ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মাসুদ খানের সাথে এক বিকেলের গল্প এবং..

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১২
মাসুদ খানের সাথে এক বিকেলের গল্প এবং..

ঘন অরণ্যের মধ্যে সূর্যের আলোর তীব্র অনটন বুঝে
তরুণ সেগুন গাছ ঋজু, আর শাখাহীন, অতি দীর্ঘ হয়;
এত দীর্ঘ যাতে তার উচ্চ শীর্ষে উপবিষ্ট নিরাপদ কোনো
বিকল পাখির চিন্তা, অনুচ্চ গানের সুর মাটিতে আসে না।
                        -বিনয় মজুমদার
                        (ফিরে এসো, চাকা/৪)
 
ক.
কবি মাসুদ খান।

আমার প্রতিবেশী। তিনি থাকেন থার্টি ডেন্টনে, আমি থাকি টিসডেলে। ভিক্টোরিয়া পার্কের এপাশে আমি ওপাশে মাসুদ খান। আমাদের মাঝখানে রেলপথের বিভাজন। যেন সত্তর দশক আর আশির দশকের সীমানা। আমরা সেই সীমানা পেরিয়ে হারিয়ে যাই অভয়ারণ্যে।


বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির আমিনুল ইসলাম খোকন। খোকন এবং আমি একই বিল্ডিংয়ে একই ফ্লোরে থাকি, ২২০৯ আর ২২০৬-এ। শাহবাগের আজিজ মার্কেটে আমাদের অফিসও ছিল একই ফ্লোরে, একই রকম। তাই ‘বিষ কিংবা কুড়ি টিসডেল’ নামে একটি কবিতা লিখে ফেলি।


“খোকন খোকন ডাক পাড়ি। খোকন গেলো কার বাড়ি? বাড়িতে নয়; আজিজ মার্কেটের খোকা এখন বিষ কিংবা ২০ টিসডেল প্লেসে। বিশের বাইশ অঙ্কে আমরা ৯/৬ বাস করি। আমি পাই- কেনেডির সূর্যোদয়, পাতালট্রেনের ছোটাছুটি আর খোকনের ভাগে কিপলিংয়ের সূর্যাস্ত, সিএন টাওয়ারের শীর্ষ শিশ্ন।
ভিক্টোরিয়া পার্কের আকাশবন্দর থেকে আমি দেখি রাতের শহরের অজস্র তারাবাতি, কবিতায় জন্মবীজ আর খোকাবাবু দেখে-- খুকির ফ্রক, স্বল্পদৈর্ঘ্য স্বপ্নবীজ। আমি আঁকি অপূর্ব অন্টারিও লেক, নীলাকাশ আর জলনীলের আলিঙ্গন, গলে পড়া চাঁদচিত্র, অর্জিতার অর্কিজ স্কুল। খোকন আঁকে গলফ মাঠের মখমলে ছক ও সামারের সবুজ বরফ।


আমাদের স্বপ্নহীন করেছে কে? আমি আমরা ছাদে, কাঁদে খোকন। আমি হাসতে-হাসতে কাঁদতে থাকি। খোকন কাঁদতে-কাঁদতে হাসতে থাকে। এই কান্নাহাসি আর হাসিকান্নার ফুটেজ কেউ কোনো দিন দেখবে না, জানবেও না, আমাদের বুকের ভেতর অন্য আরেকটি ১৯৭১”।


দেশ ছেড়ে এসেছি, কবিতা ছাড়তে পারিনি। তেরো হাজার মাইল দূরে এসেও আমরা কবিতার নেশাঘোরে ডুবে থাকি। সিদ্ধার্থ হক, মাসুদ খান আর আমি মাঝে মধ্যে কবিতা পাঠ, কবিতা নিয়ে তুমুল আলোচনা আর ফাটাফাটি আড্ডায় মাতাল হয়ে মেতে উঠতাম। তা নিয়ে নিউজ করেছিল বেঙ্গলি টাইমস- “এক বিকেলে হালকা শীতের আমেজে টরন্টোস্থ ড্যানফোর্থ রোডের স্টার বাকসে তিন কবি মেতে ওঠেন তাঁদের স্বরচিত কবিতা পাঠে। ফাঁকে ফাঁকে চলে কবিতাবিষয়ক আড্ডা, আলোচনা, বিশ্লেষণ, বিনিময়। কানাডা প্রবাসী এই তিন কবি হলেন-- সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সিদ্ধার্থ হক এবং মাসুদ খান। তাঁদের কবিতায় গ্রামবাংলা থেকে শুরু করে নগরায়ন, নাগরিক জীবন, জীবনের জটিলতা, প্রেম, পরবাস, পরাবাস্তব প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়।
অবশ্য সিদ্ধার্থ ইংরেজি কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও সিদ্ধহস্ত। কবিতা পাঠের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডায় আলোকিত হয় জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, ভাস্কর চক্রবর্তী, রণজিৎ দাশ, মৃদুল দাশগুপ্ত, জয় গোস্বামীসহ অনেকের হইচই।


