ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

তিন জীবনের বন্ধু আমার, হে প্রেসক্লাব (শেষ পর্ব)

ফয়েজ আহমদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৯ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১২
তিন জীবনের বন্ধু আমার, হে প্রেসক্লাব (শেষ পর্ব)

[২০ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন মধ্যরাতের অশ্বারোহীখ্যাত প্রবীণ  সাংবাদিক ও  সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ। আমরা শোকাহত।

মৃত্যুর আগের দিন সূচীপত্র থেকে প্রকাশিত হয় তার শেষ বই ‘আমার সাম্প্রতিক লেখা’। এ বইটিতে তার ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও সংবাদপত্র বিষয়ক মোট ১৬টি প্রবন্ধ রয়েছে।

বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য ফয়েজ আহমদের ‘আমার সাম্প্রতিক লেখা’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে স্মৃতিচারণমূলক গদ্য ‘তিন জীবনের বন্ধু আমার, হে প্রেসক্লাব’ তুলে ধরা হলো। ]

তিন জীবনের বন্ধু আমার, হে প্রেসক্লাব [পর্ব-১]


http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/foez 1120120303142700.jpgএকটা দোজখে ৬ মাস বাস করেছি কেবল মনোবল দিয়ে। প্রতিটি দিন আমি গুনতাম ৬ মাসের। কেন জানি এই ৬ মাসে কোনো গুরুতর অসুখ হয়নি। বলতে গেলে ফাঁসির আসামির মধ্যেই আমার তখন জীবনযাত্রা ছিল। এই দুঃসহ জীবনে কেবলমাত্র একটা দিক আমি বুঝতে পারতাম যে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, আমার চোখের দৃষ্টি যেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন দেয়ালের মধ্যকার সেলে ৬ মাস বাস করে আমার চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু নাজির জমাদারের কাছে বলেও লাভ হলো না। তিনি কন্ডেম সেলে কোনো ডাক্তার আনতে সম্মত হলেন না। কাঁটায় কাঁটায় ৬ মাস পর আমাকে পুনরায় ২ নম্বর খাতায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমাকে ডাক্তারের চেকআপের কথা বলা হলো। মকবুল ডাক্তার এখনও জেলখানায় আছেন।

আমাদের মধ্যে কোনো নিরাপত্তা বন্দি এ-যাবৎ এমন কঠোর সেল নির্যাতন ভোগ করেনি। আমার সেলের তুলনায় এই ২ নম্বর খাতা যেন স্বর্গ ছিল। সবাই আমার প্রতি সহানুভূতিশীল; কিন্তু কিছুই করার নেই। ক্রমান্বয়ে আবার আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমি এখন পুনরায় উৎফুল্ল। আমার নামে জেলগেটে টালিখাতায় শাস্তিভোগের কাহিনী স্থায়ীভাবে লিখে রাখা হলো।

৬ মাস পর একদিন মকবুল ডাক্তার আমার মুখোমুখি হলেন। তিনি আমাদের ওয়ার্ডে এসেছেন সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিদায় নিতে। কারণ তিনি অন্য জেলে বদলি হয়েছেন। তিনি আমার সামনে এসে বললেন, আমি অন্যত্র বদলি হয়েছি। আমি বললাম, আবার দেখা হবে। কেবল আপনার কানটা কেটে দেয়ার জন্য! তিনি চমকে উঠলেন। ভাবলেন, জেল থেকে বেরিয়ে তাঁকে আমি খুঁজব। মকবুল ডাক্তারের ঘটনার আগে আইবিরা আমাকে আরেক ঘটনায় জড়িয়ে ফ্যালে। তারা অতিমাত্রায় নিশ্চিত যে আমি একজন কমিউনিস্ট। আমার সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূতলবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। এবং আমি তাদেরই চোখের সামনে কী করে দেশ থেকে পালিয়ে বিনা পাসপোর্টে ভিয়েনায় গিয়েছিলাম। আরও অপরাধ আমি ময়মনসিংহ আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত। দ্বিতীয় অভিযোগটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রথম অভিযোগ সত্য। এটা আমি স্বীকার করতে পারি না। এজন্য আমি তাদের আগাগোড়াই বলেছি, ভিয়েনাতে বিশ্ব যুব সম্মেলনে আমি যোগদান করতে যাইনি। আমি দেশেই ছিলাম। এই ডাহা মিথ্যা আমাকে প্রাণ বাঁচাতে বলতেই হয়েছে।

