ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মঞ্চের আলো ছায়ায়

কতিপয় স্টুপিডের মর্মস্পর্শী বয়ান

সুমন মজুমদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১২
কতিপয় স্টুপিডের মর্মস্পর্শী বয়ান

মঞ্চের হাসি কান্না নিয়ে নিজেই যখন একটা তালগোলের মধ্যে জড়িয়ে আছি, ঠিক তখনি পাকেচক্রে কিংবা দৈবাৎ, যাই হোক না কেন প্রশান্ত হালদারের ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠার প্রথম স্বাক্ষর অর্থাৎ ‘স্টুপিড কতিপয়’ বইটা হাতে পেলাম। বইয়ের নাম দেখে অবশ্য শুরুতেই খটকা লাগে।

লেখক বইয়ের নাম রাখতে গিয়ে সরল পথে না হেঁটে একটু ঘুর পথে হাঁটলেন কেন! কে জানে হয়তো কোনো ব্যাখা আছে।

আগাগোড়াই উত্তম পুরুষে সদ্য প্রয়াত বন্ধু রাজুকে নিয়ে প্রেমিকাকে লেখা মঞ্চকর্মী পার্থর নিজস্ব বয়ান এটি। পড়তে পড়তে কখন যেন মনে হল, কি আশ্চর্য, এখানকার চরিত্রগুলোতো আমাদের চেনা। রাজু, আদিত্য, মুনির, রেজা ভাই, শফি ভাই, জেরিন আপারা তো আমার দূরের কেউ নয়। কতদিন কতভাবে যেন বারবার ছুঁয়ে দেখেছি এই মানুষগুলোকে। বইটি যেন বাংলাদেশের মঞ্চ নাট্যকর্মীদের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান, স্মৃতি-বিস্মৃতির জীবন্ত দলিল। বইয়ের শেষ ফ্লাপে প্রশান্ত হালদারের ব্যক্তিগত পরিচিতি দেখে বুঝলাম তিনি মঞ্চের মানুষ বলেই হয়তো পুরো গল্পের চিত্র আর চরিত্রদের এত জীবন্ত করে তুলতে পেরেছেন।

গল্পটি লিরিক থিয়েটার নামের এক কাল্পনিক নাট্য দলের কিছু নাট্যকর্মীদের কথা হলেও অনেক বাস্তব চরিত্রও আছে। ধারণা করছি কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত হালদার ইচ্ছে করেই এসব চরিত্রগুলোকে গল্পের গাঁথুনি মজবুত করার জন্য ব্যবহার করেছেন। গল্পের কথক পার্থ হলেও রাজুই যে এর মূল নায়ক তা বুঝতে কোনো পাঠকেরই সমস্যা হবার কথা নয়।

উপন্যাসের শুরুতেই উৎসর্গপত্রে লেখক নিজ দলের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এক মঞ্চকর্মীর নাম লেখেন। জানি না রাজু চরিত্রটি তাকে দ্বারা অনুপ্রাণিত কিনা। তবে উপন্যাসের শুরু অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রাজুর স্মৃতি বর্ণনায় চরিত্রটি যখন শক্তিশালীর দিকে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই কখনো কখনো মনে হয়েছে জীবিত রাজু যেন অন্যদের ছায়ায় কেমন ম্রিয়মান। তবে হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানি ঠিকই চরিত্রটিকে শেষ পর্যন্ত একটি জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

বইটিতে বাংলাদেশের মঞ্চকর্মীদের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার কথা বলতে যেয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে  এসেছে মঞ্চ সংকট, গ্রুপ ও পেশাদারি থিয়েটার বিতর্ক, দলীয় ভাঙ্গণ,  ক্রোন্দল, জীবিকা আর ইচ্ছার টানাপোড়েন, টেলিভিশনের ঝলমলে জগতের হাতছানিসহ বহু প্রসঙ্গ।

বইটির শেষের কয়েকটা লাইন যেন দেশের হাজার হাজার নাম না জানা মঞ্চকর্মীর দীর্ঘশ্বাস থেকেই তৈরি। পার্থ যখন আপন মনে বলে- এই যে আমরা থিয়েটার করি কজনের কাছে মূল্য আছে এর ? অনেকের কাছেইতো থিয়েটার মানে এক ধরনের আনন্দ ফূর্তি, হইহুল্লোড়, ইয়ার্কি ফাজলামো, মজা করা, অনর্থক সময় নষ্ট করা। আমাদের অভিভাবকরা এসবের কোনো মানে খুঁজে পান না। আমাদের নিয়ে তাঁরা হতাশ। তাঁরা ভাবেন কি হবে এসব করে ? একটা ভালো চাকরি নয়, বাড়ি নয়, গাড়ি নয়, অর্থ নয়। বন্ধুরাও ভৎর্সনা করে বলে, ক্যারিয়ার নিয়ে না ভেবে কি করছ এসব? আমাদের বন্ধুরা আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা টেলিভিশনে আমাদের চেহারা দেখলে খুশি হন। সে অভিনয় যত খারাপই হোক না কেন। তারা গর্ব করে আর দশজনকে বলতে পারেন, আমার অমুক আমার তমুক টেলিভিশনে অভিনয় করে। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতার সমবয়সী এই থিয়েটার?