শেষপর্যন্ত হক দেশে চলে গেলেন। বিদেশে পড়ে রইলাম আমরা। খানের সাথে তেমন আর স্টার বাকসের কফি হাউসের সেই আড্ডাটা জমে উঠে না। আমাদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র ছিল- সিদ্ধার্থ হক। দুধের স্বাদ কী আর ঘোলে মেটে? তারপরও মাসুদ খানের বিকেলের সাথে আমার ২-১টা বিকেল যৌথ হয়ে যায়।
 
খ.
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/Masud_khan-final 1120120301173832.jpgটরন্টো শহরের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ পাতাল ট্রেন কখনো সাপের মতো ঢুকে পড়ে গর্তে আর কখনো কখনো বেরিয়ে আসে খোলা আকাশের নিচে। ভিক্টোরিয়া পার্কের সাবওয়ের রেলপথের প্রায় সমান্তরাল একটি অপূর্ব অরণ্য ঢালু হয়ে চলে গেছে ওয়ার্ডেন থেকে ডনভেলি পর্যন্ত। কিন্তু তা ব্যস্ততম শহরের উপর থেকে কিছুতেই বোঝা যায় না যে, টরন্টোর ট্যাফিগ্রাফির ল্যান্ডস্ক্যাপের নিচে একটু ভেতরেই কী চমৎকার ঘণ-গভীর অভয়ারণ্য। ভাবতে অবাক লাগে, শহরের ভেতর এতো বৈপরীত্য। দূরত্বহীন অবস্থানে এই আকাশ-পাতাল পার্থক্যে আমি বিস্মিত হই। উপরে নাগরিক জীবনের কী কর্মচাঞ্চল্য কোলাহল আর অস্থিরতা আর এখানে কী নির্জন কী নিরিবিলি, নীরবতা। কী শান্ত স্নিগ্ধতা। আমার কবিতার বইয়ের নাম- ‘নির্জনে কেনো এতো কোলাহল’। এখানে তার উল্টো- কোলাহলের ভেতর এতো নির্জনতা?


ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়ের অল্পদূরে পূর্ব দিকে ডেন্টনিয়া গলফ খেলার মাঠ। উঁচ-নিচু-ঢালু মাঠে সবুজ মখমলের মতো ঘাসের বাগিচা আর গাছ-গাছালির মিতালি। তা পেছনে রেখে, আমরা এক বিকেলে ক্রিসেন্ট টাউনের পাশ ঘেঁষে একটা ছোট পেঁচানো সিঁড়িপথ ধরে ৪২টি ধাপ পেরিয়ে নিচে নামতে থাকি। নেমেই পেয়ে যাই পায়ে চলা গ্রাম্য মেঠো পথের মতো আঁকাবাঁকা সরু সড়ক। কোথাও শুকনো, আবার কোথাও ইট মাটি মেশানো জলে ভেজা, ঘাসে ঢাকা কিংবা জল গড়ানো ঝরনার উপর ছোট সিঁড়ি বা সেতু বয়ে গেছে। শান বাঁধানো ঘাটের মতো নানা ধরনের পাথর বিছানো। মাঝে মাঝে বসার জন্য চমৎকার করে কাটা পাথরখণ্ড কিংবা বেঞ্চ পাতা। একেবারে তকতকে ঝকঝকে। মনে হবে এমাত্র কেউ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখে গেছে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই। পরিচ্ছন্ন! এদিক সেদিক থেকে ভেসে আসছে পাখ-পাখালির কিচিরমিচির, হাঁসের ডাকাডাকি, জঙ্গল থেকে জলে ঝাঁপ দেয়া ব্যাঙের লম্ফঝম্ফ। ঝিরঝির করা জলতরঙ্গে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, কাঠবিড়ালির দৌড়, হয়তো হঠাৎ একটি হরিণের চকিত হাজিরা, দূর থেকে ভেসে আসা বুনো ফুলের ঘ্রাণ....। সেই মাসুদ খানের ইন্দ্রিয়ে নাড়া দেয়। শ্বাস টেনে সেই মিষ্টি সুবাসিত ঘ্রাণ নিতে নিতে বলেন- টের পাচ্ছেন?