এবার জেলে যাওয়ার পর হঠাৎ করে শুনলাম অন্য সেল থেকে সরদার ফজলুল করিমকে আইবিরা লালবাগ নিয়ে গেছে। তিন দিন পর আমাদের ওয়ার্ড থেকে শহীদুল্লা কায়সারকে একই আইবি লালবাগে নিয়ে গেল। তারপর ডাক পড়ল একদিন আমার। দুই আইবি এসে আমাকে জেলারের কাছ থেকে লিখিতভাবে ইন্টারোগেশনের জন্য লালবাগে নিয়ে গেল। আমার পর আমাদের অনেক জুনিয়র ময়মনসিংহের এক শিক্ষানবিশ কমরেডকে আইবিরা লালবাগ নিয়েছিল, যার নাম ছিল আর এ এম সাঈদ। যদিও আমরা এই বিশেষ ইন্টারোগেশনে জব্দ হইনি। কিন্তু কমরেড সাঈদকে আঘাত করতে ছাড়েনি। সে লালবাগ থেকে জেলে প্রবেশ করে স্ট্রেচারে এবং সোজা তাকে কোনো ওয়ার্ডে না নিয়ে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা এ-ঘটনায় ছিলাম ভয়ানক ক্ষুব্ধ; কিন্তু অসহায়।

আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর লালবাগ থানার পাশে মুঘল আমলের অস্ত্র রাখার জন্য নির্মিত একটি কক্ষে রাখা হয়। এই কক্ষের জানালা ছিল না। কেবল লোহার দরজা বা গারদ ছিল। আর ছিল এক কোণায় কিছু ইলেকট্রিক তার। একজনের একটা কদর্য বিছানা। ইন্টারোগেশন শুরু করার সময় বোঝা গেল দিন-রাত না ঘুমিয়ে ইন্টারোগেশন হবে এবং তা-ই হলো। পরে আমি শার্ট-গেঞ্জি খুলে বিছানায় বসে আইবিদের কথার উত্তর দিতাম। প্রতি ৪ ঘণ্টা পরপর আইবিরা বদলি হতেন। আমি আরেক দলের জন্য অপেক্ষা করতাম। এই নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারোগেশন ৩ রাত ৩ দিন হওয়ার পর আমাকে তাঁরা সরদার ভাই ও কায়সার ভাইয়ের মতো জেলে ফেরত পাঠালেন।

দুই বছর একটানা ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে থাকার পর আমাদের ৬ জনকে কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। আইবির দেখানো রিপোর্টে নাকি আমাদের সম্বন্ধে ভয়াবহ বক্তব্য দেয়া হয়েছে। আসলে সবই মিথ্যা। আকস্মিকভাবে কুমিল্লা থেকে ১০ মাস পর আমাদের আবার ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এসে দেখি একজনও রিলিজ হয়নি। একদিন কাগজে দেখলাম আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র অবজারভারে ধারাবাহিকভাবে বের হচ্ছে। তারই কুড়ি ধারায় এ ও বি-তে লেখা ছিল কোনো সিকিউরিটি প্রিজনারকে কোনো রিভিউ বোর্ডের সামনে উপস্থিত না করে ৩ মাসের বেশি রাখা যাবে না।


আমাদের ওয়ার্ডের সবাইকে আইয়ুব খানের কনস্টিটিউশনের এই অংশ দেখিয়ে বললাম--আসুন, আমরা রিভিউ বোর্ডে উপস্থিতির জন্য আবেদন করি। সবাই উৎসাহ নিয়ে কাগজটা পড়ল। কিন্তু কেউই স্বরাষ্ট্র দফতরে অ্যাপ্লিকেশন করতে রাজি নয়। তাঁরা বলেন-- এই সমস্ত আমরা অতীতে দেখেছি, সরকারের কাছে থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। পরীক্ষামূলকভাবে তুমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন কর। জেলে তো কাজ নেই-- ঘুমানো, খাওয়া আর তাস পেটানো। মাঝে মাঝে নিজেদেরই তৈরি ফুল-বাগানে ঘোরাফেরা। আমি সাদা কাগজ আনিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে পরের দিন এই ধারা মোতাবেক রিভিউ বোর্ডে আমাকে উপস্থিত করার জন্য আবেদন করলাম। এক মাস পর আকস্মিকভাবে হোম সেক্রেটারির চিঠি এল জেলগেটে। এবং তাতে বলা হলো-- আপনাকে যথাসময়ে শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রিভিউ বোর্ডে উপস্থিত করা হবে। এই চিঠি দেখে আমাদের ওয়ার্ডের সবাই অবাক। দুদিনব্যাপী দিনরাত আলোচনা হলো চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে। ওয়ার্ড কমিটি, আমরা তাকে কমিউন বলি, এই কমিটির সিদ্ধান্ত মতে আমি রিভিউ বোর্ডে উপস্থিত হতে তৈরি আছি বলে হোমকে জানালাম। ৬ মাস পর হোম আমাকে একটা রিভিউ বোর্ডে উপস্থিত হওয়ার তারিখ জানাল, তখন সবাই বুঝতে পারল সরকার সত্যি সত্যি বোর্ড তৈরি করেছে এবং আবার মিটিং করে ১০-১২ জন প্রিজনার রিভিউ বোর্ডে উপস্থিত হওয়ার জন্য হোমে পত্র লিখল। এক মাস পর আমার নামসহ নির্দিষ্ট একটি দিনে আমাদের ৭ জনকে হাইকোর্টের বিচারপতি সাত্তার সাহেবের কোর্টে উপস্থিত করা হবে বলে জানানো হলো।

