ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

একটি ঢ্যামনা সাপের গল্প

রিংকু সারথি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৯ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১২
একটি ঢ্যামনা সাপের গল্প

galpo পুরুষদের মধ্যে অনেকেই পরিণত বয়েসে কেউটে হয়। তবে সবাই-ই আঠারো বছর পর্যন্ত ঢ্যামনা থাকে।

ঢ্যামনাদের মধ্যে কারও কারও আঠারোর পর হতে দাঁতের গোড়ায় বিষ জমতে শুরু করে। এরপর হতে নিয়মিত বিষ উগরাতে না পারলে ওদের জীবন-যাপন কষ্টকর হয়ে ওঠে।

আমাদের গল্পের নায়ক নান্টু মিত্তির তেমনই একটা ঢ্যামনা, ঢ্যামনা সাপ। ওর শরীরে বিষ উৎপন্ন হয়েছে বছর দু’য়েক আগে। কিন্তু সে বিষ এখনও ওর দাঁতের গোড়ায় এসে জমা হয়নি। তাই বিষের যন্ত্রণায় ও এখনও পাগল হয়নি। তারপরও এক আষাঢ়ের রাতে হঠাৎ করেই মতিভ্রম হলো নান্টুর। হলো একটি নারীকে দেখে। নারীটির বয়স কত, ছিরি-ছাত কেমন, তা পাঠক গল্পের গভীরে প্রবেশ করলেই বুঝতে পারবেন।

সেদিনের কথা। বিকেল হতেই আকাশে ঢাক গুড় গুড় বাজছিল। গলাচিপা বন্দরের হাট ভাঙতেই পরিবেশ-প্রকৃতি সব ছেয়ে গেল অগণিত বিটুমিন রঙা সন্ধ্যায়। ভেজা ব্লটিং পেপারের মতো আকাশ চুঁইয়ে ঝরতে থাকলো প্যান-প্যানে বৃষ্টি। আর বৃষ্টি চিরে মাঝে মাঝে ফণা তুলতে থাকলো দক্ষিণ থেকে ধেয়ে আসা ডাকিনী বাতাস।

সারা দিনের ভিখমাঙা বিভিন্ন বর্ণের সের খানেক চাল আর দু’চারটে আগা মাথা ভাঙা সবজির টুকরো আঁচলে বেঁধে, কালীদাসী বাড়িমুখো হয় সাব-রেজিস্ট্রি আপিসের রাস্তা ধরে। উপজেলা সরকারের সাধ্য হয়নি এ রাস্তায় বালু সিমেন্ট ঢালতে-বিগত পাঁচ বছরেও। বৃষ্টি-বাদলার জলে শ্যাওলা জমে জমে তাই রাস্তার শেয়ালরঙা ইটগুলো কালচে-সবুজ হয়ে গেছে। সেই পিচ্ছিল ইট দু’পায়ের নখে আঁকড়ে ধরে ধরে এগিয়ে চলে কালীদাসী।

রাস্তার দু’পাশে পিঠা পাকুড় আর বন্য অশ্বত্থের ঘন সারি। তাদের ডালপালা ধরে দোল খায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে-মাঝে খ্যাপাটে বাতাস বয়-আর সেই বাতাসের ঝাঁপটায় অন্ধকার নড়ে উঠে ডাকিনী হাসিতে ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ে। আবার মুহূর্তেই নিরেট হয়ে যায় অন্ধকার। বাতাস আর আঁধারের দাপটে আঁইঢাই করে কালীদাসীর প্রাণ। যত পারে দ্রুত পা চালায় সে।

দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করছে ওর দু’বছরের নাতি, উদোম গা আর নাঙ্গা পাছায়। সারাদিনের না খাওয়া নাতির শুকনো মুখখানা মনে পড়তেই বুক ধরে আসে কালীদাসীর। আরও জোড়ে পা চালায়। কিন্তু উত্তর পঞ্চাশীয়া গোড়ালী ওর, খুব একটা বেগ তুলতে পারে না।

..কালী দিদি....ও কালী দিদি...। পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ধরে প্রাণ ফিরে আসে কালীদাসীর। দু’দণ্ড দাঁড়ায়।   দেখে মিত্তির বাড়ির ছোট ছেলে নান্টু মিত্তির। কাছে এসে নান্টু বলে, এই ঘুট-ঘুইট্যা রাইতে কোম্মে গোণে আইলা গো কালী দিদি?

কালী বলে ‘হারাদিন হাডে ভিক্ষা করছি। হাড ভাঙতে ভাঙতে রাইত অইয়া গ্যালো। এই পতে সঙ্গী-সাতী কেউ নাইক্যা, হের ফান্যে একলাই বাড়ি ফিরতাছি। ’

-ভালা করছো, লও  এক লগে বাড়ি যাই।
-চল।
মিনিট দু’য়েক পথ চলার পর নান্টু বলে, ও দিদি দাদায় য্যান মারা গ্যালো কোন বছর?
কালী বলে, মন্বন্তরের আগের বছর।
-তয় তুমি আবার বিয়া করলা না ক্যান?
-পাগলে কয় কি দ্যাহ! হেকালে মোর বয়স অইছিল দুই কুড়ি এগার। ছোড পোলা নিমাইরে বিয়া করাইলাম না হেই বছর?
-কী যে কও দিদি! তোমারে তো এহনও একবার বিয়া দেওন যায়।
-কস্ কী লো হজমোক্কার পো...! বলে  কিট কিট করে হাসে কালী চলার গতি আরও দ্রুত করে।

