ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নাসরীন জাহানের ছোটগল্পের পরিবেশনশৈলী

ড. ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১২
নাসরীন জাহানের ছোটগল্পের পরিবেশনশৈলী

বাংলাদেশের সাহিত্য-পরিপ্রেক্ষিতে নাসরীন জাহান [জন্ম : ৫ মার্চ ১৯৬৪] অবশ্য বিবেচ্য কথানির্মাতা। বিশ শতকের আশির দশকে একটি বিশেষ সাহিত্য-প্রসারের কালে তাঁর আবির্ভাব।

প্রায় তিনদশককাল কথাসাহিত্য-পরিসরে বিচরণ করে তিনি বর্তমানে কুড়িয়েছেন সম্মান-মর্যাদা-গ্রহণযোগ্যতা; পার করেছেন উৎকর্ষের পথে আত্ম-অতিক্রমের বিভিন্ন বাঁক ও প্রতিকূলতা। নাসরীন তাঁর চিন্তার পরিবেশনভঙ্গিতে সাফল্যের সাথে যুক্ত করতে পেরেছেন আন্তর্জাতিক আবহ ও প্রকাশ-প্রযুক্তি। নান্দনিকতা ও সংবেদনশীলতায় তাঁর গদ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং ভাবনা-উদ্রেককারী। কল্পনায় ভর করে বাস্তবের গভীরে প্রবেশ ও সত্য-অন্বেষা, মনঃসমীক্ষণ, ব্যক্তির আর্থিক কষ্টের উপাখ্যান, মানুষের পরাজয়-গ্লানি-বিরক্তির ক্যানভাস তৈরিতে তিনি সতর্ক শিল্পী বলে মনে করা হয়। জীবনের টিকেথাকা-না-থাকার ব্যাপারাদি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিত্ববোধ, সামাজিক সমূহ সংকট নাসরীন জাহান অনুভব করেছেন আপনশক্তিতে; বর্ণনা করেছেন ওইসব বিষয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ-ফল। নাসরীনের ছোটগল্পে সমাজের চেয়ে ব্যক্তি আর মানুষের চেয়ে তার অনুভূতি প্রাধান্য লাভ করেছে নানান অবসরে।

শিল্পকে নাসরীন জাহান সুনির্বাচিত অনুভবের সমষ্টি না ভেবে ব্যক্তির প্রাতিস্বিকতার বিবরণ-ভূমি বানাতে চেয়েছেন। চিন্তা এবং প্রকাশ কৌশলের বিবর্তন ঘটলেও তিনি সাহিত্যবোধে প্রথম থেকেই অটল ও স্থিতধী।

ছোটগল্পের কাঠামোয় প্রবেশ এবং বিচরণ-বিষয়ে তাঁর আপন-অভিব্যক্তির খানিকটা পাঠকের জন্য হাজির করছি:  ‘এক সময় আমি উপন্যাসের বি¯তৃত পরিধির মধ্যে বিচরণ করতে করতে অনুভব করি, সবচাইতে কঠিন গল্প লেখা। একটি গল্পের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হাঁটা যায় না। একটি বি¯তৃত বিষয়কেও কমপ্যাক্ট করে সেখানে একটি পরিধির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। সেই কঠিন পথে হাঁটা আমি ছাড়িনি। ক্রমান্বয়ে চেষ্টা করেছি গল্প নিয়ে বহুমাত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার, যে নিরীক্ষার ফাঁকে আটকে থাকে যে-কোনো শিল্পের চিরায়ত সত্য-প্রাণ, সেটা যেন না হারায়। ... তাই কাঙ্ক্ষিত লেখাটির স্বপ্নে প্রতিদিন হাঁটি। সেই হাঁটা কখনো প্রথাবদ্ধ, কখনো সুররিয়ালিজম, কখনো যাদুবাস্তবতা, কখনো হয়ে ওঠে প্যাঁচ গোজের ফাঁস থেকে বেরিয়ে সরল ধারায় হাঁটার পথ... আমি লিখি না, লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে বদলে বদলে হাঁটার চেষ্টা করি। ’ [ভূমিকা, নির্বাচিত গল্প, অন্যপ্রকাশ ২০০২]