গাঁজা টানার মতো করে টেনে নিঃশ্বাস নেই। হ্যাঁ, আমিও টের পাই; কোনো কামিনী কিম্বা কাঁঠালচাপা নয়, শিউলি-বেলীও না। বিদেশি বনফুল। খুঁজতে থাকি। পাই না। হাঁটতে থাকি। ফুলের বদলে ফল পাই। গাছে গাছে ঝুলে আছে লাল, সাদা, সবুজ, হলুদ নানা ধরনের বৈচির মতো ঝকরা ঝকরা থোকা থোকা ফল। ফলগুলো ফুলের চেয়েও সুন্দর!
মাসুদ খান বিজ্ঞ উদ্ভিদবিদের মতো বলতে থাকেন, এটা খাবেন না। বিষাক্তও হতে পারে, এটা খান- মিষ্টি মিষ্টি। কী, ঠিক না?


চারদিকে সবুজ গাছগাছালি। আম গাছ, জাম গাছ নেই। তবুও বন্দে আলী মিঞার কবিতায় বন্দনা করি- ‘আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড় যেন.. মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন...’। উপরে খোলা নীল আকাশে মেঘের ভেলা। বনজ ফুল আর ফলের নেশায় আমি জঙ্গলে ঢুকে পড়ি। হারিয়ে ফেলি মাসুদ খানকে। ভেতরে ঢুকে দেখি একটা গাছে কদবেলের মতো ফল ঝুলে আছে। কিন্তু কদবেল না। নিচে চৌবাচ্চার মতো ঝিল। রূপালি জলে ঝিলমিল করছে, শেষ বিকেলেও রোদেলা স্রোত। মৃদু স্রোত ভেঙে স্বচ্ছ জলে হাঁসের ঝাঁক সাঁতার কাটছে আর খুঁজছে মাছ। মাছ নেই। বিরল প্রজাতির কচ্ছপ আছে। সাপের মতো একটা অচেনা সরীসৃপ দ্রুত ডুব দিয়ে পালালো। তাকে ধরার জন্য পিছু পিছু ছুটলো গিরিগিটির মতো একটা প্রাণী, নাম জানি না। হয়ত মাসুদ খান জানেন।


একি! একটি চড়ুই পাখি মরে আকাশের দিকে পা তুলে পড়ে আছে। পাশে তারই সাথী হারানো বেদনায় আরেকটি চড়ুই কিভাবে আহজারি করছে। এই করুণ দৃশ্যটি মনে করিয়ে দিলো জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখা হাতির কথা। বিপদে পড়ে বনান্তরিত হওয়া একদল হাতির মধ্যে ক্লান্ত একটি শিশু হাতি মারা যায়। তখন সব হাতি সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে শুঁড় তুলে শোক প্রকাশ করে আবার যাত্রা করলেও মা-হাতিটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে! মৃত চড়ুই পাখির দৃশ্যটি মাসুদ খানকে দেখাতে চাই। কিন্তু তিনি নেই। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেছেন।
এখানে একটু গাঢ় গহিন ছায়া ছায়া অন্ধকার। খুঁজলে হয়তো তেঁতুল গাছের অভিবাসী ভূত কিংবা অমাবস্যার পেত্নির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, সহযাত্রী মাসুদ খান যেন জগদীশচন্দ্র বসুর মতো গাছের সাথে কথা বলছেন, গাছের পাতাকে যত্ন করছেন। আর আমিও যেন রবি ঠাকুরের ‘বলাই’ হয়ে উঠি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন তো ধান গাছই চিনে না। টিভিতে দেখলাম, ঢাকার একটি সংগঠন বৃক্ষ চেনার কর্মসূচি নিয়ে রমনা পার্কে অনুষ্ঠান করছে। আমাদের সন্তানেরা গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি চেনে টিভির চ্যানেল থেকে! আর দোয়েলের শিস শুনতে হলে মোবাইল ফোনের টোন থেকে শুনতে হবে। আলী ইমামের কথা মনে পড়ল। এক ছেলেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে-- ‘বলো  তো মাছ কোথায় থাকে?’ সে নির্দ্বিধায় জবাব দেয়-- ‘ফ্রিজে’।


