ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আফগানিস্তানের ছোটগল্প

প্রদর্শনী

মূল : খান মোহাম্মদ সিন্ধ, অনুবাদ : ফজল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১২
প্রদর্শনী

যখন সে বাড়ি ফিরল, তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তার স্ত্রী ঘরের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিল।

ঘরে ঢুকেই সে সোজা বিছানায় শুয়ে থাকা পাঁচ বছরের অসুস্থ ছেলের কাছে যায়। গায়ে জড়ানো শাল খুলে সে তার মাথা এবং দাড়ি মুছে ছেলের শরীরের কুশলাদি সম্পর্কে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে।


প্রায় কান্না জড়ানো চোখে স্ত্রী বলল, ‘এখনও বারীর প্রচণ্ড জ্বর। ও খুবই দুর্বল এবং সারাদিন বিছানায় শুয়েছিল। খাবারের প্রতি ওর কোনো আগ্রহ নেই। কয়েকবার স্যুপ দিয়েছিলাম, কিন্তু ও কিছুই খেতে পারেনি। ’

বিছানায় ঝুঁকে সে কণ্ঠস্বরে সোহাগের সামান্য বরফকুচি মিশিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা বারী, আমার আদরের ছেলে, কলিজার টুকরা। কেমন আছিস? কোথায় ব্যথা?’
আব্বাজানের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বারী আলতো করে চোখের পাতা মেলে তাকায়। সে আব্বা-আম্মা দু’জনের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো, ‘আমার সমস্ত শরীরে ব্যথা। ’
হাঁটু গেড়ে বসে সে তার হাতের উপর ছেলের মাথা রেখে বলল, ‘ঠিক আছে। আল্লাহর রহমতে শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবি। এখন উঠে বস। একটু কিছু খেয়ে নে। তোর জন্য কলা এনেছি। ’

বলেই সে ছেলেকে শোয়া থেকে আলতো করে তুলে বসায়। তাড়াতাড়ি বারীর আম্মাজান খাবার তৈরি করে নিয়ে আসে। আব্বা-আম্মা দু’জনেই চামচে করে তাকে খাওয়ায়। সমস্ত রাত বারী একটুও ঘুমোতে পারেনি। প্রচণ্ড ব্যথায় সে গোঙাতে থাকে। বিছানার পাশে বসে আব্বা-আম্মা তাকে পর্যবেক্ষণ করে।
পরদিন সকালে সারোয়ার তার স্ত্রীকে দুইশ’ রুপি দিয়ে বলল, ‘আজ আমার অনেক কাজ। বাজারে যেতে হবে। ছেলেকে তুমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও। ’

বিল্ডিংয়ের যেখানে ঠেলাগাড়ি বাঁধা, সারোয়ার বাড়ি থেকে বের হয়ে সেখানে এসে দারোয়ানকে পাঁচ রুপি দিয়ে একটা ঠেলাগাড়ি ভাড়া নেয়। তারপর ঠেলাগাড়িটা ঘুরিয়ে সে বাজারের দিকে রওয়ানা হয়। সে যখন বাজারে পৌঁছে, তখনও সূর্য ওঠেনি। একটা দোকানের সামনে ঠেলাগাড়ি থামিয়ে দোকানিকে সম্ভোধন করে বলল, ‘বদর, সালাম আলাইকুম। ’
শার্টের বোতাম খুলে ভুঁড়িওয়ালা দোকানি বিছানায় শুয়েছিল। সামান্য নড়েচড়ে সে তার টাক মাথায় হাত রাখে। তারপর দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে দীর্ঘ গোঁফ টেনে সোজা করে। সারোয়ারের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘এখানে এসো, সারোয়ার। শোন, তোমাকে আজ আমি কোনো আখ দিব না। কেননা তুমি এখনও আগের ঋণ পরিশোধ করোনি। ’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/slides_image_1420120321185432.jpgবেশ মোলায়েম স্বরে সারোয়ার বলল, ‘সেদিন কোনো আখ বিক্রি করতে পারিনি। ট্রাফিক পুলিশ আমাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেরিয়েছে। কোথাও বসতে দেয় না। ফলে সমস্ত আখ শুকিয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করুন, গতকালই আপনার ঋণ পরিশোধ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার ছেলেটা ভীষণ অসুস্থ। তাই ওকে ডাক্তার দেখানো এবং ঔষধ কেনার জন্য বাড়িতে স্ত্রীর কাছে রুপি রেখে এসেছি। ’

জবাবে দোকানি বলল, ‘দেখ সারোয়ার, অনেকেই আমার কাছ থেকে বাকিতে আখ নিয়ে বিক্রি করে। প্রতিদিন সকালে আমি ওদের আখ দেই। ওরা সারাদিন ঠেলাগাড়িতে নিয়ে বিক্রি করে রাতে এসে ঠিক মতো ঋণ শোধ করে। অনেকদিন ধরে তোমার সঙ্গে আমার লেন-দেন। অথচ তুমি আখ বিক্রি করে সব টাকা তোমার কাছে রেখে দাও। আগে ভালো ছিলে, কিন্তু এখন তুমি শয়তানের পাল্লায় পড়েছ এবং এ ধরনের মিথ্যা অজুহাত দিচ্ছ। ’

