ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আফগানিস্তানের ছোটগল্প

কম্পোজিশন

মূল : আজম রাহনাওয়ার জারিয়াব, অনুবাদ : ফজল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১২
কম্পোজিশন

আমি তখন এলিমেন্টারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই শিক্ষক এসে বললেন, ‘বয়েজ ...।



বলেই তিনি মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে শ্রেণীকক্ষের উল্টোদিকে হেঁটে গেলেন । দেখে মনে হল, তিনি মেঝের উপর বিছানো স্লেইট পাথর গুনছিলেন। তখন তাকে বামুনের মতো খুবই বেঁটে দেখাচ্ছিল। সত্যি বলতে কি, আমাদের শিক্ষক আসলেই একজন অতি ক্ষুদ্র আকৃতির মানুষ ।

হঠাৎ দেয়ালের কাছে গিয়ে তিনি থামলেন। তারপর এমন ভঙ্গিতে উপরের দিকে তাকালেন যেন তিনি এইমাত্র স্লেইট পাথর গোনা শেষ করলেন। তার ঠোঁট দু`টো কয়েকবার কেঁপে উঠল। অবশেষে তিনি মুখ খুললেন।

‘আগামীকাল তোমরা প্রত্যেকে বসন্তকালের উপর রচনা লিখে আনবে,’ তিনি বললেন।
এটা আমাদের জন্য একটা বিস্ময়। শিক্ষকের মুখের দিকে আমরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। তখন ‘বসন্তকালের উপর রচনা’ শব্দগুলো আমাদের কানের ভেতর রিনরিন করে বাজছিল। আমরা সবাই হতবাক, রীতিমতো স্তম্ভিত।
 
আমাদের মনের অবস্থা শিক্ষক হয়তো বুঝতে পেরেছেন। আমাদের কি করা উচিত, তাই তিনি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। ‘নিশ্চয়, তোমরা বুঝতে পারছো, আমি কি বলতে চেয়েছি। তোমরা বসন্তকালের উপর রচনা লিখবে। বলবে, বসন্তকালে লোকজন কি করে কিংবা জন্তু-জানোয়ারেরা কি করে – এসব বিষয়। ’

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/desk20120307144837.jpgশিক্ষক মনে করেছেন আমরা তার মতোই বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ। তাই তিনি ভেবেছেন, এটুকু বিবরণই আমাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তখনো আমরা ‘বসন্তকালের উপর রচনা’ লেখার বিষয় নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলাম।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় আর কিছুই ভাবতে পারিনি। শুধু ভাবছিলাম ‘বসন্তকালের উপর রচনা’, যা আমাকে আগামীকালের মধ্যেই লিখতে হবে।

বাড়ি ফিরে এসে আম্মাজানকে জিজ্ঞেস করি, ‘আম্মাজান, আপনি কি জানেন, রচনা কি জিনিস?’
আম্মাজান বড় বড় চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না বাবা, আমি জানি না। তুমি কি আজই এটা শিখেছ ?’

‘আমি শিখিনি’ আমি বললাম। ‘কিন্তু আমাকে একটা রচনা লিখতে হবে। বসন্তকালের উপর রচনা লিখে আগামীকাল স্কুলে যেতে হবে। ’

দুপুরের খাবার খেয়ে আমি লিখতে বসি। অর্থাৎ আমি কাগজের উপর থেকে লেখা শুরু করি, কিন্তু লেখা শেষ করতে পারিনি। আমি জানি না, কি লিখতে হবে। তাই শুধু ভাবতে থাকি। আমার মাথায় কিছুই আসে না। অবশেষে চেয়ার থেকে উঠে আমি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই এবং বাইরের উঠানের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি।

আমাদের উঠানের গাছের ডালে অসংখ্য চড়ুই পাখি। সবুজ পাতার ফাঁকে চড়ুই পাখিগুলোকে হলুদ দেখাচ্ছে। উঠানের এক কোণে ধূলোবালির মধ্যে আমাদের মুরগিটা খেলা করছে। আমার কাছে মুরগিটার রঙ নীল বলে মনে হলো । অন্য ছোট পাখিগুলো ছাদের ফাঁকে বাসা তৈরি করছে। ওগুলোকে মাছের আকৃতির ঘুড়ির মতো দেখাচ্ছে। একসময় নজরে এলো আমাদের বিড়ালটা। ও সূর্যের তাপ কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। তাই বিড়ালটা দেয়ালের আড়ালে ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। আমার কাছে বিড়ালটা সবুজ রঙের মনে হল।

পুনরায় আমি লেখার প্যাড খুলে বসি। এবারও কিছুই লিখতে পারলাম না। মন ভীষণ খারাপ এবং সত্যি আমার দারুণ কষ্ট হল। ঘর থেকে বেরিয়ে আমি সরু গলির দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে একাগ্র মনে ভাবতে থাকি।
 
সে সময় নানা কিসিমের ভাবনা এসে আমার মস্তিস্কে জমা হতে থাকে। কিন্তু তখনও শিক্ষকের কথাগুলো আমার মগজের দেয়ালে ধাক্কা দিচ্ছিল– ‘বসন্তকালের উপর রচনা’– ‘এ কম্পোজিশন অ্যাবাউট স্প্রিং’।
 
আমি যখন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন, তখন তাকিয়ে দেখি আমাদের প্রতিবেশী ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। তার দেহের গড়ন ঋজু এবং দীর্ঘ। আব্বাজান আমাদের প্রায়ই বলতেন, ভদ্রলোক নাকি একসময় কবি ছিলেন। দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে বসা আমাকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন।
‘মন খারাপ কেন?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমাদের শিক্ষক একটা রচনা লিখতে বলেছেন। ’ ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, ‘বসন্তকাল সম্পর্কে। ’
‘এবং তুমি তা লিখতে পারছো না, তাই না?’ তিনি বললেন।
‘তাই। ’ মাথা নিচু করে আমি অস্ফুট স্বরে বললাম।

