ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বুদ্ধদেব বসু : সমকালে ও উত্তরকালে

ড. ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১২
বুদ্ধদেব বসু : সমকালে ও উত্তরকালে

বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাসাহিত্যে কবি এবং কবিতার শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জনকারী বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর ১৯০৮-- ১৮ মার্চ ১৯৭৪) তাঁর জন্মের শতবর্ষ পার করেছেন তাও বছর চারেক হয়ে গেল। খ্যাতিমানদের শতবর্ষ নিয়ে উত্তরপ্রজন্মের মনে ও চেতনায় এক ধরনের বিলোড়ন কাজ করে।

প্রসঙ্গত আমার মনে হয়েছে, জন্মশতবর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে ওই মানুষটিকে, তাঁর কর্মপরিসরকে এবং প্রভাবকে একবার যাচাই করে নেবার কাজটিও চলে, যাবতীয় কথামালা ও কর্মসূচির অন্তরালে।

আমার মনে পড়ে, জন্মশতবর্ষে জীবনানন্দকে নিয়ে যত আলোচনা-লেখালেখি-বিবেচনা হয়েছে, নজরুলকে নিয়ে ততোটা হয়নি। মানিক বিষয়েও খুব আলোড়ন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। আবার কতক সময় এইসব অনুষ্ঠান-উদযাপন কেবল আরোপিতও হয়ে দাঁড়ায়। জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে একসময়ের প্রবল প্রভাবশালী সাহিত্যনির্মাতা বুদ্ধদেব বসু, আজ, উত্তরকালে কী অবস্থানে বিরাজ করছেন? -- তাও বোধকরি সাহিত্য-শিল্পের দরকারি তাগিদে আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দিতে পারে। আর তাই উত্তরপ্রজন্মের কাছে বুদ্ধদেব কতটা অপরিহার্য সে জিজ্ঞাসাও এখন বেশ প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়।

সমকালে সাময়িকপত্র সম্পাদনার (প্রগতি, কবিতা এবং চতুরঙ্গ) মাধ্যমে নবীন-সমকালীন-অনুজ কবি-লেখকদের সাহিত্যিক-আশ্রয় প্রদানের জন্য বুদ্ধদেব অনন্য মর্যাদা ও স্বীকৃতির স্থানটি আজও দখল করে আছেন। সাহিত্যে প্রবলভাবে রাজনীতির প্রবেশকে সাহিত্যচর্চার ভরদুপুরে প্রায় অস্বীকার করলেও শেষবয়সে মার্কিনপন্থায় বিশ্বাসি এই কবি-কথানির্মাতা ও গদ্যশিল্পী আজ আমাদের সহজপাঠের উদার মাঠ থেকে গবেষণার গম্ভীর টেবিলের দিকে ক্রম-অগ্রসরমান। ধারণা করা যায়, বুদ্ধদেবের কবিতায় গতি ছিল, কিন্তু নিবিড় অগ্রগতি ছিল না; নিজেকে, আপন রচনাভঙ্গিকে অতিক্রম না করে হয়তো কেবল প্রতিভাবান বালকের মতো নির্বিবাদে লিখে গেছেন প্রায় সিকিশতাব্দীকাল। তিনি হয়তো অনুভবপ্রাবল্যে এবং একরকম অসচেতনতায় অভিযানের বদলে যাত্রাকেই আত্মস্থ করেছিলেন -- কে জানে সেকথা! অবশ্য তাঁর অনুশীলন ও অভিনিবেশ বিষয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই; অভিযোগ নেই বুদ্ধদেবের শিথিলতাহীন অনলস শিল্প-অন্বেষার প্রতি। তবে একথা ঠিক যে, মনস্তত্ত্ব কিংবা দর্শনে বসুর গভীর আগ্রহ ছিল না, যেমনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের বা জীবনানন্দের। সেকারণেই কি সময়ের প্রবাহে সাধারণের চেতনায় ও অনুকরণ-অনুসরণের জায়গাগুলো থেকে দিনে দিনে দূরে সরে যাচ্ছেন তিনি?