‘আমাকে আসলে কেমন দেখায়’ গল্পটি পাঠ করতে থাকলে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করি মানসিকভাবে অসচ্ছল একজন মানুষের আত্মপ্রতিফলনের প্রকট পাটাতনের বিপরীতের কোনো অজানা অন্ধকারে। মানুষটি তার নিজের অবস্থান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নয়; তবে সে আপন অস্তিত্বও আবিষ্কার করতে পারতো না, যদি না এই মন্তব্যটি না শুনতো: ‘একজন শুধু বলেছিল, তোমাকে ভদ্র দেখায় না। ’ অবশ্য তারপরও অনবরত চাকরি খুঁজবার কালে ‘ছায়াসিঁড়ি টপকে অভিজাত ড্রয়িংরুমে’ প্রবেশ করা এই মানুষটি তার ব্যক্তিগত পরিচয়ের চেয়ে চারপাশে সামাজিক পরিচিতির প্রয়োজনটাকেই অনুভব করেছে। নিজের রুচিবোধের দারিদ্র্য এবং আপাত অভদ্রতা বিষয়ে সে একটি ব্যাখ্যা অন্তত খুঁজে বের করতে পারে। তার ভাবনার বিষযাবলি এরকম: ‘সে কি এজন্যই যে আমি অত্যন্ত দরিদ্র? একাধিকবার পাল্টানোর জন্য আমার কোনো কাপড় নেই? সে তো অনেকেরই নেই। তবে? আমি গাঢ় রঙ পরি যাতে বারবার ধুলেও উজ্জ্বলতা থাকে। একজন গরিব মেয়েকে অবশ্য হালকা রঙেই মানায়। আয়নায় মুখ ফেলে দেখেছি, কোথায় অসঙ্গতি? কোথায় আমার রুচির সমস্যা? ভুরু প্ল্যাক করা ঠিক হয়নি? একপাল ভাইবোনের সংসারে এটা সম্ভবত মানানসই নয়। কিন্তু আমি যখন রাস্তায়, তখনো কি আমার পিঠে আমার সংসারের লেবেল আঁটা থাকে? তবে যে পদে পদে ধরা খাচ্ছি?’ বোধকরি দরিদ্র ও অসহায় কিংবা জীবনের চাপে নেতিয়ে পড়া এই নারী তার পেছনে অনুসরণকারীর পদচারণায় বিপদগ্রস্ত হয়; বাঁচবার সাধও মাঝে মধ্যে ফুরিয়ে যায়; অন্যের অবহেলা টের পায় সে, রাজনীতির আলাপ অথবা ছায়া গলিটার প্রভাবও সে কিছুতেই পাশ কাটাতে পারে না। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারে না ‘কী করে একজন মানুষের মধ্যে সুরুচি নির্মিত হয়?’ নাসরীন জাহান গল্প নির্মাণ করতে গিয়ে এই মেয়েলোকটির আজন্ম মিনমিনে স্বভাব, তার স্বপ্নভঙ্গের চালচিত্র, গন্তব্যহীনতা এবং মানসিক অস্থিরতার সামান্য কতেক বিষয় পরিবেশন করেছেন। আর অসহ্য রাতে মেয়েটি যে কুয়াশা পতনের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পায়, সে কথাও জানাতে ভুল করেননি তাঁর পাঠককে। বস্তুত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের গল্প এটি। ব্যক্তির আত্মপ্রতিফলনের বিবরণভাষ্য।