যাহোক, আমাদের মাথার উপর দিয়ে ট্রেন-গাড়ি-বাস চলছে, চলছে স্ট্রিটকার। মনে হবে কলকাতা শহরের ট্রাম। কিন্তু এটা টরন্টো। কোথাও বাদামওয়ালা নেই। ফেরিওয়ালার ফুচকা বা ঝাল মুড়ি নেই। পেলে খেতে খেতে হাঁটতাম।


আমরা রেল লাইন বরাবর হাঁটছি পার্কের পশ্চিমের খোঁজে। মাঝে মাঝে উদয় হয় মেইন স্ট্রিট, উডবাইন, কক্সওয়েল, গ্রিনউড প্রভৃতি। তখন দেখা যায় হাইরাইজ বিল্ডিং, উঁচু উঁচু সারিবদ্ধ গাছগাছালির, ব্রিজ। ব্রিজ থেকে নেমে আসা অরণ্যের নিজস্ব সিঁড়ি। কোনোটা কাঠের, কোনোটা স্টিলের, কোনোটা আবার ইটপাথরের। ইচ্ছে করলেই বেরিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু আমরা হারিয়ে যাই। কিছু খুঁজতে থাকি, হাঁটতে থাকি। হঠাৎ বৃষ্টি! না, বৃষ্টি নয়। ডানদিকে মাধবকুণ্ডের ঝরনার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে, তারই ছিঁটেফোঁটা। বাম দিকে সাইকেল চালাচ্ছে এক তরুণী, টুং টাং করে বেল বাজালো। মনে পড়লো আল মাহমুদের কবিতা- সাইকেল যেনো ডেকে উঠলো : রাবেয়া, রাবেয়া। কুকুর নিয়ে হাঁটছে এক বুড়ি। খামোখাই ঘেউ ঘেউ করে উঠে ধমক খেলো। হালকাভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াচ্ছে এক মধ্যবয়সী লোক। বন পাগল আরেকজন ‘হাই’ বলে আমাদের ক্রস করে উল্টো দিকে চলে গেল।


মাসুদ খান বললেন, এই ভদ্রলোক এসেছেন ইউরোপ থেকে। পরিবেশবাদী, প্রাণীবিজ্ঞানী। মাঝে মাঝে মাসুদ খান তাঁর কাছ থেকে বোটানি-বায়োলজির দীক্ষা নেন- এটা খাবেন না। বিষাক্তও হতে পারে, কিংবা তেতো। এটা খান- মিষ্টি মিষ্টি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কবিতার কথা ভুলে যাই। প্রাকৃতিক এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে হয়ে উঠি পরিবেশবিদ। গাছ থেকে ছিঁড়ে খাই বুনো ফল-  মালবেরি, জংলি বু বেরি, ব্যাক বেরি..., ডালে ডালে ছুটে বেড়ানো কাঠবিড়ালির সঙ্গে ভাগ করে। আমাদের আলোচনায় আসে- সৌন্দর্যের ভোটে হেরে যাওয়া সুন্দরবন, বনের মায়াবী হরিণ, বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে পাতাবাহারি মেপললিফ, রঙবেরঙের কাঠবিড়ালি, বনবিড়ালির মতো রেকুন, হাঁস প্রভৃতি। আমরা যেন কোপেনহেগেন থেকে কানকুন, কানকুন থেকে ডারবান সম্মেলনে যাচ্ছি।