বাঙালির চিরচেনা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ও বাসিন্দা ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বাঙালি সংস্কৃতির আচারে আস্থাশীল এই শিল্পী সামাজিক সম্পর্ক-বন্ধন বা সংস্কৃতির বস্তুগত ভিত পরিবর্তনের দিকে কোনো ঝোঁক অনুভব করেননি। ধারণা বা নীতি প্রচারেও তেমন আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। পৃথিবীব্যাপী প্রবল ভাঙাগড়ার কালে সমূহ বিনাশের পরিপ্রেক্ষিতে কালিক প্রবণতার চিহ্ন ধারণ করে বেড়ে উঠছিলেন তিনি; হয়ে উঠছিলেন সমকালের নাগরিক মধ্যবিত্তমানসের বিশ্বাসচ্যুত-বিচ্ছিন্ন পাটাতনে আমিত্বের একক ক্যানভাস। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে তাঁর সাহিত্যসাধনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই মূল্যবোধ, অবক্ষয়, শ্রেণীচেতনা এবং মধ্যবিত্তসুলভ সংকোচ প্রভৃতি প্রবেশ করেছে। আর তখন তিনি সাহিত্যের মূল্য এবং সাহিত্যের প্রতি পাঠক ও ভোক্তার অনুরাগ সৃষ্টির ব্যাপারে বেশি সতর্ক হয়ে পড়েছিলেন। অন্যভাবে বললে এ রকম দাঁড়ায়-- বাঙালি পাঠকের সাহিত্যরুচি তৈরিতে বুদ্ধদেব বসু বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন। সমকালীন রাজনীতিতে যখন সাহিত্যিকদের অনেকেই সক্রিয়ভাবে চিন্তা বিনিয়োগ করেছেন, তখন বুদ্ধদেব রাজনীতির চেয়ে বিশুদ্ধ সাহিত্য-শিল্প চর্চার দিকে মনোযোগী ছিলেন। যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার কবলে চতুর্দিকে তিনি অবলোকন করেছেন গোলযোগ, দুর্যোগ তাঁর ঘরের দুয়ারে হানা দিয়েছে, দেখেছেন প্রশান্তি-অন্বেষার ব্যাকুলতা। তবে একথা সত্যি যে, সবকিছুর ভেতরে কিংবা অন্তরালে বুদ্ধদেব বসু ক্রমাগত বুদ্ধদেব বসুই হয়ে উঠেছেন।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/bashu20120317184846.jpgকিন্তু আজকে এই মনীষীর জন্মশতবর্ষ অতিক্রম করার পরও আমাদেরকে তাঁর কথা মনে করতে হচ্ছে চেষ্টা করে, চিন্তা করে সাজাতে সময় লাগছে তাঁকে ঘিরে যাবতীয় আয়োজন। তাহলে কি এবেলায় বসে ভাবতে হবে -- মানুষের অন্তঃস্থিত দেবতা ও দানবের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়ে সাহিত্য ও সভ্যতার পরিশুদ্ধি অর্জনের অভিযাত্রায় তিনি প্রগতিশীলতার মহাসড়কে পা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। না-কি যে কারণে মানুষের মনে অন্য মানুষের কথা-স্মৃতি লেগে থাকে অনাবিল আনন্দের মতো, সে কারণের সন্ধান বুদ্ধদেবরা কখনো পেয়ে ওঠেন না। অথবা এমনও হতে পারে শেষত মানবসভা থেকে পালিয়ে বাঁচার একধরনের মহাজনিপন্থায় মনে মনে আস্থাশীল ছিলেন ব্যক্তি বুদ্ধদেব বসু। সমকালের বৈশ্বিক ও শৈল্পিক প্রেক্ষাপটের নিবিড়ভুবনে জেগে থাকা বুদ্ধদেবকে সময়ের পরিভ্রমণের কিংবা ব্যক্তিক-পরিচর্যার উত্তরপর্বে খুঁজে পাওয়া ভার।