কোর্টের নির্দিষ্ট দিনে পুলিশভ্যানে করে জেল থেকে আমাদের সকাল ৮টায় হাইকোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েদিদের ওই ভ্যানে আমাদের দুজন দুজন করে হাতকড়া একসঙ্গে লাগানো হয়েছিল। পুরাতন হাইকোর্টের দোতলার একটি কক্ষে আমাদের বিচার হয়। আমাদের কোনো কৌঁসুলি বা উকিল রাখার অধিকার নেই, যা-কিছু নিজেকেই বলতে হবে। দুজন বিচারক-- বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ও হোম সেক্রেটারি অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র সচিব। ২-৩ জনের পর আমার ডাক পড়ল কোর্ট হাজত থেকে কোর্টে। আমি প্রথমে কিছুটা ক্রুদ্ধ ছিলাম; কিন্তু শান্ত অবস্থায় বসেই সাত্তার সাহেবকে বললাম আপনার পাশে যিনি বসে আছেন দ্বিতীয় বিচারক, তাঁকে আমি বিচারক হিসেবে মানতে রাজি নই। কারণ তিনি আমার প্রসিকিউটর অর্থাৎ আমার গ্রেফতারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। গ্রেফতারকারী বিচারক হতে পারেন না।

বিচারক সাত্তার সাহেব আমার এই বক্তব্য শুনে স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তিনি কয়েক মিনিট পর বললেন আপনার কেবল আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেই চলবে। আমি তাঁকে আবার বললাম-- মাই লর্ড, আপনি আমাকে আগে থেকেই চেনেন। আমি একজন সাংবাদিক সেটা আপনি জানেন। তিনি হালকা হয়ে বললেন-- হ্যাঁ, আপনাকে আমি চিনি, আপনার চুল অনেক পড়ে গেছে।

তিনি আমাকে অনেকগুলো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেন এবং একটা পর্যায়ে এসে বললেন, আপনি ভিয়েনায় কমিউনিস্টদের যুব সম্মেলনে গিয়েছিলেন কি? আমি বললাম--স্যার, আইবি প্রমাণহীনভাবে একথাটি বলে, আমি ভিয়েনায় যাইনি, আমি দেশেই ছিলাম। (আমি এই মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। তা না হলে নিশ্চিতভাবে জেলজীবন প্রলম্বিত হতো। ) এর আগেও আইবিকে আমি বহুবার বলেছি-- ভিয়েনা সম্মেলনে আমি যাইনি। আইবিরাও এখন পর্যন্ত ভিয়েনা যাওয়ার সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। প্রায় আধঘণ্টা বিচারপতির কক্ষে নানা প্রশ্নে আমাকে কথা বলতে হয়।

পরবর্তীকালে তাঁরই রিকমেন্ডেশনে ৪ বছর জেল খাটার পর সরকার আমকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
যে-বিকালে আমাকে আরও ৪ জনের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়, সেদিন জেলগেটে দুজন আইবি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা আমার হাতে একটা ছাপানো কাগজ দিয়ে বললেন-- এই কপিটায় দস্তখত করুন এবং জিজ্ঞাসা করা হলো--আপনি ঢাকার কোন অঞ্চলে থাকবেন। আমি যে-এলাকার কথা বললাম সেটা রমনা থানার অন্তর্গত।