মাসুদ খান প্রশ্ন করে- দুলাল ভাই, শীতে যখন সবকিছু বরফে ঢেকে যায়, তখন এসব প্রাণীকুল পাঁচ-ছয় মাস কোথায় যায়, কই থাকে! কীভাবে বাঁচে? পাখি ও হাঁসেরা না হয় উড়ে যায় দূরদেশে কিন্তু প্রাণীরা কীভাবে টিকে থাকে? আমি বললাম, ‘কাঠবিড়ালি বা হাঁসের ভাষা জানলে ওদের জিগ্যেস করতাম’। মাসুদ খান বললেন- কবির মতো জবাব দিলেন।
মাসুদ খান বলতে থাকেন- উইন্টার, স্প্রিং, সামার, ফল চার ঋতুর বিবর্তনটা অদ্ভুত। ফল ঋতু ফুরিয়ে যাওয়ার সময় কীভাবে পাতাগুলো সবুজ থেকে হালকা হলুদ, হলুদ থেকে লাল-কমলা, তারপর ধূসরতায় রঙ বদলাতে থাকে!


আমি বিজ্ঞের মতো বললাম-
‘গাছের পাতার সবুজ রঙের ক্লোরোফিল পিগমেন্টের সাথে আরো থাকে অল্প পরিমাণে হলুদ জ্যান্থোফিল এবং কমলা বিটা ক্যারোটিন। গ্রোয়িং সিজনে বা বাড়ন্ত বয়সে পাতার রঙ থাকে সবুজ। ফল বা অটমের আগমনে পরিবেশের তাপমাত্রা যখন কমতে শুরু করে, একই সাথে নিঃশেষ হতে থাকে ক্লোরোফিল। তবে ক্লোরোফিল যে হারে নিঃশেষ হতে থাকে তার চাইতে অনেক ধীরগতিতে কমতে থাকে জ্যান্থোফিল ও বিটা ক্যারোটিন। এ ধারাবাহিকতায় ক্লোরোফিল নিঃশেষ হওয়ার সাথে সাথে জ্যান্থোফিল ও বিটা ক্যারোটিনের অধিক উপস্থিতির কারণে অনেক গাছের পাতায় লাল রঙের অ্যান্থোসায়নিন তৈরি হওয়া শুরু করে। জ্যান্থোফিলের অধিক উপস্থিতিতে পাতার রঙ হয় হলুদ আবার বিটা ক্যারোটিনের অধিক উপস্থিতি পাতার রঙকে করে কমলা। সংক্ষেপে বলতে গেলে ফল বা অটমে গাছের পাতার রঙে বিপুল পরিবর্তনের কারণ এটাই’।
এই পাণ্ডিত্য অর্জন করেছি, মাহাবুবুল হাসান নীরুর ‘মেপেল সৌন্দর্যে আত্মাহুতি’ গ্রন্থ থেকে।
মাসুদ খান উৎসাহের সাথে বলতে থাকেন- ফল-এর পর উইন্টার। গাছপালায় পাতা নাই, পল্লব নাই। ন্যাড়া মাথার গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে যেন এক-একটা জিন্দা লাশ। পাখি, হাঁস, কাঠবিড়ালি সব উধাও। আর আদিগন্ত তুষারের মরুভূমি।


উইন্টারের পর আবার স্প্রিং আসার সাথে সাথে দেখবেন চারদিকে কেমন ফুটে উঠছে সব সৃজনচাঞ্চল্য। শীতের প্রহারে নাঙ্গা হয়ে যাওয়া গাছপালাগুলা তখন দ্রুত মেলে ধরতে থাকবে তাদের পাতা ও পতঙ্গ। অনুকূল আবহাওয়া থেকে যে যেভাবে যতটা পারে পাল্লা দিয়ে গ্রেফতার করে নিতে থাকবে উত্তাপ ও আলোক। দেখবেন গাছপালাগুলার গ্রন্থি থেকে, কোটর থেকে নতুন নতুন পাতা-পল্লবের মতোই যেন ফুটে উঠছে রঙবেরঙের পাখি, জালালি-কবুতর, পতঙ্গ ও কাঠবিড়ালি। ফুটে উঠছে পাখির শিস, পতঙ্গের গুঞ্জন, কাঠবিড়ালির চঞ্চলতা।