তৎকালীন ভারতবাসীর (বাঙালির কি?) জীবনের স্নিগ্ধ উপকূলে লুব্ধতার লালাকে অগ্রাহ্য করে, ভয়কে অস্বীকার করে, অভিশাপ ও অসহিষ্ণুতাকে সঙ্গী ভেবে বুদ্ধদেব নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন জীবনের চরম মূল্যের নিঃশব্দ আলোকসভা। অনুভূতিপাগল এই শিল্পীর মনের সৌকর্য প্রকৃতির আনুগত্য আর চারিত্রিক চঞ্চলতায় উদ্ভাসিত। তিনি হয়তো জানতেন -- পাপের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয় পুষ্প। “উপলব্ধি” কবিতায় বসু জানাচ্ছেন তাঁর এক বিশেষ অনুভবের কথা: “হে বাংলা, আমার বাংলা,/ কী যে অনির্বচনীয়/ হৃদয়-মন্থন-করা তোমার অমিয়। / যেখানে দুর্বল তুমি সেখানে দুঃখের শেষ নেই,/ যেখানে তোমার শক্তি, সেথা তুমি অনাক্রমণীয়। ” অনত্র, “রবীন্দ্রনাথের প্রতি” কবিতায় বুদ্ধদেব আমাদেরকে জাগানোর চেষ্টা করছেন এভাবে: “শোনো ভাই, মনুষ্যত্বে সকলেরই আছে অধিকার,/ এ-জীবন তারি, যার হাতে জীবনের রচনার ভার। ” বসুর সাহিত্য-অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, মাঝে মাঝে অনিশ্চিত উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে কাটাতে তিনি উদ্দীপিত কবিতার উচ্চকিত কণ্ঠস্বর হতে চেয়েছিলেন। পরান্নভোজির পাপ কিংবা লোভ আর লাভের জঘন্য বর্বরতাকে পাশকাটাতে গিয়ে মধ্যে মধ্যে অবলোকন করেছেন মিথ্যার আর অযোগ্যের প্রতিষ্ঠা ও স্থিতির ভয়াবহতা। বুদ্ধদেব জানতেন -- “সবি জীর্ণ হয়ে আসে” এবং “কালস্রোত সর্বগ্রাসী”; আর সম্ভবত তিনিও ওই সব জীর্ণতার স্বাভাবিক নিয়মের কবলে পড়ে অথবা কালের সর্বপ্লাবি  স্রোতের টানে পড়ে আমাদের চেনাজগতের বাইরে চলে যেতে বসেছেন। আলো-আশা, দুরন্ত আলোড়ন, প্রাণের তরণী আর নবজীবনের ডাকে যুগান্তরে বুদ্ধদেব আজ জ্ঞানসাধনার নিবিড়ভুবনের উপাদান হয়ে উঠছেন যেন। বুদ্ধদেবের আরেকটি কবিতার অংশবিশেষ এখানে পরিবেশন করছি, প্রাসঙ্গিক মনে করে: “শূন্যে চেয়ে শূন্য মনে বেলা কাটে। / বিষণ্ন মলিন দিন। নেই গান, নেই স্বচ্ছন্দ ভ্রমণ/ নবীন সবুজে। ” (দুই বর্ষা) বুদ্ধদেব অপরাধীকে ক্ষমা করার পক্ষপাতি ছিলেন, ঘৃণার বদলে উপেক্ষাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন সারাজীবন। না-পাওয়াজনিত আক্ষেপের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর সচেতন অবস্থান, জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে অল্প আয়োজনে তিনি দেখেছেন অতিদূরের কেউ বা কিছু হয়ে ওঠে কাছের; আবার অতিকাছের কিছু অথবা কেউ চলে যায় দূরে -- অতি দূরে। অনুচ্চারিত দ্রোহ কিংবা নিষ্ফলা প্রতিবাদের বন্ধ্যাত্বের প্রতিভাস তাঁর চিন্তার প্রতিফলনে দৃশ্যমান। কিন্তু, হয়তো নিজের অজান্তেই কবিতায় বলেছেন প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা। বলছেন: “যদি না ঝঙ্কারি’ ওঠে ধিক ধিক আমার বীণায়,/ তবে ব্যর্থ কবিজন্ম -- মনুষ্যত্ব, তাও তবে বৃথা। / পশুত্বের প্রতিবাদে নিখাদে রেখাবে আজ হোক উদ্দীপিতা/ আমার কবিতা। ” আজ আমাদের বিনীত জিজ্ঞাসা -- বুদ্ধদেব যে ঘৃণার বদলে ক্ষমা করার কথা ভেবেছেন, তাতে কি তাঁর অন্যায় হয়েছে? আর সে অন্যায়ের জন্যই কি সময় (সমকাল থেকে উত্তরকালে যাবার একমাত্র বাহন) তাঁকে ক্ষমা করেনি? তিনি কি তবে আত্ম-অনুসন্ধান করতে গিয়ে গ্লানি, বিতৃষ্ণা আর অবসাদগ্রস্ততায় আটকে পড়েছেন অসহায়ের মতো?

সত্য আর সুন্দরের সন্ধানই যদি শিল্পের দায় ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তবে আজ, পৃথিবীতে যাবতীয় অসত্য, অযোগ্যতা আর অপরাধের স্থিতি ও প্রতিষ্ঠার মহাসমারোহের কালে, বলতে ইচ্ছে করে -- সত্যের জয় আর মিথ্যার পরাজয় নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন কোনো শিল্পী কিংবা কোনো কবিতা-কারিগর অথবা কে সেই অমিতশক্তি কথানির্মাতা? বিনীত প্রশ্ন উত্থাপন করতে মন চায় -- বুদ্ধদেবরা যে কথা শিল্পপরিচর্যায় বলতে চেয়েছিলেন কিংবা পৃথিবীতে যে শুভবোধ প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় বুকে ও মনে ধারণ করেছিলেন, সে অভিপ্রায়ের সকলকিছু কি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে? না-কি বুদ্ধদেবের মতো ময়লাধরা (?) সুন্দর ও সৌকর্যের পূজারীদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে? এসব প্রশ্নের বোধগম্য উত্তর পাওয়া নিশ্চয় সহজ হবে না। বিশ শতকের তিরিশের দশকে বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রায় প্রধান পুরুষ, অভিভাবক ও বিচরণশীল বুদ্ধদেব বসু তাঁর আপসকামিতাকে ধারণ করে নিজের অপরিহার্যতার গর্বকে ম্লান করেছেন কি-না সে জিজ্ঞাসাও উত্তরকালের গবেষকদের কাছে ধীরে ধীরে পরিচিত ও বিবেচ্য হয়ে উঠছে। বুদ্ধদেব সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য আহ্বান করেছিলেন। আর সে জীবনের দরকার হয়তো শেষ হয়ে গেছে। এসব অজানা কথার সমাধানের জন্য অধীর অপেক্ষার চোখে তাকিয়ে থাকতে হবে প্রখ্যাত কোনো অধ্যাপক বা গুণী গবেষকের একাডেমিক কিংবা তাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফলের দিকে।

বাংলাদেশ সময় : ১৭১৫, মার্চ ১৭, ২০১২
সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, সম্পাদক শিল্প-সাহিত্য

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।