড়া হুঁশিয়ারি
বর্তমান পরিস্থিতি আমলে নিয়ে আগামীতে ডিএমপির অনুমতি ছাড়া যেকোনো কর্মসূচি পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ডিএমপি এলাকায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন সভা, সমাবেশ, গণজমায়েতসহ নানা কর্মসূচির ঘোষণা দিচ্ছে। এতে রাস্তায় নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। ফলে যান ও মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। সংবিধান অনুসারে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকার থাকলেও জনস্বার্থে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষের নাগরিক সুবিধা অক্ষুণ্ন রাখা, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিএমপি কমিশনারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কেউ অনুমতি ছাড়া কর্মসূচি চালালে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এজেডএস/এমজে