এদিকে জালালি কবুতরের মতো এক জোড়া কবুতর মাটি থেকে আধার খুঁটছে। একটু পর পায়রাটা পেখম ফুলিয়ে রোকনুজ্জামান খানের ছড়ার সুরে বাক বাকুম বাকুম করে সাত পাক ঘুরলো।
আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথের দু’ধারে কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও হালকা। মাঝে মাঝে সরু পথগুলো মিশে গেছে আরো ভেতরে বা বেরিয়ে গেছে বাইরে, শহরে। কোথাও কোথাও গাছে ঝুলানো সাইনবোর্ড, তাতে নানান তথ্য।

মাসুদ খান হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক জায়গায় ছোট ডোবার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে পড়তে থাকেন সাইনবোর্ডের ভাষা- THE IMPORTANCE OF WETLAND তাতে লেখা:

Weltands benefit the environement for beyond their boundaries and perform numerous vital ecological roles. Acorss southern Ontario Those important areas have been signifficantly reduced and continue to be threatened by urban sprawl. More then 90 percent of Toronto’s original wetlands have been drained and developed, initially for agriculture, then for industrial and residential uses. The costs of these losses have been significant. Sill-secale restoration projects like one can help demonsttrate wetland habitats’ enormous value.
Wetlands help control flooding by storing large amounts of water. While rivers carrt water away relatively quickly, wetlands hold it for a mach longer period, making it availabe locally for the use of flora and fauna. Wetlands are natural filters, helping of improve water quality. The also have the potential to remove and stor greenhouse gesses from the Earths atmospere.
Wetlands are among some of the most productive ecosystems in the world, and provide habitat for an immense variety plant and animal species, including one third of Canada’s species at risk.
(Toronto, Parks, Foresty & Recreation)


উল্লিখিত লেখা শুধু পরিবেশবিদদের কাছেই নয়, সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। মাঝে মাঝেই পার্কের মানচিত্র পাথরের স্তম্ভে গাঁথা। মানচিত্রে আপনি কোন জায়গায় আছেন, কোনদিকে কী পথ, কোথায় ওয়াশরুম, কোথায় পার্কিং-এ রকম নির্দেশনা দেয়া। আমার নির্দেশনার দরকার নেই। কারণ, মাসুদ খানই আমার পর্যটন গাইড।
জঙ্গলের ভেতরে গাছ মরে গেছে, ডাল ভেঙে গেছে। কিন্তু কোনো কাঠুরিয়া নেই, বনদস্যুও না। এমন কি পাতা কুড়ানি কিশোরীও নেই। ভাঙা ডাল, ঝরা পাতা, ভেঙে-পড়া দু-একটা গাছের গুঁড়ি সব যেন মায়ের কোলে মাটিতে পড়ে ঘুমিয়ে আছে। কাঁটা-ফাড়া-চেরাইয়ের কোনো কষ্ট নেই। এভাবেই একদিন মিশে যাবে মাটির সাথে।


উঁকি দেয়া নগর আর নাগরিকদের এরিয়ে আমারা হাঁটতে থাকি। বা দিকে টেইলর ক্রিক পার্ক। একটু উঁচুতে। চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা। গাছের গুঁড়ি বিছানো সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে হয়। উপরে একটা সবুজ মখমলের মাঠ। সামারে এখানে প্রতি শনি-রোববার বনভোজনে মেতে ওঠে অভিবাসীরা। এলাকাটা বিশেষ করে ‘বাঙালিপাড়া’ হওয়ায় প্রবাসীদের বৃহত্তর মৈমনসিং সমিতি, চাটগাঁ সমিতি, নরসিংদী সমিতি, বরিশাল সমিতির পিকনিকে জমজমাট থাকে। আর ছোটখাটো বারবিকিউ পার্টি তো আছেই।


এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। আমরা নেমে যাচ্ছি ঢালুর দিকে। ঝিলের মতো জায়গার পাশে নানা ভাস্কর্য দেখতে দেখতে আমরা হাঁটছি। হাঁটার পথের পাশাপাশি চলছে মরা-মৃদু ধানসিঁড়ি নদীর মতো একটা নালা। নালার নিচে উপরে মিউনিসিপ্যালের প্যারালাল জলসিঁড়ি। উপর থেকে নগরের নিষ্কাশিত জল গুহার ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ছে নিয়ন্ত্রিত কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ড্রেনে। দূর থেকে মনে হবে ছোট্ট জলপ্রপাতের ঝরনাধারা। কলকল, ছলছল করা শব্দ। কিন্তু সেই জলে মল নেই, ময়লা নেই, নোংরা নেই। কী স্বচ্ছ, পরিষ্কার।