ধর্ষণের ফলে গর্ভপাত এবং নারীর অস্তিত্ব-সংকটের ছায়া কাঠামোয় নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘কাঁটাতার’ গল্পের ক্যানভাস। এই কাহিনিটির বিন্যাস আপাতভাবে অগোছালো মনে হবে। অবশ্য ভেবে দেখলে বুঝা যায় এই অবিন্যাস্ত হবার ব্যাপারখানি- যেখানে জীবন ও মন এবং সামাজিকতা ও সংসার স্থির ও সুবিন্যস্ত নয়, সেখানে নির্মাতা কীভাবে সুগঠিত গল্প বানাবেন। চরিত্রের বাস্তবতা ও তার চারপাশের নিত্যসত্যকে ধরতে গেলে এছাড়া আর নাসরীনের কী-ই বা করার ছিল। ধর্ষিত নারীর যৌনসুখ কিংবা মাতৃত্বের হাহাকারের মধ্য দিয়েও তিনি কেবল সাজিয়েছেন চরম বাস্তব কিন্তু সামাজিকভাবে অস্বীকৃত কিছু বিষয়ের সমাচার। খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে: ‘প্রথমজন উপগত হলে খুব আশ্চর্যজনকভাবে কুন্তলা টের পায় অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে, উষ্ণ, সোঁদা সোঁদা গন্ধে ডুবে যাচ্ছে প্রকৃতি। খরার শরীর জেগে উঠেছে, যদিও প্রতিপক্ষ তখন মন, তবুও জিতে যাচ্ছে দেহটাই। ’ যে নারী স্বামীর কাছ থেকে পায়নি যৌনতৃপ্তি, যে যুবতীর অশান্ত শরীর কাঁদে নিয়ত, তার এই অনুভবকে কি অপরাধ বলা চলে? হয়তো সমাজ তাই বলবে। কিন্তু সমাজ কি মানুষকে, তার চাওয়া-পাওয়া, অধিকার ও মর্যাদাকে বাদ দিয়ে কোনো কাঠামোয় ঠায় দাঁড়াতে পারে। মানবাধিকারের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার দায় কি খানিকটা সমাজের ওপরও বর্তায় না? কিন্তু আমরা জানি, সমাজ মানুষের কামনাকে বঞ্চনা করে সুখ নামক চৌকাঠের দরোজায় দাঁড়ায় ধর্ষিতা কুন্তলার শাশুড়ির মতো রূপ নিয়ে: ‘ক্ষীণাঙ্গী বৃদ্ধা বিশাল আকৃতি নিয়ে দরজার সমস্ত ফটো বন্ধ করে টানটান দাঁড়ায়। ’ গল্পনির্মাতা নাসরীন জাহান কি সমাজকে পুরাতন ও বুড়িয়ে-যাওয়া বিধান বলতে চান? সমাজ তার বিশালতা নিয়ে মানুষের শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রাকৃতিক সকল সুযোগে বাধ সাধেন-  এই কি নাসরীনের সামাজিক অভিজ্ঞান? হয়তো তাই। আর সে কারণেই বোধকরি তিনি কুন্তলা নামের যে মেয়েটিকে এই গ্রামে ২১ বছর ধরে পায়ে হেঁটে বড় হতে দেখেছেন, এবং অবশেষে শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী এই প্রকৃতিকন্যা কুন্তলার জীবনে নেমে আসা কান্না আর অন্ধকার-অধ্যায়ের অন্তরালে বানিয়েছেন তার মাতৃত্ববোধের উজ্জ্বলতার এক স্বপ্নজগত। নাসরীন লিখছেন: ‘চারপাশে ধোঁয়াটে প্রকৃতির ভেতর তন্নতন্ন খুঁজছে শিশুটিকে। ’ গল্পটিতে আকাশে ভেসে-ওঠা ‘অর্ধচন্দ্র’ এবং কুন্তলার সামনে ও শরীরের ওপরে ‘চারটে অন্ধকার মানুষ’ পাঠককে চিন্তার অবচেতন অবসরে অজানা কোনো বারান্দায় হাজির করে।

