ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

এভিয়াট্যুর

অতিরঞ্জিত ব্যয়ে রাডার বসছে শাহজালালে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৬
অতিরঞ্জিত ব্যয়ে রাডার বসছে শাহজালালে

ঢাকা: অতিরঞ্জিত ব্যয়ের খাঁড়া মাথায় নিয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাল্টিমোড সার্ভেইলেন্স সিস্টেম (রাডার) স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

 

কার্যত রুট নেভিগেশনসহ অ্যারোনটিক্যাল এর বিভিন্ন খাতে আয় করে বেবিচক। আর রাডার হলো রুট নেভিগেশনের একটি কম্পোন্যান্ট। কেবল রাডার থেকে বেবিচকের একক কোনো আয় নেই। এ কারণে শুধু রাডার স্থাপনের মত প্রকল্পটি পিপিপি’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

পিপিপি’র মাধ্যমে রাডার স্থাপনের বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বলছে, এটি একটি এয়ার রুট নেভিগেশন প্রকল্প। সে কারণে বেবিচকের এয়ার রুট নেভিগেশন চার্জ বাবদ আয় থেকে নির্ধারিত কিস্তিতে প্রাইভেট পার্টনারের অংশ পরিশোধ করা হবে। বেবিচকের বাৎসরিক অ্যারোনটিক্যাল আয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা; যা থেকে ৭৬ কোটি টাকা বাৎসরিক কিস্তিতে ১০ বছরে মোট ৭৬০ কোটি টাকা পিপিপি পার্টনারকে পরিশোধ করা হবে।

বেবিচক বলছে, পিপিপি’র মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রাথমিক প্রকল্প খরচ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বেবিচকের খরচ করতে হবে না। এই অর্থ ১০ বছর পর্যন্ত ব্যাংকে এফডিআর করে রাখলে বেবিচকের আয় হবে ৮৫০ কোটি টাকারও বেশি।

তবে বাস্তবতা হলো, কোনো ব্যাংকই বর্তমানে এফডিআর-এ ৫ শতাংশের বেশি মুনাফা দিচ্ছে না। আর ৭ শতাংশ মূল্যস্থিতি হিসাব করলে এফডিআর-এ বেবিচকের লোকসান হবে ২ শতাংশ হারে। এ কারণে পিপিপি থেকে সরে এসে নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করলে লাভজনক অবস্থায় থাকবে বেবিচক। অন্যদিকে, ১০ বছরে মোট ৭৬০ কোটি টাকাও পিপিপি পার্টনারকে পরিশোধ করতে হবে না।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পিপিপি’র অংশীদার চেয়ে ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পে অংশ নিতে আগ্রহীদের মধ্য থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ায় বেসরকারি অংশীদার নির্বাচন করা হবে।  

দরপত্রে উল্লেখ করা হয়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বর্তমান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) এবং সার্ভেইলেন্স সিস্টেম উন্নত করা প্রয়োজন। এজন্য বেবিচকের জরুরি ভিত্তিতে এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) এবং কমিউনিকেশন সিস্টেম প্রয়োজন। একইসঙ্গে মাল্টিমোড সার্ভেইলেন্স সিস্টেম (রাডার, এডিএস-বি এবং মাল্টিলেটারেশন) অ্যালং উইথ এটিসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স সিস্টেমসহ সম্পূর্ণ নতুন এটিএম সেন্টার এবং কন্ট্রোল টাওয়ার দরকার।  

২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি শাহজালাল বিমানবন্দরের মাল্টিমোড সার্ভেইলেন্স সিস্টেম (রাডার) প্রকল্পটির নীতিগত অনুমোদন দেয়। সেসময় বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বতে (পিপিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে করিম অ্যাসোসিয়েটস। তবে শর্ত দেওয়া হয়, করিম অ্যাসোসিয়েটস বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ সম্পাদন করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৩৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপনকাজে ২১০ কোটি টাকা এবং ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এছাড়া প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ওভারহলিং বাবদ ব্যয় ধরা হয় ৭৫ কোটি টাকা।

সূত্রমতে, প্রকল্প খরচ হিসাবে করিম অ্যাসোসিয়েটস প্রাথমিক খসড়া প্রস্তাবনায় সব মিলিয়ে প্রায় ৯০ কোটি টাকা উল্লেখ করে। এর মধ্যে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি রাডার স্থাপন বাবদ ব্যয় উল্লেখ করা হয় ৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা, এডিএস বাবদ ১৫ কোটি ৭৭ লাখ, মেইনটেন্যান্স ও সার্ভিস বাবদ ১৫ কোটি ৭৭ লাখ এবং ট্রেনিং ও অন্যান্য খরচ বাবদ দশমিক সমপরিমাণ অর্থ।  