টরন্টো শহরে গাড়ি ড্রাইভ করার মজাটাই আলাদা। আঁকাবাঁকা, ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু, সমতলে টরন্টোর পুরো শহরটাই পরিকল্পিতভাবে তৈরি। এখানে নগরবিদরা পাহাড়ি পরিবেশটাকে চমৎকার কারুকাজে কাজে লাগিয়েছেন। লেক, নালা, জঙ্গল, টিলা, সমতল সবই সুন্দরভাবে সংযুক্ত হয়েছে গড়ে উঠা নির্মিত নগরের সঙ্গে। ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বর্ধিত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা শহর টরন্টো। শীর্ষ আর শূন্যের তফাৎ সাথে বৃথাই মেলাতে থাকি ঢাকাকে!
 
গ.
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012March/park-220120301172437.jpgঢাকা তথা বাংলাদেশের কথা আমরা ভুলতে পারি না। তাই, নায়গ্রায় যাওয়ার নয়নাভিরাম পথটি আমাদের বর্ষাকালের কূলপ্লাবিত দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। জলের পাশ দিয়ে কূল ঘেঁষে ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে বহুদূর। হাত বাড়ালেই যেন জলের ছোঁয়ায় ভিজে যাবে আঙুলের ডগা। এক জায়গায় হবিগঞ্জের মতো পথের পাশে পাথর বিছানো জলের খেলা। দূরে শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের মতো সবুজ বাগান। পথের ধারে কে বা কারা টেবিলে খাঁচা ভর্তি ফ্রি আপেল রেখে গেছে। যার যতো ইচ্ছে নিতে পারো। একবার স্কারভোরো ছাড়িয়ে টরন্টোর পূর্ব প্রান্তে খামার ঘুরতে যাই। দুই ডলারের টিকিট কেটে ইচ্ছেমতো টকটকে স্টবেরি খাই। ব্যাগ ভরে তুলে নিয়ে আসি নানান সবজি। আমাদের পাড়ার টিসডেলের প্রেয়ার পার্কের পাশে ক্ষেত বানিয়ে ‘ঝুকুনি’র পাশাপাশি অনেকেই চাষ করেন লাউ, বেগুন, টমেটো, লালশাক, পুঁইশাক, সবজি। কোথাও কোথাও পথের ধারে অবহেলায় বেড়ে ওঠে বাংলাদেশি বৈত্যা শাক। তবে তা বাংলাদেশের মতো ছোট না; কানাডার মতোই আকারে বড় বড়। অনেকেই এই বৈত্যা শাক তুলে নেন। স্বাদ অনেকটা একই রকম।
টরন্টোর লেসলি রোডের দখিন প্রান্তের শেষ মাথায় ৫-৬ মাইল হাঁটার পথ। লেকের ভেতর চলে যাওয়া সেই অপূর্ব পথের প্রান্তে ভাসমান ঝুলন্ত সেতু। সেতু পেরিয়ে গেলেই ‘টমি থমসন পার্ক’। যার ভেতরে দিনাজপুরের রাম সাগরের দিঘির মতো বিশাল পুকুর। সেই দিঘির আকাশে ফুটে থাকে চাঁদ। ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ে রূপালি জলে, যেন পরীদের সাথে কেলি খেলে। হুমায়ূন ভাইয়ের পুত্র নিষাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই- বাঁশ বাগানের মাথার উপর থেকে বাংলাদেশের চাঁদটা এখানে চলে এসেছে।
কানাডার ভেতর লন্ডন আছে, সিডনি আছে, প্যারিস আছে, ওয়াশিংটন আছে, দিল্লি আছে, চায়না টাউনও আছে। তবে ঢাকা নেই। নান্দিনা আছে। নান্দিনা নামের একটি মাছ আছে, শুনেছি। আর নান্দিনা মহারানী হেমন্ত কুমারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। তাই ‘নান্দিনা’ নামের মাছটি খুঁজেছি। পাইনি!
শহিদুল ইসলাম মিন্টু মজা করে বলেন, তার নামানুসারে অন্টারিওতে রয়েছে ছোট্ট একটি মিন্টু সিটি। হয়তো উচ্চারণটা একটু ভিন্ন। যেমন আমরা বলি ‘টরন্টো’ বা ‘অটোয়া’; আমার ছোট মেয়ে উচ্চারণ করে ‘টরওনো’ আর ‘অডোয়া’। খাঁটি কানাডিয়ানরা এভাবেই বলে।