শিথিল কুয়াশায় ভর করে কিংবা শীতকাতুরে কুকুরের পিঠে বসে আর যাইহোক বিশ্বভ্রমণ করা চলে না-- এমন ধারণা বোধকরি ছোটগল্পের কারিগর নাসরীন জাহান জানতেন। আমরা এমন অনুমান করতে পারি তাঁর  ‘খোঁড়া দৌড়বিদ’ গল্পটি পড়তে পড়তে। এখানে তিনি তেজী ও অহংকারী মানুষের পতনের কাহিনি এবং পরবর্তীকালে তৃষ্ণা ও প্রচেষ্টা নিয়ে তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন সাজিয়েছেন দায়িত্বশীল সামাজিক ভূমিকায় দাঁড়িয়ে। এক অহংকারী মানুষ যে কি-না গ্রামের আর সকলের চেয়ে অনেক বেশি দৌড়াতে পারতো, তার মানসিক অবস্থার বিবরণ দিচ্ছেন গল্পকার: ‘একসময়, তার ছিল ইয়া বিকট অহঙ্কার। ... বউকে ভাত খেতে খেতে বলত, অত কীসের ফষ্টিনষ্টি গপ্পো পাশের বাড়ির বৌ-ঝিগোর লগে? দূরত্ব রাখবি, ওরা তোর সমান?... বেবাকের লগে গা মিশায়া চললে ওরা আমারে সাধারণ মনে করব। তুই মানুষরে চিনস না। ’ খ্যাতিমান অথবা খানিকটা প্রতিভাবান হলে আমরা কেমন আর সব মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে অভ্যস্ত, তার একটা সরল ছবি এখানে প্রকাশ পেয়েছে। এবং ছোটপরিসরের গল্পে লেখক এই অহংকারী দৌড়বিদের পতন নিশ্চিত করার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছেন-  লোকটির পা কেটে ফেলার জন্য তার ঘরে রাতের অন্ধকারে লোক ঢুকিয়েছেন; তাকে বিকলাঙ্গ করে গঞ্জের হাসপাতালে পাঠনোর ব্যবস্থা করেছেন। অবশেষে লোকটির উত্তরাধিকারের কাঁধে তার স্বপ্নের প্রত্যাশিত-অসামান্য ভার চাপিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য সাহিত্যিক বিবরণের পাশাপাশি তিনি একটা মানবিক বিশ্লেষণেরও সুযোগ রেখেছেন। একসময়ের তুখোর দৌড়বিদ বর্তমানে পঙ্গু এই লোকটির ব্যক্তিত্ব নির্মাণের মধ্য দিয়ে নাসরীন ওই দায়টুকু সতর্কভাবে সেরে নিয়েছেন। এ সম্পর্কিত বর্ণনা দেখে নেওয়া যাক: ‘সে তারপরও হাঁটত, সবার মশকরার মুখেও তার উদ্ধত মাথা নিজের দিকে নামত না। মানুষের মন্তব্য সম্পর্কে তার অভিমত ছিল, মানুষ বড় বিচিত্র। ’ গল্পটিতে ব্যক্তির আত্মপ্রতিফলন আছে, রয়েছে সমাজের তাগিদ ও চাহিদার কথা। সমাজের প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্বের আভাস থাকলেও খোঁড়া লোকটির দিকে তার অনুকম্পার দৃষ্টি প্রসারিত ছিল।