‘স্টুপিড কতিপয়’ বইটি পড়ে আরেকটি জিনিস খুব প্রকটভাবে মনে হয়, মানুষের বিস্মৃতি পরায়ণতার কথা। রাজু মারা যাবার পর লিরিক থিয়েটারে তার সহকর্মীদের মত উৎসব শোসহ নানা ডামাডোলে পাঠকও মনে হয় রাজুকে মাঝে মাঝে ভুলে যায়। যদি আবার কোনো কারণে হঠাৎ চকিতের জন্য খানিক মনে পড়ে, ব্যাস ওই টুকুই। অতঃপর আবার নিজে, নিজের জগৎ, সুখ দুঃখ ভালো লাগা মন্দ লাগা। তাইতো রাজুকে ছাপিয়ে রক্তকোষ নাটকের প্রদর্শনী এক ঝটকায় রাজুকে আড়াল করে শেষে নায়ক বানিয়ে দেয় পার্থকেই। তবে অভিনেতা পার্থের  ভেতরে মানুষ পার্থর যে দ্বিধা, অপরাধবোধ আর নাম না জানা এক তাড়নার দ্বন্দ্ব সেটিই উপন্যাসটাকে শেষাংশে বেশি জীবন্ত করেছে বলে মনে হয়। রাজুর স্মরণসভায় তাই বঙ্গজিৎ দার কথাটা আসলে হয়ে দাঁড়ায় পার্থের মনোজগতের ভেতরের সবচেয়ে সত্যাংশ- মানুষ মারা যাবার সাথে সাথে যদি স্মৃতিরাও মরে যেত, ভালো হত।

উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি মনে হয়েছে এর বাস্তবঘনিষ্ঠতা ও প্রাঞ্জলতা। মঞ্চের সাথে যারা যুক্ত তাদের কাছে এটি পড়তে চেনা জগৎই মনে হবে আর যারা মঞ্চের বাইরের মানুষ তাদের কাছে ঘটনাবলী খানিকটা বোহেমিয় মনে হলেও প্রাঞ্জলতাটুকু ঠিকই গল্পের মাঝে টেনে ধরে রাখবে বলেই মনে হয়। অবশ্য কখনো কখনো লেখক প্রশান্ত হালদার যে একেবারে খেই হারিয়ে ফেলেননি এমনও নয়। মাঝে মাঝে পড়তে মনে হয়েছে কিছু কিছু লাইন, ঘটনা, কিছু কিছু চরিত্র না থাকলেও চলতো। কোনো কোনো চরিত্রের প্রতি প্রশান্ত দা অবিচার করেছেন বলেও মনে হয়েছে। যেমন রাজুর ভাই বিজু কিংবা গ্রামের সেই ভাবি আরেকটু কিছু সময় লেখকের কাছে প্রাপ্য ছিল। তার তুলনায় ক্যামিলি চরিত্রটিকে কেমন যেন শক্তিহীন আর মাঝে মাঝে অতি নাটকীয় মনে হয়েছে।

চলে আসি উপন্যাসটির প্রচ্ছদের ব্যাপারে। প্রচ্ছদকার শাহীনুর রহমান ঠিক কোন ভাবনা থেকে এটি করেছেন জানি না, তবে উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে এর একধরনের অন্যরকম অর্থ থাকলেও থাকতে পারে। সাদামাটা অলঙ্করণের প্রচ্ছদ যেন বইটির সাদামাটা মানুষদের জীবনের কথাই তুলে ধরেছে। হঠাৎ বইটির প্রচ্ছদ দেখলে মনে হয় এটি যেন একটি ডায়েরি। আবার নামের উপর লাইটের সাজেসন, মধ্যখানে বিভিন্ন চরিত্রের মুখাবয়ব ও নিচের সেট সাজেসনটি মঞ্চের কথাও মনে করিয়ে দেয়।

প্রশান্ত হালদারের ‘স্টুপিড কতিপয়’ বইটি প্রকাশ করেছে পাঠসূত্র। মূল্য : ১৫০ টাকা।


বাংলাদেশ সময় : ১৮১০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১২
সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।