আইবিরা বললেন-- আপনি আগামী ১ বছর এই রমনা থানার এলাকায়ই থাকবেন নজরবন্দি হিসেবে। এর বাইরে যেতে হলে রমনা থানায় লিখিতভাবে জানিয়ে দেশের বাড়িতে যেতে পারেন। আমি ৪ বছর পর মুক্তি পেয়ে ঢাকায় আমার ভাইয়ের বাসা চিনি না বলে আরমানিটোলায় এক ভাগ্নির বাসায় উঠলাম।

ভেবেছিলাম ৬ মাস বেকার থাকব। কিন্তু সে-রাতে অবজারভারের আব্দুল গনি হাজারীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি হাসতে হাসতে বললেন যে, আপনি যে আমাদের পূর্বদেশে চাকরি করেন সেটা কি জানেন? আমরা সবাই হো হো করে হাসলাম। আমি বলি-- হ্যাঁ, এইমাত্র জানলাম। জেল থেকে বের হওয়ার পরদিন থেকে আবার আমি সাংবাদিকতায় হাত দিলাম।

এই দীর্ঘ ৪ বছর জেলের সময় বহু বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, একসঙ্গে বাস করেছি বিভিন্ন সেলে। তখন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুরের সঙ্গে ছাব্বিশ সেলে আমরা দীর্ঘদিন বসবাস করেছি। তাঁর সঙ্গে বাস করা এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। হঠাৎ একদিন তিনিও আমাদের সঙ্গে কোর্টে খালাস হয়ে গেলেন। নাজির জমাদার সকালে এসে জানাল শেখ সাহেবের মুক্তির অর্ডার এসেছে কোর্ট থেকে। আমরা সারা জীবন বলতাম-- মুজিব ভাই। তিনি সেল এলাকার সবাইকে ডাকলেন এবং বললেন--হয়ত আবার আসব, তবে আজকে আমি মুক্তিলাভ করেছি। সাময়িককালের জন্য তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি। তারপর আমাকে বললেন-- ফয়েজ, দীর্ঘদিন জেলখানায় নিশ্চয় কিছু লিখেছিস? আমি বললাম-- হ্যাঁ। তিনি বললেন-- খাতাগুলো নিয়া আয়। বাড়ি থেকে আনা তাঁর বিছানাপত্তর ‘ফালতু’রা (জেলখানার সাজাপ্রাপ্ত কর্মচারী) তখন গোছাচ্ছিল। তিনি আমার এ পাণ্ডুলিপির খাতা তাঁর বালিশের ভেতরে লুকিয়ে রাখলেন। বিছানা বাঁধা হয়ে গেল। এবং তিনি বললেন-- আমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেয়ার সাহস এই জেলের কারো নেই।

আমার বড় ভাই যুক্তবাংলার বিসিএস পাশ, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট। এবং তখন তিনি হোম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে জড়িত। ভাই নাজির আহ্মদ চৌধুরীর টেলিফোন নাম্বার দিলাম মুজিব ভাইকে। পরে জেনেছিলাম-- রিলিজ হয়েই মুজিব ভাই আমার ভাইকে টেলিফোন করে পাণ্ডুলিপির ৩টি খাতা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সে-লেখাগুলোর বাছাইকৃত একটি পাণ্ডুলিপি পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমীর প্রথম পুরস্কার লাভ করে। এই বইটি বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে, তার নাম ‘রিমঝিম’। এবং পরের বছর এই বইটি রি-প্রিন্ট করে ইউনিসেফ।

শেখ মুজিবের সঙ্গে এমন সূক্ষ্ম এবং গভীর সম্পর্ক ছিল যা চিরকালই স্থায়ীরূপ লাভ করে। আমি আওয়ামী লীগের কি না এই প্রশ্ন কখনো আসেনি। এক গভীর সম্পর্কে আমরা আজীবন আবদ্ধ ছিলাম।

প্রেসক্লাবের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলতে গিয়েই এত ঘটনার সূত্রপাত। আমার জীবনে প্রেসক্লাব যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান তারই একটি অংশ উত্থাপন করলাম। প্রেসক্লাব থেকে গ্রেফতার হয়েই আমার জীবনের এই অবস্থান। এই প্রেসক্লাবেই আমার জীবনের আরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ জড়িত। এই সবটাই প্রেসক্লাবের পুরাতন বিল্ডিঙে।