অনুনয়-বিনয় করে সারোয়ার বললো, ‘বদর, একবার ভেবে দেখুন, গত তিন বছরে আপনার কাছ থেকে আমি কতদিন আখ নিয়েছি এবং কতবার ধার শোধ করতে গড়িমসি করেছি? কিন্তু অনেকদিন ধরে ছেলেটা খুবই অসুস্থ। তাই ওর চিকিৎসার জন্য প্রচুর খরচ করতে হচ্ছে। এটা হয়তো আপনার জন্য ভালো। আমাকে ঋণী করে রাখুন। কোনো চিন্তা করবেন না। আল্লাহপাক মহান। আমি সব ঋণ শোধ করে দেব। ’

সারোয়ারের অজুহাতের সঙ্গে দোকানি যদিও একমত পোষন করল না, কিন্তু সারোয়ার এমনভাবে কাকুতি-মিনতির সুরে নিজের অক্ষমতাকে স্বীকার করে ক্ষমা চাইল যে, বদর শেষপর্যন্ত তাকে পাঁচশ’ রুপির আখ দিতে সম্মত হল। ঠেলাগাড়িতে আখ তুলে সারোয়ার তড়িঘড়ি পঁচা খান এবং চারসাদা সড়কের মোড়ের দিকে রওনা হল। প্রতিদিন ওখানেই সে আখ বিক্রি করে। ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করে সে আখের খোসা ছাড়াতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় বিশ-ত্রিশটি আখের খোসা ছাড়ায়। তারপর সেগুলোকে সুন্দরভাবে সামনে সাজিয়ে রাখার জন্য ছোট ছোট টুকরো করে। সে সময় ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সে চিৎকার করে বলে, ‘তাজা আখ ... মিষ্টি আখ আছে। ’ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় দশ-পনের কিলো আখ বিক্রি করেছে, কিন্তু অনবরত ডাকাডাকির পরও বিকেলের দিকে বিক্রি অনেক কমে যায়। তখন সে দশ, পাঁচ ও দুই রুপির নোটগুলো স্তূপাকারে সাজায় এবং ছেঁড়া নোটগুলো আলাদা করে। তারপর বিক্রির সব রুপি গুণে। এর মধ্যে সাত বা আটটা বিশ রুপির নোট আছে। বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গরম হাওয়া ছেড়ে আপন মনে বললো, ‘হায় আল্লাহ, এই অল্প রুপি নিয়ে এখন আমি কি করবো ? ছেলের জন্য ঔষধ কিনতে হবে। কেমন করে আমি দোকানিকে আখের দাম পরিশোধ করব?’

বিকেল বেলা বাজারে প্রচুর লোকজনের সমাগম হয়। ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য সারোয়ার জোর গলায় বলতে থাকে, ‘তাজা আখ আছে ... মিষ্টি আখ। ’ একসময় সে দেখতে পেল একদল লোকের পরনে ক্রিকেট খেলার পোশাক। তাদের হাতে ব্যাট ও বল। প্রায় দশজন লোক তাদের অনুসরণ করছে। তারা কিংস্ গার্ডেনের দিকে যাচ্ছে। স্বগক্তির মতো করে সারোয়ার বললো, ‘বোধহয় শাহিবাগে কোনো খেলা হবে। ওখানে গেলে আল্লাহর রহমতে হয়তো বাকি আখগুলো বিক্রি করতে পারব। ’ এই বলেই সে শাহিবাগের দিকে সজোরে ঠেলাগাড়ি ঠেলতে থাকে। বড় রাস্তা ধরে সে তাড়াতাড়ি চৌরাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছে। সেখানে একজন ট্রাফিক পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল। কোনো কারণ ছাড়াই ট্রাফিক পুলিশ তার উদ্দেশে চিৎকার করতে থাকে এবং কাছে এসে ঠেলাগাড়িকে জোড়ে লাথি মেরে ধমকের সুরে বলল, ‘এখান থেকে জলদি ভাগ। ’

কাঁচুমাচু করে নরম গলায় সারোয়ার বললো, ‘আমি ওখানে অই শাহিবাগের গেটের কাছে যাব। ’
সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ লোকটি বলল, ‘সেদিন তুই ভাল ব্যবহার করিসনি। তাই তোকে মেরেছিলাম। কিন্তু আজ এমনভাবে মারবো, যেন তুই চিরদিনের জন্য তোর নাম ভুলে যাস। ’
সারোয়ার বললো, ‘স্যার, সেদিন আপনি আমাকে যেতে দেননি। তাই আমি কয়েক কিলো আখ বিক্রি করতে পারিনি। শেষে সব আখ শুকিয়ে গিয়েছিল। আমার অনেক লোকসান হয়েছে। ঘরে ছেলেটা ভীষণ অসুস্থ। বাকিতে এই আখগুলো এনেছি। আখগুলো বিক্রি করে ধার শোধ করবো এবং ছেলের জন্য ঔষধ কিনব। ’