পরে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ‘সাপ্লাই, ইনস্টলেশন অ্যান্ড কমিশনিং অব মাল্টিমোড সার্ভেইলেন্স সিস্টেম (রাডার, এডিএস-বি ওয়াইড এরিয়া মাল্টিলেটারেশন— ডব্লিউএএম অ্যালং উইথ এটিসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স সিস্টেম) অ্যাট হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ঢাকা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় করিম অ্যাসোসিয়েটস। এতে ব্যয় উল্লেখ করা হয় ১৯০ কোটি টাকা।  

বেবিচক ও পিপিপি অফিসের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে পিপিপির আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সেটি নীতিগত অনুমোদনের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানোর সুপারিশ করে পিপিপি অফিস।

প্রকল্পে অত্যধিক ব্যয় নিয়ে সেসময় সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রস্তাবটি ফেরত পাঠায়। পরবর্তীতে গত বছরের আগস্টে করিম অ্যাসোসিয়েটস প্রকল্পের ব্যয় ১৪০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩৩০ কোটি টাকা উল্লেখ করে নতুন একটি প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়।  
তবে শর্ত হিসেবে বলা হয়, করিম অ্যাসোসিয়েটস বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে প্রাথমিক কাজ সম্পাদন করবে। প্রকল্পের জন্য করিম অ্যাসোসিয়েটসকে ১০ বছরে বেবিচক পরিশোধ করবে ৭৬০ কোটি টাকা।

তবে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে, এ যুক্তিতে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়, যা সর্বোচ্চ ৫০ মিলিয়ন ডলার বা ৩৯০ কোটি টাকা হতে পারে। এ হিসাবে প্রাথমিক প্রস্তাবের তুলনায় প্রকল্পটিতে ব্যয় বাড়ছে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতেই চূড়ান্ত দরপত্রে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে।

পিপিপি নীতিমালা অনুযায়ী, প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিলে দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কিছুটা সুবিধা পায়। সে হিসাবে দরপত্র মূল্যায়নে কিছুটা এগিয়ে থাকছে করিম অ্যাসোসিয়েটস।

৩৩০ কোটি টাকায় অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপনকাজে ব্যয় ধরা হয় ২১০ কোটি টাকা। ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় ধরা হয় ৪৫ কোটি টাকা। যদিও যে প্রতিষ্ঠান থেকে রাডারের যন্ত্রপাতি কেনা হয়, তারাই ১০ বছরের জন্য মেইনটেন্যান্স ও সার্ভিস সেবা দিয়ে থাকে। এজন্য বাড়তি কোনো অর্থ প্রয়োজন হয় না। এছাড়া প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ওভারহলিং বাবদ ব্যয় ধরা হয় ৭৫ কোটি টাকা।

এদিকে, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) গাইডেন্স ম্যাটেরিয়াল ও কম্পারিজন অব সার্ভেইলেন্স টেকনোলজিস (জিএমএসটি) সূত্রে জানা গেছে, যে কোনো বিমানবন্দরের জন্য মাল্টিলেট সিস্টেম ও রাডার স্থাপনে সব মিলে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৭২ কোটি টাকা (৯ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার)। এর মধ্যে মাল্টিলেট সিস্টেম বাবদ ব্যয় ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার বা ২৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি রাডার বাবদ খরচ ৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার বা ৪৮ কোটি ৯ লাখ টাকা। ইকুইপমেন্ট, টাওয়ার অ্যান্ড এন্টেনা মাউন্টিং, পাওয়ার সাপ্লাই, টেলিকমিউনিকেশন স্টাবলিশমেন্ট, টেলিকমিউনিকেশন অনগোয়িং খরচ ও ইনস্টলেশন অ্যাক্টিভিটি বাবদ সব খরচ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যে প্রতিষ্ঠান থেকে এসব কেনা হবে, তারাই ১০ বছরের জন্য মেইনটেন্যান্স ও সার্ভিস দেবে। এজন্য বাড়তি কোনো অর্থের প্রয়োজন হয় না।

শাহজালাল বিমানবন্দরে আধুনিক ও যুগোপযোগী রাডার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও অর্থাভাবে তা করতে পারেনি বেবিচক। এর আগে ড্যানিশ অর্থায়নে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আপগ্রেডেশন প্রকল্পে রাডার সংস্থাপন কম্পোন্যান্টটি থাকলেও অর্থাভাবে সেটি বাদ পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুপারিশ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। যদিও গত বছরের ২৩ এপ্রিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৪০তম বৈঠকে বিমানবন্দরের রাডার ক্রয়ে পিপিপির পরিবর্তে অন্য কোনো উপায় খোঁজার পরামর্শ দেয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৬
এইচএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।