সাংবাদিক মহলে এবং রাজনৈতিক কোনো কোনো মহলে আমার যখন দুরন্ত চলাফেরা তখন আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নের সঙ্গে গুরুতরভাবে জড়িয়ে পড়ি। সে-সময়ে আমি ১৯৭১ সালে পূর্বদেশের চিফ রিপোর্টার পদে রিজাইন করে মুক্ত সাংবাদিকতায় অবতীর্ণ হই। আমি সে-সময়ে ঘোরতরভাবে আইয়ুব খান ও পরবর্তীকালে ইয়াহিয়া সরকারের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে কাজ করি। এই ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে প্রকাশ্যভাবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। পূর্বদেশে সব কথাই স্বাধীন ও মুক্তভাবে প্রকাশ তখন সম্ভব ছিল না, যদিও এই পত্রিকাটি বাংলাদেশবিরোধী ছিল না। অর্থাৎ সমস্ত রাজনৈতিক বক্তব্য আমার মতো করে আমি পূর্বদেশে লিখতে সক্ষম ছিলাম না। আমাদের দেশে শুধু নয়, অন্য দেশেও সাংবাদিকরা কখনো মালিক কর্তৃপক্ষের মতের বাইরে যে-পত্রিকায় তারা কাজ করেন সেখানে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে লিখতে সক্ষম নন। আমি যে-পরিস্থিতিতে পূর্বদেশ ত্যাগ করে নিজে কাগজ বের করেছিলাম-- ‘স্বরাজ’ (সাপ্তাহিক) কাগজটি গোড়া থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘোরতরভাবে লিখতে শুরু করে। সম্পাদক ও পত্রিকার মালিক হিসেবে আমি আমার বাংলাদেশের পক্ষের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছি। তাতে আর্মির বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি বক্তব্য রাখতে হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের স্বাধীনতাযুদ্ধের কাহিনীও এ-পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো। তা ছাড়া কীভাবে আধুনিক অস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় সেকথাও প্রকাশ্যভাবে এ-কাগজে প্রচার করা হয়েছিল। এ-পরিস্থিতির মধ্যেই ২৫ মার্চ সামরিক নির্যাতন শুরু করে ইয়াহিয়া খান। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সামরিক বাহিনী কর্তৃক হত্যাকা-, রক্তক্ষরণ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন শুরু হয়ে যায় ২৫ মার্চ থেকেই। শেখ মুজিবের মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান ৭ মার্চই দেয়া হয়েছিল। ১৪ মার্চের পর থেকে ইন্টারকন হোটেলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোর যে রাজনৈতিক অধিকারের আলোচনা হয় তা ২৫ মার্চের আগেই ভেঙে যায়। ২৩ মার্চও বোঝা গিয়েছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি।


শেখের আহ্বানে তখন বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল-- সকল সরকারি অফিস, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু প্রতিদিন শেখের ৩২ নং বাড়িতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা স্লোগান ও মিছিলসহকারে আসতে শুরু করে এবং তাঁরা দাবি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হোক। কিন্তু সে-সময়ে শেখ সাহেব এক পরিপক্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাগ্মী নেতা। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় অন্যান্য দিনের মতো তাঁর বাসায় ছিলাম সংশ্লিষ্ট সব সাংবাদিক। কিন্তু এই সন্ধ্যা ছিল ভিন্ন ধরনের। সবাই জানতেন যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। যে-কোনো মুহূর্তে আর্মি জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, হয়ত সে ২৫ মার্চ রাতেই।

শেখ সাহেবের বাড়িতে আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ কয়েকবার দেখা করে চলে গেছেন এবং তাঁরা ও বাইরের নেতৃবর্গ তাঁকে পাকিস্তানের আক্রমণের ভয়ে গৃহত্যাগ করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু শেখ সাহেবের চিন্তা ছিল অন্য মাত্রার। তিনি সবাইকে বলছিলেন সেদিন সন্ধ্যায়-- যার যার বাড়িতে আপনারা চলে যান। তিনি বাড়ি ছাড়বেন না এবং গৃহেই অবস্থান করবেন-- একথা স্পষ্ট করে সবাইকে বলছিলেন। শ্রোতাদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম।

