ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মইনুদ্দীন খালেদের সঙ্গে আলাপ

‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চিত্রকর্মগুলোর সংরক্ষণ ও প্রদর্শন প্রয়োজন’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১২
‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চিত্রকর্মগুলোর সংরক্ষণ ও প্রদর্শন প্রয়োজন’

[দেশের বিশিষ্ট চিত্রসমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের চিত্রকলায় মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে এসেছে জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।

তার সেই কথাগুলো নিচে তুলে ধরা হলো। মইনুদ্দীন খালেদের সঙ্গে কথা বলেন রবাব রসাঁ । ]

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/problem620120325184819.jpgবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোন একদিনের আয়োজন নয়। শিল্পী-মনে এই ভাবনাটা ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। দেশভাগের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে শিল্পীরা পোস্টার, ফেস্টুন ও নানান রকম চিত্রকর্মের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেন। তাদের শিল্পকলায় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের চিত্র উঠে আসে। যেমন ধরুণ, একটি বুট-জুতার চিত্র।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে গণ-মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে শিল্পীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন সচেতন ভাবেই।

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানসহ নানাবিধ স্লোগান নিয়ে তারা পোস্টার-ফেস্টুন এঁকেছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের চিত্রকলার প্রসঙ্গ এলে, শিল্পী মুর্তজা বশীর ও বিরেন সোম এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালেই তৈরি করেছিলেন ‘ব্লাডি টুয়েন্টিফাস্ট’। লিথোকাটের মাধ্যমে তৈরি এই শিল্পকর্মে তিনি তুলে ধরেছিলেন ১৯৫২ সালের সেই ঐতিহাসিক দিনটিকে।

বাংলাদেশের চিত্রকলা বিপ্লবী-সংগ্রামী মানব চেতনার সংগে অঙ্গীভূত হয়ে আছে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শিল্পীদের ভেতর প্রকাশ পায়। ক্রমেই তা জোড়ালো হয়ে ওঠে।

ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ‘স্বা-ধী-ন-তা’ অক্ষরগুলো নিয়ে মিছিল করার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

শিল্পীদের সংগ্রামী ভূমিকার চূড়ান্ত মুহূর্ত আসে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে।

ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নেওয়ার পর সে যে একটা নরঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে তা শিল্পীরা বুঝতে পেরেছিলেন। শিল্পী কামরুল হাসানের ‘এই নরঘাতকদের হত্যা করতে হবে’ বা ‘অ্যানিহিলেট দিস ডেমনস’ চিত্রকর্মটি সেই ১৯৭০ সালেই আঁকা হয়েছিল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শিল্পীরা কেউ কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আবার অনেকই শরনার্থী শিবির বা কলকাতায় বসে স্বাধীনতার চেতনাসমৃদ্ধ ছবি এঁকেছিলেন।

চিত্রকলায় মুক্তিযুদ্ধকে যারা বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন তাদের মধ্যে মুস্তফা মনোয়ার, কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম ও স্বপন চৌধুরীসহ আরো অনেকরে নাম বলা যেতে পারে।

এই চিত্রকর্মগুলো যদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে প্রদর্শন করা যেত তাহলে আজকের প্রজন্ম জানতে পারত স্বাধীনতা আন্দোলনে শিল্পীদের শক্তিশালী ভূমিকার কথা। সে শিল্পকর্মগুলো ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে কাজ করত। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চিত্রকর্মগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা প্রয়োজন।

শিল্পী জয়নুল আবেদীনের ‘যোদ্ধা বাংলা’-য় আমার দেখতে পাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ।

শিল্পী এস এম সুলতান স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন একটি গণহত্যার ছবি এঁকে।

কামরুল হাসান এর শিল্পকর্মে আমার পাই নারী মুক্তিযোদ্ধা।

কাইয়ুম চৌধুরীর কৃষক-মজুর মাথায় গামছা বেঁধে রণাঙ্গনের চিত্র আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হয়ে গেছে।

একইভাবে মুর্তজা বশীরের এপিটাফের কথা স্মরণ করতে হয়।

সফিউদ্দিন আহমেদ তার চিত্রকর্মে তুলে ধরেছেন নির্যাতিত মানুষের নীরব কান্না। অনেকগুলো চোখের মনি এঁকে তিনি ১৯৭১ সালের না-বলা কষ্টগুলো তুলে ধরেছেন তার চিত্রকলায়।

শিল্পী নিতুন কুণ্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, কালিদাস কর্মকার প্রমুখ শিল্পী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন তাদের নিজস্ব শৈলীতে।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন শিল্পীর বিমূর্ত চিত্রকলাতেও আমরা দেখতে পাই স্বাধীনতার রূপ। যেমন, শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া তার চিত্রকর্মে কালো ও ধূসর রঙ ব্যবহার করেছেন একটা জমাট বেদনাবহ ৭১-কে ধরতে।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/sahabuddin20120325184931.jpgতবে শিল্পী শাহাবুদ্দীনের উত্থানটা বিস্ময়কর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চিত্রকর্ম বঙ্গজ রূপ পেয়েছে শাহাবুদ্দীনের হাত ধরে। এই যোদ্ধা-শিল্পীর চিত্রকর্মে দেখা যায়, যারা কোনদিন অস্ত্র ধরেননি, তারা অস্ত্র ধরেছেন। এই আমজনতার সংগ্রামকে শিল্পী শক্তিশালীভাবে তার ক্যানভাসে তুলে ধরেছিলেন ১৯৮০-র দশকে।

তারপর থেকে আমরা এর মার্জন-পরিমার্জন এবং আন্তর্জাতিক রূপ দেখতে পাচ্ছি।

এই আশির দশকে প্রচুর ক্যরিকেচার আঁকা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের ব্যঙ্গ করে। শিশির ভট্টাচার্য, নিসার হোসেন, ঢালী আল মামুনসহ অন্যান্য শিল্পীরা স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি গণতন্ত্র তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে।

এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা দরকার ছিল। এখনো যদি সরকার বা কোন ব্যক্তি উদ্যোগ নেন তা হলেও সেগুলোকে বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

শিল্পকলায় এক নতুন ধারার যোগ ঘটল ভাস্কর্য শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের পর তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা কোন শহরের প্রবেশমুখে স্বাধীনতার ভাস্কর্যগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

ভাস্কর্যের পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনাসমৃদ্ধ মুরালও আঁকা হয়েছে অনেক।

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী বা এখনকার তরুণ শিল্পীরা একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরেছেন তাদের শিল্পকর্মে।

লোকশিল্পের প্রসঙ্গে এলে দেখা যায়, একসময় অনেক রিক্সা পেইন্টিং-এ মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা হয়েছিল। মাটি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য গড়তেন লোকশিল্পীরা। খড় দিয়ে বানানো হত রাজাকারদের অবয়ব।

এমনকি, লোকশিল্পীরা একসময় মুজিব-ইন্দিরার যুগল ভাস্কর্য বানাতেন মাটি দিয়ে।

এখন যে বিষয়টাকে খুব গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন তা হলো এগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ। শিল্পকলার যতগুলো মাধ্যমে কাজ হয়েছে তা ভাগ করে গবেষণা করাও বিশেষ দরকার।

এমনকি, বিভিন্ন শাসকের সময় বাংলাদেশর শিল্পকলার চর্চা কেমন ছিল তাও বিবেচনায় রাখতে হবে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজে।

বাংলাদেশ সময় ১৮৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১২

সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।