‘শূন্যপতন’ গল্পে আমরা পাঠ করি একজন আদর্শবান মানুষের ক্ষণিক বিচ্যুতি এবং ফলত তার নিদারুণ বিপন্নতার কাহিনি। এখানে নাসরীনের পরিবেশন কৌশল আমাদেরকে নতুন এক অনুভবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। ‘মুহূর্তগুলো বিকট, ইয়া লম্বা’ বলার মধ্য দিয়ে মানসিক পরিভ্রমণের সময়পরিসরের আড়ালে যেমন তিনি সাজিয়েছেন মানুষের যন্ত্রণাকাতরতার ভীষণতা, তেমনি ‘নিশ্চিন্ত শিথিল ভঙ্গি’ উপস্থাপনের মাধ্যমে মানসিক স্থিতির ব্যাপারটিও হাজির রেখেছেন সাবধানতার সাথে। গল্পটি লেখক আরম্ভ করেছেন এভাবে: ‘আপনারা বিশ্বাস করুন আমার কথা...বিশ্বাস করুন...সুলেখার মতোন আমার একটা মেয়ে ছিল, হুবহু সেই চেহারা, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন, ও গত বছর মারা গেছে বলতে বলতে হুহু কান্নায় ভেঙে পড়েন বয়স্ক অধ্যাপক। ’ ছাত্রীকে যৌননিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষকের কাছ থেকে এর চেয়ে আর কী উপযোগী বক্তব্য আশা করতে পারে সমাজ। আর লেখকও কৌশলে অধ্যাপককে বয়স্ক বানিয়েছেন, যেন এধরনের অভিযোগ সহজেই হেসে উড়িয়ে দেওয়া চলে। অধ্যাপকের আত্মপক্ষ সমর্থনের আরেকটু বিবরণ এখানে হাজির করতে হচ্ছে বিষয়টিকে খোলাসা করবার প্রয়োজনে। লেখক জানাচ্ছেন: ‘সেইদিন ছিল বড় মেয়ের মৃত্যুবার্ষিকী...অধ্যাপক কাঁদতে থাকেন...সুলেখাকে দেখে আমি আবেগে অভিভূত হয়ে পড়ি, আমার মনে হয়, আমার মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে দরোজায়, আমি আচ্ছন্নের মতো ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকি। ’ এই পর্যন্ত ঠিক আছে; কিন্তু ঘটনার ভেতরে আরো খানিকটা ঘটনা প্রবেশ করেছে সন্তর্পণে। যে সত্য কথাটি কারো সামনে প্রকাশ করা সহজ নয়,  ‘হুহু চোখে সামনের মাঠের ওপর ছড়িয়ে থাকা আঁধার-অস্পষ্ট কুয়াশা দেখতে’থাকা প্রিন্সিপালের কাছেও যে বাস্তব বলতে পারেনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অধ্যাপক, তা হলো:  ‘জীবনের প্রথম এক মুহূর্তের জন্য এক বেহিসেবি অনুভব, শরীরের মধ্যে এমন একটা আগুন জ্বলে উঠল, যা তিনি নিজে জ্বালাননি...মেয়েটা এরপর ছিটকে বেরিয়ে গেল। ’ পরের ঘটনাতো সবার জানা। মেয়েটি অভিযোগ করল। মাথায় হাত পড়ল শিক্ষকের। শিক্ষকের আদর্শচ্যুতি আমাদের সমাজ সহজভাবে নেয় না; অপরাপর পেশার চেয়ে শিক্ষকতাকে সচরাচর মহান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে গল্পকার অত্যন্ত সাহসের সাথে ওই অপ্রকাশ্য সত্যটিকে শিল্পের মোড়কে পেঁচিয়ে পরিবেশন করেছেন।   ‘সুলেখার মাথা থেকে পিঠের দিকে যেতে থাকা’ অধ্যাপকের ‘তরঙ্গিত হাত’ লেখক দেখতে পেয়েছেন। আর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বিপন্ন এই শিক্ষকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে তিনি গল্পটির সমাপ্তি টেনেছেন:  ‘উবু হয়ে জলের মধ্যে নিজের মুখটা রাখতেই চশমা ভেসে যায়...অধ্যাপক বিচলিত অস্থির হয়ে ছটফট করে উঠেন, জীবনে একবারও একটা বিচ্যুতিও ঘটবে না? আশ্চর্য! ওরা কি আমাকে মানুষ মনে করেনি?’


মানবিক বিপন্নতাকে এক বিশেষ আবহের মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেছেন কথাশিল্পী নাসরীন জাহান তাঁর ‘এক রাতে, রেস্তোরাঁয়য়’ গল্পে। বাঙালির ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের নাগরিক আনন্দ আর পেছনে পড়ে থাকা নিরব বাঙালি জীবনের বাস্তবতার কথা বলতে গিয়ে তিনি সাজিয়েছেন একজন পলায়নপর আত্মকেন্দ্রিক মানুষের দিনলিপি ও রাতপঞ্জি। লোকটি আমাদের বিপন্নতা আর ব্যক্তির স্বকীয়তার ব্যাপারে সতর্ক বলেই মনে হয়। ইংরেজি নববর্ষে শহরের রিকশাঅলার আনন্দ আর কিশোরের তারুণ্য দেখে সে ভেবেছে:  ‘প্রতিদিনের শহর যদি এমন হতো?’ কিন্তু ‘বস্তাপচা’ পুরনো বছর পেরিয়ে আমরা যখন  ‘সাংঘাতিক সুন্দর একটা জীবন’ লাভের আশায় বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বহুলোক মদ্যপানে নতুন ধান্দায় ব্যস্ত থাকে। নতুন বছরে কী পেলাম আর কী পেলাম না; কোথায় কোন গিট্ঠু লাগলো-- এই হিসাবওতো আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। নাসরীনও ভেবেছেন সে রকম। আর তাঁর এক অনুভবও আমাদের চিন্তার সাতে মিলিয়ে যায়:  ‘যে-কোনো ভাবে হোক বাঙালি ফুর্তি করছে, সে নিজেও করতে পারলে নিজেকে তার ভাগ্যবান মনে হতো। বরং একটা বিষয়ে তার আফসোস হয়, বাংলা নববর্ষকে যদি রাতের এরকম প্রহর থেকে বরণ করার প্রথা চালু থাকত? রাত বারোটার পর থেকে গান, অনুষ্ঠান, মন্দ কী?’-- এই অনুভব সাধারণ নাগরিকের। সর্বসাধারণের মনের কথাকে কী সরলভাবে শিল্পের পাতায় পরিবেশন করলেন নাসরীন!