আমি রাত ১০টায় ‘স্বরাজ’ অফিসে প্রত্যাবর্তন করে জরুরি কিছু কাগজপত্র নিয়ে রাত ১১টায় আজিমপুরের নিকটবর্তী শেখসাহেববাজার অঞ্চলে আমার বাসায় দ্রুত যাত্রা করি। তোপখানা রোডে নেমে দেখি একটা কাকও নেই। দ্রুত একটি রিকশা যাচ্ছিল, তাতে লাফিয়ে উঠে বললাম-- আমাকে নামিয়ে দিন। তিনি কিছুতেই আমাকে নিলেন না। প্রেসক্লাবের কাছে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। ১১টার পর আমি প্রেসক্লাবে প্রবেশের সময় কিছু গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হলো দূরে কচুক্ষেত এলাকায় এ-গুলি হচ্ছে। আমি তখন নিশ্চিত হলাম যে আর্মি আজ রাতেই ঢাকা শহর আক্রমণ করবে। শেখ সাহেব কী করবেন সেটা আমরা জানতাম না। আমরা ভাবিনি যে তিনি বিশেষ টেকনিক্যাল কারণে আর্মির কাছেই ধরা দেবেন। এখন আমাদের মনে হয় আর্মির কাছে সে-রাতে ধরা দিয়ে তিনি হয়ত ভুল সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁর ধারণা, আমরা অনেকে ভাবি, মুক্তিযুদ্ধের জন্য শেখ সাহেব নিজে ভারতে গেলে সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ভারতকে এ-যুদ্ধে সরাসরি জড়িত করা হবে-- একথা শেখ সাহেব ভেবেছিলেন। ভারতের কোনো সহযোগিতার ব্যাপারটা আর গোপন ছিল না। কিন্তু শেখ সাহেবকে জড়িত করতে না পেরে ভারত এক্ষেত্রে নিরাশ হয়েছিল। শেখ সাহেবের ধরা দেয়া নিয়ে বিতর্ক আরও অনেকদিন চলবে। আমি প্রেসক্লাবে উঠে, একজন স্টাফ ডেকে দোতলার বৈঠকখানা কক্ষে আশ্রয় নিই। সেদিনও পিয়ন আমার দরজার বাইরের কপাট বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করেছিল। এবং ঘর ছিল অন্ধকার। সমগ্র ঢাকা শহর ছিল অগ্নিদগ্ধ। রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক অগ্নিদগ্ধ এবং মুখোমুখি যুদ্ধ, পিলখানাতে আক্রমণ, প্রতিআক্রমণ ও যুদ্ধ এবং ওল্ড টাউনের আর্মারড কার ও ছোট ট্যাংকের প্রবেশ, পদাতিক সৈন্যের এলাকা ঘেরাও ও গুলিবর্ষণ সারারাত চলছিল। আমি ছিলাম তখন প্রেসক্লাবের সোফায় একা এক জাগ্রত সাংবাদিক। ভোর ৪টার দিকে প্রেসক্লাবের পাশে চামেলী হাউসে একটা ট্যাংক ঢুকে প্রেসক্লাবে গোলাবর্ষণ করতে আরম্ভ করল। ওই পশ্চিমের রুমটাতেই আমি থাকি। দেয়াল ভেদ করে আসা গোলার আঘাতে প্রথমদিকে আমি আহত হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকি। ভেবেছিলাম আমি মারা গেছি। কিন্তু ভোরে যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে আহত অবস্থায় বাইরে সৈন্যদের দেখে আমি আবার শুয়ে থাকি এবং পরবর্তী সময়ে প্রেসক্লাবের দোতলা থেকে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যাই। তখন আমার বাঁ ঊরুর ক্ষতস্থান থেকে  বিস্তর রক্ত পড়ছিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পেছন দিক থেকে নিচের তলায় এসে পরে আমি সচিবালয়ের দেয়ালের পাশের একটি গলিতে গিয়ে আশ্রয় নিই। এখানে রিকশাঅলা, দোকানদার, ফেরিঅলারা সাধারণত বাস করে। আমাকে এই দিন ২৬ তারিখে আমি ওই গলির ৩ যুবকের সহায়তায় একটা গাছে উঠে সচিবালয়ের ভেতরে মসজিদে আশ্রয় নিই। এখানে অনেক কাহিনী আছে, ২৬ মার্চ রাতে যা ঘটেছিল। আমি সচিবালয়ে ৪৭ জন অস্ত্রধারী পাহারদার পুলিশকে পাই, তারাই আমাকে ১ নং বিল্ডিঙের ১৩ তলার কৃষি বিভাগে আশ্রয় দেয়। ২৬ তারিখ ও সে-রাত আমরা না খেয়ে সেই বিল্ডিঙেই থাকি। ২৭ তারিখ ৯টার পর খবর আসে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়েছে। রাস্তায় লোক নেমেছে। কিন্তু কোনো বাস, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, কোনোরকম যানবাহনই তখন ঢাকা শহরে ছিল না। লাখ লাখ মানুষ বাস-রেল-রিকশা না থাকায় সবাই বুড়িগঙ্গার দিকে হেঁটে রওনা দিয়েছে।