সারোয়ারের কথা শুনে দাঁত বের করে পুলিশ বলল, ‘তুই মোহাজির। তোকে যেতে দেব না। এখনই দূর হ। ’ বলেই সে সারোয়ারকে কয়েকটি চড় দেয়।
সেই সময় সারোয়ারের গা থেকে শাল খসে পড়ে এবং সে ওটা তুলতে যায়। কান্না ভেজা চোখে সে ট্রাফিক পুলিশকে বলল, ‘আমাকে মারুন, যত খুশি পেটান, আপনার যা খুশি তাই করুন, কিন্তু দয়া করে আমাকে শাহিবাগের গেটের কাছে যেতে দিন। ’

সারোয়ারের কাকুতি-মিনতি শুনে ট্রাফিক পুলিশের মেজাজের পারদ হু হু করে বেড়ে যায়। প্রচণ্ড রাগী গলায় সে বলল, ‘এখনই ভাগ। নইলে তোকে আমি ঠেলাগাড়ির সঙ্গে বেঁধে রাখব। ’

সারোয়ার যতই অনুরোধ করুক না কেন, তাতে ট্রাফিক পুলিশের সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হল না এবং সে কিছুতেই সারোয়ারকে শাহিবাগের গেটের কাছে যেতে দিল না।  
অবশেষে সারোয়ার পুলিশকে বলল, ‘আমি খুব অসহায়। আমাকে মারবেন না। যদি তাই করেন, তাহলে আমি আত্মঘাতী হব এবং আমার গায়ের রক্তে আপনার হাত রঞ্জিত হবে। ’
‘দূর হ’ । নইলে তোকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত গাড়ির নিচে ফেলে দেব। ’ পুলিশ লোকটি বলল ।
কোনো কিছু না ভেবেই অশ্রুভেজা চোখে সারোয়ার বলল, ‘গাড়ি চালকের জন্য আমি কোনো দুর্ভোগ ডেকে আনতে চাই না। আমি আত্মঘাতী হয়ে আপনাকে দায়ী করবো। ’
রাস্তায় চলন্ত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের ফাঁকে ট্রাফিক পুলিশ উচ্চ স্বরে সারোয়ারকে বললো, ‘যা, যা, ওই বৈদ্যুতিক থামের উপর উঠে গিয়ে মর। ’

সঙ্গে সঙ্গে সারোয়ার দৌড়ে লোহার বৈদ্যুতিক থামের উপর উঠতে থাকে। তখন আতংকিত পথচারিরা এবং আশপাশের দোকানিরা বলাবলি করে, ‘দেখ, দেখ, লোকটা ...। ’

সারোয়ার থামের চূড়ায় উঠে ট্রাফিক পুলিশের উদ্দেশে পুনরায় চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘সবাইকে আমি এখন এমন একটা প্রদর্শনী দেখাব, যা আপনি আমাকে দেখাতে বাধ্য করেছেন। ’

নিচ থেকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ বলল, ‘দেখা, দেখা তোর প্রদর্শনী। ’

সারোয়ার দু’টো বৈদ্যুতিক তার তুলে নিজের শরীরের সঙ্গে জড়ালো। বিকট শব্দে শর্ট সার্কিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে বিদ্যুৎ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার উপর নিথর শরীর লুটিয়ে পড়ার আগে সারোয়ার একটা ঝলমলে পাখির মতো বাতাসে ছিটকে পড়ল।

[লেখক পরিচিতি: খান মোহাম্মদ সিন্ধ আফগানিস্তানের একজন কবি, ছোটগল্প লেখক এবং সাংবাদিক। বর্তমানে তিনি কাবুলে বসবাস করেন। ২০০৭ সালে তার প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশের পর তিনি আরো কয়েকটি গল্প অনলাইনে প্রকাশ করেন। নিপীড়িত আফগান শরনার্থীদের অনিশ্চিত জীবনের দুঃখ-দুর্দশা, লাঞ্ছনা এবং টানাপোড়েন তার গল্পের মূল বিষয়। ‘প্রদর্শনী’ গল্পটি খান মোহাম্মদ সিন্ধের ইংরেজিতে ‘দ্য স্পেকট্যাকল্’ গল্পের অনুবাদ। পশতু ভাষা থেকে মূল গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন অ্যান্ডার্স উইডমার্ক। ইংরেজিতে গল্পটি ২০১১ সালের মে সংখ্যা ‘ওয়ার্ডস উইদআউট বর্ডার্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানের শরনার্থী শিবিরে আফগান এক শরনার্থীর জীবনের সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখক এ গল্পটি রচনা করেন। গল্পটিতে দারিদ্রতার এক মর্মান্তিক এবং বিয়োগান্তক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। ]

বাংলাদেশ সময় : ১৩১৬, মার্চ ২১, ২০১২
সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।