চলতে চলতে নান্টু কালীর বাম হাতখানা ধরে বলে, সত্যি কইছি দিদি- তুমি এহনও ম্যালা টাইট-ফিট আছো। চেহারাডা এহনও বাতিল হইয়া যায় নাই।

এবার দাঁড়িয়ে পড়ে কালী। নিজের হাত ধরা নান্টুর হাতখানা দেখার চেষ্টা করে। নিরেট অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। তবুও হাতের শেষে কাঁধ আর কাঁধের ওপরে নান্টুর মুখের দিকে অনুমান করে তাকায় সে। কৃষ্ণ সবুজ অন্ধকারে নান্টুর চোখ দু’টো চোখ কুপিবাতির ফলার মত ঝিলিক ছুড়ে চলছে। একষট্টি বছরের নারীর প্রতি উনিশ বছরের কিশোরের কামক্রোধ-ভেবে ঘৃণায় বিবমিষা হয় কালীদাসীর। ঝাটি মেরে হাত ছুটিয়ে নিয়ে বাজখাই কণ্ঠে বলে- ঢ্যামনার পো ঢ্যামনা! তোর ঠাম্মার হমান বয়স মোর। কী করতে আছোস হুশ আছে!!!

হাত ছুটে গেলে কালীদাসীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নাণ্টু। বলে- খালি বয়স অইলেই হগল মানুষ বুড়া অয় না। লও রাস্তার পাশে হোগলা বাদারে লও। হারাদিন ভিক্কা কইরা যা পাইছো, হের চিক্কা চাইর ডবল বেশি দিমুআনে।

নান্টু কালীকে হোগলা বাদারের দিকে টানে-আর ভাবে, পুরুষ মানুষের বিষের এমনই যন্ত্রণা। ক্ষ্যাণে-ব্যাক্ষাণে খালি শূলানি ওডে। বিষটা একবার নামাইতে পারলেই অয়। ছুড়ি না বুড়ি হেয়া কেডা দেকতে যাইবো এই আন্দাইরা রাইতে!

কালীদাসী নন্টুর বলের সাথে না পেরে উঠে মিনতি করে বলে- তুই আমার বাপ নান্টু। এমন অধম্মো করিস না। তুই যা করতে চাইতাছোস, তা করলে আকাশ ভাইঙ্গা পড়বে এই পৃত্থিমীতে। ...আমি তোর ঠাম্মার চাইক্যাও বয়সে বড়।

নান্টু কালীকে হোগলা বাদারের দিকে টানতে টানতে বলে- ঐ হানে চলো। দেখপা আনে ছুডু-বড় ব্যাবাক এক হমান হইয়া যাবে আনে।

কালী মিনতি করে বলে, এমুন কাম আমি এহন পারিনারে বাপ!! নিমাইর বাপে মইরা যাওনের ম্যালা আগে থাইক্যাই পারিনারে বাপ। আমারে তুই মাপ কর বাপ।

কালী দাসী যতই কাকুতি মিনতি করে, নান্টু ততই ওকে জোড় করে হোগলা বাদারের দিকে নিয়ে যেতে থাকে।

ছ্যাছড়ানি খেতে খেতে এবার চিৎকার করে ওঠে কালী বলে, শয়তানের রক্তে, ডাইনের প্যাডে তোর জরমো। ষাইট বছরের বুড়ির লগে আকাম করতে চাস!!!হায় ভগোবান, অর পুষ্যাদণ্ড ভাইঙ্গা দেও-ঠাডা ফালাইয়া  অরে ভষ্ম কইরা দেও...।

বলতে বলতে ঝট্কা মেরে কোনো রকমে নিজেকে ছুটিয়ে ফেলে কালী দাসী নান্টুর কবল থেকে। তারপর পড়ি-মরি করে ছোটে সামনের দিকে। ততক্ষণে বৃষ্টি মুষলধারে হয়েছে। আঁচলে বাঁধা চাল-সবজি ভিজে ওজনে তিনগুণ হয়েছে। সেই বোঝা নিয়ে দৌড়ানো দায় হয় ওর। চলতে গিয়ে বার বার হোচট খায় কালীদাসী। নান্টু ছুটে আসে ওকে ধরতে। কালীদাসী কোনরকমে উঠে আবার ছোটে।

হঠাৎ ও খেয়াল করে, রাস্তার ডানপাশে শান্তি ব্যাপারীর মুদি দোকানের ভেতর টিম টিম করে কুপি জ্বলছে। নিজকে ঝড়ের বেগে ছুটিয়ে নিয়ে মুদিখানার আধা ভেজানো ঝাঁপের ওপর ফেলে কালীদাসী। তারপর গগণবিদারী কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে... ও শান্তি ঝাঁপ খোল..ঝাঁপ খোলরে ও শান্তি...ও বাপ ঝাঁপ খোল। দ্যাখ ঢ্যামনার পো ঢ্যামনায় আমার ভাঙা খোলায় খই ভাজতে চায়রে..আমার ভাঙা খোলায় খই ভাজতে চায়..!!!!

বাংলাদেশ সময় ১৭৪৫, মার্চ ৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।