আমি কয়েকজন পুলিশের সহায়তায় আহত অবস্থায় একটা রিকশাকে জোর করে পেলাম। শেষ পর্যন্ত আমি ধানমন্ডিতে আমার এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিই। এখান থেকেই আমার এক বন্ধু ডাক্তার নিউমার্কেটের নিকট ‘পলি ক্লিনিকে’ আমার প্রথম চিকিৎসা হয়। আমি দ্বিতীয় চিকিৎসা গ্রহণ করি মে মাসে আগরতলায় গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির এক ডাক্তারের কাছে। ওই ছিল আমার প্রেসক্লাবের সঙ্গে দ্বিতীয়বার ঘোরতরভাবে সম্পর্কিত ঘটনা। প্রথমবার তো আমি ’৫৮ সালে এই প্রেসক্লাবের এই কক্ষেই গ্রেফতার হয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার আমি একাত্তর সালে প্রেসক্লাবের একই কক্ষে পাকিস্তানিদের দ্বারা আহত হই। প্রেসক্লাবই আমার জীবনের বহু ঘটনার সাক্ষী।


আমি প্রেসক্লাবকে কোনোদিনই পরিহার করতে পারিনি। এখনও আমি এই বার্ধক্যে শহরের দিকে গেলে প্রেসক্লাবে এক ঘণ্টার জন্য হলেও আড্ডা দিই। এই প্রেসক্লাবে আমার জীবনের তৃতীয় বৃহত্তম ঘটনা ঘটে। এরশাদের সময় সে-সময় আশির দশকে তুমুল এবং ঘোরতর আন্দোলন চলছিল। হাজার হাজার মানুষ সমগ্র দেশে গ্রেফতার হয়েছিল। দেশের সমগ্র কারাগার রাজবন্দিতে পরিপূর্ণ ছিল। সম্ভবত ’৮৯ সালে রাজধানী ঢাকা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। আমি তখন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দীর্ঘদিনের সভাপতি। আমার নামে আর্জেন্ট প্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে পুলিশই আমাকে জানিয়েছিল। আমার থাকা ও খাওয়ার স্থান তখন আর নির্দিষ্ট ছিল না। কোনো রাতে গুলশানে, কোনো রাতে     ধানমন্ডিতে, কোনো রাতে ইত্তেফাকের কাছাকাছি এক বন্ধুর বাসায় থাকতাম। দিনে বা রাতে সতর্কতার সঙ্গে তখন ছিল আমার চলাফেরা। ধানমন্ডিতে আমি একটি বিশেষ বাড়িতে কোনো আশ্রয় না পেলে সে-বাড়িতে গিয়ে থাকতাম। তোপখানাতে নিজের ভাড়া করা বাড়িতে থাকা অনেকদিন যাবৎই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনটি বাড়িতে আন্ডারগ্রাউন্ডে আমার প্যান্ট-শার্ট রাখা ছিল।

একদিন প্রেসক্লাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মিশ্রিত একটি মিটিং গোপনে আহ্বান করা হয়েছিল। সে-মিটিংয়ের এক প্যাম্ফলেটে প্রচারিত হয়েছিল ১১ দফার ব্যাখ্যা। প্রেসক্লাবের গেটের বাইরে প্রধানত সাংস্কৃতিক কর্মীরা একটি আকস্মিক সভায় মিলিত হয়ে স্লোগান দেয়। পুলিশ প্রেসক্লাবে ঢুকতে পারেনি। কিন্তু গেটের বাইরে বহুসংখ্যক আইবি ও প্রকাশ্যে সশস্ত্র পুলিশ আমদানি করা হয়েছিল। ওই রাস্তার সভাতেই আমি জনগণের দাবির ছাপানো একটি প্যাম্ফলেটের অংশবিশেষ পাঠ করে শুনিয়েছিলাম। আমি এদিনের পূর্ব রাত্রে ধানমন্ডিতে জাহাঙ্গীরের বাসায় ছিলাম। এ-বাসায় আমি বহুবার থেকেছি এবং খেয়েছি। একটি কক্ষে আমার জন্য বিছানা রাখা হতো।
প্রেসক্লাবের গেটের বাইরে পূর্বে প্রকাশিত ১৯ দফার ব্যাখ্যা দিয়ে সন্ধ্যার পর যখন প্রেসক্লাবে প্রবেশ করি, তখন আমাকে ধরার জন্য গোপনে প্রেসক্লাবে কয়েকজন আইবি প্রবেশ করে। দুজন ফটোগ্রাফার দৌড়ে এসে আমাকে সাবধান করে ক্লাবের নিচতলায় ডাইনিং রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আমি কয়েক ঘণ্টা থাকার পর চেষ্টা করি প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে। প্রেসক্লাবের সদস্যরা তখন যে যার অফিসে চলে গেছে। আমার বেরোনোর জন্য কোনো গাড়ি বা বিশেষ পরিচিত ব্যক্তি আর পাওয়া যাচ্ছিল না। তখনই আকস্মিকভাবে রাত ৮টার পর টিঅ্যান্ডটির এক উচ্চপদস্থ অফিসার প্রেসক্লাবে আসেন। তিনি আমাকে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে দেখেন। প্রেসক্লাবে থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। এবং নতুন বিল্ডিঙে লুকিয়ে থাকার সুযোগও খুব কম ছিল। আমি তাঁকে বললাম, তোমার গাড়িটা দাও আধা ঘণ্টার জন্য। তুমি চা খেতে খেতে গাড়িটা ফেরত পাবে, আমি এক জায়গায় নেমে যাব। সে জানত আমি কী বলছি, কেন বলছি।