‘যে অন্ধ লোকটি রঙ দেখতে জানত’ গল্পটিতে স্বপ্ন-বাস্তব, ব্যক্তির প্রাতিস্বিক অস্তিত্ববোধ আর আপন আপন ভুবন নির্মাণের কথামালা উপস্থাপন করেছেন গল্পশিল্পী নাসরীন জাহান। গল্পটিতে রূপকথার ভঙ্গি আছে। একটি বাক্য এরকম: ‘রাত যায়; দিন যায়, নাগরিক আকাশ ছিঁড়ে পাখি যায়। ’ তবে এই রূপকথার গল্পের আড়ালে আছে বাস্তবতার সংশ্লেষ ও চিন্তার বিশেষ সংযোগ। নাগরিক আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটবেলাকার অনুভব যদি এরকম হয়:  ‘গাছের পাতা সবুজ না হয়ে নীল হলে কেমন হতো কিংবা আকাশ যদি সারাক্ষণ থাকত বেগুনি! তখন নিশ্চয় রূপকথা শুধু কল্পকাহিনি বা শ্তিমধুর লোককাহিনি হয়ে থাকে না। গল্পটিতে কাহিনিকার এক অন্ধ ভিখিরির স্বপ্নকে আর তার রঙ-প্রীতিকে সাজিয়েছেন ব্যক্তিগত অনুভবের আলোয়। লোকটি রঙ দেখতে জানে। মায়ের রঙ, চাঁদের রঙ, ভাতের রঙ, বাতাস-তারা ও রাত্রিদের রঙ যেন সে দেখতে পায় উপলব্ধির নিবিড়তায়। তার এই আশ্চর্য ক্ষমতাকে নিয়ে ব্যবসার জাল পাতে এক মতলববাজ। অতঃপর রঙনির্ভর এক ব্যক্তিগত অনুভব সবার হয়ে পড়লে ভিখিরি লোকটি নিজস্ব ভুবন থেকে ছিটকে পড়ে। তার স্বপ্নে জগত অন্ধকারে মিশে যায়। স্বপ্ন-প্রত্যয়-প্রতারণার ছবির ফাঁকে ফাঁকে গল্পকার তাঁর পাঠককে নিয়ে গেছেন সামাজিক সত্যের দরোজার কাছে--  যেখানে দোজখের শাস্তির আভাস আছে, শুকিয়ে-যাওয়া লালা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ আছে। যাবতীয় আনন্দ আয়োজনের পেছনে বসে থাকা দারিদ্র্যের চিত্রও তুলে ধরেছেন তিনি। যেমন জানাচ্ছেন:  ‘শহর সেজেছে উজ্জ্বল আলোয়। পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে এ দেশের জীর্ণ দারিদ্র্যের বিশাল স্তুপ। ’ গল্পটি সমাপ্ত হয়েছে ব্যক্তির নিঃস্বতাকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে। শেষ দুটি বাক্য: ‘সবাইকে গভীর হতাশার নিঃসীম অতলান্তে ডুবিয়ে দিয়ে ভিখিরি মুঠো হাত মেলে ধরে আলোয়। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে, লাল!’ এই গল্পে নাসরীন সম্ভবত বলতে চেয়েছেন, ব্যক্তির অস্তিত্ব ও স্বপ্নময়তা কেড়ে নিতে পারে লোভীমানুষের কঠিন হাত। শোষক আর শোষণের বাস্তবতা বোঝাতে লেখকের এই ভঙ্গি সত্যিই চমৎকার।

নাসরীনের গল্পে ব্যক্তির অস্তিত্ব ও সম্ভাবনার কথা আছে। আছে সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের দায় ও দায়িত্বের কথামালা। শিল্পের পাটাতনে দাঁড়িয়ে মানুষের অধিকার-উত্তরাধিকার আর মর্যাদার গল্প বানিয়ে এই বাংলাভাষী লেখক বিশ্বসাহিত্যের দরবারে তাঁর একটি নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। এ আমাদের অহংকার।

৪৬তম জন্মবার্ষিকীতে কথানির্মাতা নাসরীন জাহানকে অভিনন্দন!

বাংলাদেশ সময় ১৭১৭, মার্চ ৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।