ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আওয়ামী লীগ

এমপি ফকিরের হাতে নির্যাতিতরা

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০১ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৬
এমপি ফকিরের হাতে নির্যাতিতরা ছবি: অনিক-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: দলে ও এলাকায় নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায় সময়েই মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন ক্যাপ্টেন (অব:) মুজিবুর রহমান ফকির। গত মহাজোট সরকারের আমল থেকেই তার জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

কথায় কথায় চরম দুর্ব্যবহার, মারপিট করা ছাড়াও নানাভাবে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে গিয়ে ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের তিন বারের এ সংসদ সদস্য নিজেই চরম বিতর্কের মধ্যে পড়েছিলেন। তার রোষানলে পড়ে কলেজ শিক্ষককে দিগম্বর হতে হয়েছে।

সংসদ নির্বাচনে পরাজিত নারী প্রার্থীকে অবমাননা করতে বিভিন্ন সভায় ও কৌশলে আপত্তিকর অপপ্রচার চালাতেন তিনি। তার বিপক্ষে অবস্থান করলেই প্রতিপক্ষের মাথা ন্যাড়া করে এলাকা ঘুরিয়েছেন।

তার মৃত্যুর পর সেইসব নির্যাতিতের কেউ কেউ শোক প্রকাশ করলেও শোকাহত হননি। তার সঙ্গে একই কমিটিতে নেতৃত্বে থাকা নেতারাও তার মৃত্যুতে যেন নুন্যতম কষ্ট অনুভব করেননি!   

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘হরিণ’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী নাজনীন আলমকে ভোটের মাঠে সামলাতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকিরকে। বিভিন্ন আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা নির্বাচিত হলেও এ প্রার্থীর কারণেই শেষ পর্যন্ত ভোটে লড়তে হয়েছিল তাকে।

আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে নানাভাবে ওই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছিলেন ফকির। তার অঙ্গুলী হেলনে তার ক্যাডাররা ভাংচুর করেছিল আওয়ামী লীগের এ বিদ্রোহী প্রার্থীর গাড়ি। শুধু তাই নয়, ওই প্রার্থীকে চরম আপত্তিকর ভাষায় অনৈতিক প্রস্তাবও দিয়েছিলেন ফকির।

নাজনীন আলমকে নির্বাচনের পরই বিয়ে করবেন, আর সেই বিয়ে খাওয়ারও নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রকাশ্য সমাবেশে। এমপি মুজিবের এমন বল্গাহীন কথাবার্তায় দলীয় পরিমণ্ডল ছাপিয়ে গোটা উপজেলা ও জেলাতেও তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছিল।

ক্যাপ্টেন (অব:) মুজিবুর রহমান ফকিরের মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করেছেন নাজনীন আলম। তবে তিনি শোকাহত হননি। অপমান-লাঞ্ছনার ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, আমরা অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছি। অপমান অপদস্থ হয়েছি। তারপরেও আল্লাহ যেন তাকে মাফ করে দেন।

জীবনের শেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে ফকির বিজয়ী হলেও ব্যক্তিগতভাবে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছিল। নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রকাশ্যে তার সমালোচনা ছিল প্রবল। তার ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই গত ইউপি নির্বাচনেও গৌরীপুরে ছিল বিদ্রোহীদের দাপট।

যাদের মনোনয়ন তিনি বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন তারাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। উপজেলা আওয়ামী লীগকেও তিনি কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। প্রায় ২০ বছর ধরে তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন বিধূভূষণ দাস।

তিনিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে একবার নিজ দলীয় এমপি ও সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তার মতামত ছাড়াই ক্যাপ্টেন একক সিদ্ধান্ত নিতেন। শেষদিকে দলীয় সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ছিল তার সাপে-নেউলে সম্পর্ক।

একবার তারা ক্যাপ্টেন মুজিবকে দলীয় সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে মাইকিং করেছিলেন। মিষ্টিমুখ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিধূভূষণ দাস বাংলানিউজকে বলেন, ওনার জীবদ্দশার কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তার অনেক ভুলত্রুটি ছিল। তবে এটা সত্যি ওনার মতো ভাল একজন নেতাকে আমরা হারিয়েছি।

ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব:) ফকির প্রতিপক্ষকে শিক্ষা দেয়ার ‘বিকৃত’ পথ বেছে নিতেন। স্থানীয় এক ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান ছোটনের মাথা প্রকাশ্যে ন্যাড়া করেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচন করার অভিযোগে।

সেই ছোটনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, তিনি উপজেলাবাসীর সামনে আমাকে হেনস্থা করেছেন। সামাজিকভাবে হেয় করেছেন। এ অপমান ভোলার মতো না।

স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপজেলা আওয়ামী লীগকে নিজের কব্জায় রাখলেও এমপি ফকিরের ছিল একাধিক শক্ত মনোনয়ন প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনবারের সংসদ সদস্য হওয়ায় তার সঙ্গে ঘাঁটিয়ে না পেরে উঠলেও তারা ছিলেন পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অপেক্ষায়।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব:) মুজিবুর রহমান ফকিরের মৃত্যুর পর কে পাচ্ছেন পরবর্তী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সেই মনোনয়ন প্রতিদ্বন্দ্বীরাও জীবদ্দশায় নানাভাবে ক্যাপ্টেনের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাজেহাল হওয়া এক প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলানিউজকে বলেন, দু:শাসনের যামানা থেকে মুক্তি মিলেছে। তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভোটারদের কাছে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। নির্যাতিত ও হেনস্থা হওয়া মানুষদের বোবা কান্না এখনো কান পাতলেই শোনা যায়।

 ‘দিগম্বর হবার পর আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না’

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৬
এমএএএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।