আমার কথা শুনে ভদ্রলোক হাসতে শুরু করেন। তিনি কাছে এসে আমার একটা হাত তার হাতের মুঠোয় তুলে নিলেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্য হাতের আঙুল ঘুরিয়ে বাতাসের মধ্যে বিশাল একটা অর্ধবৃত্ত তৈরি করলেন।

‘তোমার চারপাশে তাকিয়ে দেখো,’ তিনি বললেন। ‘যা কিছু তোমার দৃষ্টিগোচর হবে, তাই লিখবে। তাহলেই বসন্তকাল নিয়ে রচনা লেখা হয়ে যাবে। ’

হঠাৎ আমার মনের ভেতর সবকিছু স্বচ্ছ হতে থাকে। ‘তাই তো!’ একসময় আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠি। তারপর তড়িৎ বেগে ঘরে ফিরে এসে পুনরায় আমি জানালার পাশে দাঁড়াই। ঘর থেকে বেরোনোর সময় সবকিছু দেখতে যেমন ছিল, এখনও ঠিক সে রকমই আছে। গাছের ছায়ায় বসে ভাত রান্না করার জন্য আম্মাজান চাল পরিষ্কার করছেন।

কলম নিয়ে আমি খাতার উপর শিরোনাম লিখি, ‘এ কম্পোজিশন অ্যাবাউট স্প্রিং’।

তারপর আমি লিখলাম, ‘বসন্তকালে হলুদ রঙের চড়ুই পাখিরা গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে ওড়াউড়ি করে। ধূলোবালির মধ্যে নীল রঙের মুরগি খেলা করে। দেখতে ঘুড়ির মতো, অথচ মাছের আকৃতির, ছোট্ট পাখি বাসা বানায়। সবুজ রঙের বিড়াল রোদ পছন্দ করে না। তাই সে দেয়ালের আড়ালে ছায়ায় ঘুমায়। আম্মাজান গাছের ছায়ায় বসে চাল পরিষ্কার করছেন, যা তিনি পরে রান্না করবেন। বসন্তকালের আকাশ মেঘহীন, স্বচ্ছ। চতুর্দিকে মৌমাছিরা ওড়াউড়ি করে। স্কুলের ছেলেরা বসন্তকালের উপর রচনা লেখায় ব্যস্ত। ’ এর বেশি কিছু লিখতে পারিনি। কিন্তু যেটুকু লিখেছি, তাতেই আমি দারুণ খুশি।

পরদিন ক্লাসে শিক্ষক আমাদের সবার রচনা নিয়ে আলোচনা করেন। একসময় আমার পালা এলো। আমি কি লিখেছি, শিক্ষক তা পড়ে শোনালেন। তারপর তিনি এক মুহূর্তের জন্য কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। সে সময় আমার বুকের ভেতর দ্রুত গতিতে শব্দ হচ্ছিল। শিক্ষক ইশারায় আমাকে তার ডেস্কের দিকে যেতে বললেন। আমি ভীরু পায়ে এগিয়ে গেলাম।

চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় ফুটিয়ে শিক্ষক বললেন, ‘তোমার আব্বাজানকে বলো তিনি যেন তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ’
‘কেন, স্যার?’ ভয়ে ভয়ে আমি জিজ্ঞেস করি।
‘মনে হয় তোমার চোখে সমস্যা আছে। তুমি ঠিক মতো দেখতে পাও না। ’ জবাবে তিনি বললেন।
‘চোখ তো আমার ভালোই আছে, স্যার। ’ আমতা আমতা করে বললাম।
সরাসরি আমার মুখের উপর তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি নিশ্চয় জানো, চড়ুই পাখি দেখতে হলুদ রঙের হয় না, মুরগিও নীল রঙের হয় না এবং কোন বিড়ালই সবুজ রঙের হয় না। এগুলোর কোনটাই ঠিক না। বুঝতে পেরেছো?’
‘হ্যাঁ,’ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বললাম।
রচনাটি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে শিক্ষক বললেন, ‘এখন যাও। ’
রচনাটির দিকে তাকিয়ে দেখি, লাল কালিতে বিরাট বড় করে ‘ক্রস’ চিহ্ন। অশ্রুতে আমার দু’চোখ ভরে গেল। ‘ক্রস’ চিহ্নটা আমার কাছে মনে হলো আড়াআড়িভাবে দু’টো রক্তাক্ত তলোয়ার।


[লেখক পরিচিতি: আজম রাহনাওয়ার জারিয়াবের জন্ম ১৯৪৫ সালে, আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ডিগ্রি অর্জণ করেন। স্কুল জীবন থেকেই কাবুলের বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং জার্নালে তার ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। তিনি বিভিন্ন লেখকের অসংখ্য লেখা ইংরেজি থেকে ‘ডারি’ ভাষায় অনুবাদ করেন। একসময় তিনি আফগান রাইটার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি স্থায়ীভাবে ফ্রান্সের অধিবাসী। ‘কম্পোজিশন’ গল্পটি আজম রাহনাওয়ার জারিয়াবের ‘ডারি’ ভাষায় রচিত এবং ড. এস. ওয়ালী আহমাদীর ইংরেজিতে অনূদিত ‘দ্য কম্পোজিশন’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ২০০০ সালের এপ্রিল-জুন সংখ্যা ‘আফগানম্যাগাজিন.কম’-এ প্রকাশিত হয়। ]

বাংলাদেশ সময় : ১৪২৮, মার্চ ৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।