তাঁর গাড়িটা নিয়ে আমি যাত্রা করলাম। ঢাকা ক্লাবের কাছাকাছি আসতেই আইবিরা আমার গাড়ি চিহ্নিত করতে পারল। যে-কোনো জায়গায় আমাকে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হবে, নইলে নিশ্চিতভাবে ধরা পড়ব। আমি খুব কাছের ওয়াকিটকি থেকে শুনছিলাম এক পুলিশ আরেক পুলিশকে বলছিল যে এ-পথের যে-কোনো স্থানে গাড়ি থামলে আমাকে ধরতে হবে। আমার গাড়িটা তখন ধানমন্ডি ৮ নম্বর রোডের কাছাকাছি মিরপুর রোডে। হঠাৎ তিন-চার দিক থেকে হর্ন বাজতে শুরু করল। এ-জায়গাটা একটু প্রশস্ত। এক পাশে সুপরিচিত ধানমন্ডি ময়দান। তিনটা আইবি গাড়ি আমার গাড়িটাকে ভীষণভাবে হর্ন দিয়ে ওই মাঠের কিনারে চেপে ধরল এবং আমার ড্রাইভার বাধ্য হয়ে ওই মাঠের পাশে তার গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো। ৩ জন পুলিশ অফিসার সাদা ড্রেসে নেমে এসে আমাকে বলল-- জনাব আপনি বেরিয়ে আসুন। আমি সবই বুঝতে পারি। বাইরের যে-ইন্সপেক্টর কথা বলছিল তাকে আমি বললাম, আপনারা এখান থেকে আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাবেন, তবে আমি নামব। আমরা পুলিশের লোক আপনাকে কথা দিচ্ছি আমরা আপনাকে সবার আগে জেলগেটে নিয়ে যাব। পুলিশ জানত যে আমাকে আর্মি ইন্টেলিজেন্স খুঁজছে। তারা চান না যে আমি আর্মির হাতে পড়ি। আমাকে নামিয়ে তাদের টয়োটা জিপে উঠিয়ে তারা সোজা রমনা থানায় নিয়ে আসে। তারা আমাকে সামান্য কিছু খেতে দেয়। আমার ওপর দ্রুত একটি নথি লিখে, জেলগেটকে অ্যালার্ট করে, ওষুধ কিনে দেয় এবং তাদের নিয়ম অনুযায়ী সেক্রেটারি, মন্ত্রী থেকে সর্বস্তরের হাই অফিসিয়ালদের আমার গ্রেফতারের কথা জানিয়ে দেয়। বোঝা গেল, তারাও চায় না আমি আর্মির হাতে পড়ি। তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো রাত ১০টার পর সেন্ট্রাল জেলে।
এই নিয়ে তিনবারই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম প্রেসক্লাব থেকেই।

’৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় আমি ধরা পড়ি পুলিশের হাতে এই প্রেসক্লাব থেকেই।
’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমি ট্যাংকের গোলায় আহত হই এই প্রেসক্লাবের রুমে।
’৮৯ সালে এই প্রেসক্লাবেই আমি পুলিশের দ্বারা ঘেরাও হই এবং এখান থেকে পালাতে গিয়ে রাস্তায় ধরা পড়ি।
এই প্রেসক্লাবই আমার জীবনের সর্বস্ব। এই প্রেসক্লাবই আমাকে অসামান্য দান করেছে।


বাংলাদেশ সময় ১৪৪২, মার্চ ৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।