‘টরন্টো’র ওয়েস্ট অরেঞ্জ ভিলে কোনো কমলালেবুর বাগান নেই, তবে টিলায় মনে পড়ে গাজীপুরের শালবন। এখানে একটি জায়গার নাম- Amaranth। আমাদের ভাস্তে আসিফ চৌধুরী বলে- অমর নাথ।
আমার আরেক প্রতিবেশী, গফরগাঁওয়ের পোলা অমর নাথ মানে জাকির হোসেন। তার সাথে ঘুরতে ঘুরতে আমরা ফেলে আসা বাংলাদেশের মিল খুঁজি। বিদেশে স্বদেশের স্বাদ ও স্বপ্ন খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে টরন্টোর ইস্ট লরেন্স রোডের শেষ প্রান্তে ‘রুশ’ পার্কে পেয়ে যাই- একটি বিল। বিলের ওপারে বর্ষাকালের বরিশাল। জলঘাটে নেমে আসা শান বাঁধানো সিঁড়ি। কোথাও নুয়ে পড়া গাছের ডাল মৃদু বাতাসের দোলায় ছুঁয়ে যাচ্ছে- ঝিলের জল। উত্তরের দিকে মনে হচ্ছে- বাঁশের খুঁটি দিয়ে খাঁড়া করা টাট্টিখানা। আসলে তা নয়। হয়তো গাড়ির গ্যারেজ বা অন্য কিছু। সম্পূর্ণ মতিভ্রম।

ওপারের দৃশ্যাবলি দেখে মনে পড়ে সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা-
‘আমার পূর্ব-বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ/অন্ধকারের তমাল/অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়/একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ/সন্ধ্যার উন্মেষের মতো/সরোবরে অতলের মতো/কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো/বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি/... হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া/সিক্ত নীলাম্বরী/নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা/কবরী এলো করে আকাশ দেখার/মুহূর্ত/অশেষ অনুভব নিয়ে/পুলকিত/সচ্ছলতা/একসময় সূর্যকে ঢেকে অনেক মেঘের পালক/ঘর আর বিদেশ আঙিনা/আকুলতায় একাকার/তিনটি ফুল আর অনেক পাতা নিয়ে/কদম্ব তরুর একটি শাখা মাটি/ছুঁয়েছে..’
পুরো প্রাকৃতিক পরিবেশটা যেন জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার অনুবাদ। পানকৌড়ি কিংবা মাছরাঙা নেই। কিন্তু ঝিলে শাপলা ফুল, বালি হাঁসের বদলে কানাডিয়ান গুজ, সিগালের ঝাঁক, কিনারে শুকনো ছনের মরা ঘাস, পাড়ে সর্ষের ফুলের মতোই ছোট্ট হলুদ প্রিমরোজ ফুল, ছিপ ফেলে বিদেশি যুবক মাছ ধরছে, নান্দিনা মাছ? কেউ কেউ কখনো কখনো শখের পাল তোলা ডিঙি নৌকো নিয়ে লেক থেকে চলে আসে বিলের ভেতর। মনে মনে পাঠ করি মধুসূদনের কপোতাক্ষ :

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপী তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
......
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।
 
এপারেও সরকারি ঘাট। ঘাট থেকে জলের উপর ছড়ানো স্টিমারের মতো গ্রিলে ঘেরা প্লাটফরম। নিচে জলের খেলা। বিলটি ছোট একটা নালা হয়ে যুক্ত হয়েছে অন্টারিও লেকের সাথে। উপরে পাহাড়ে ওঠার জন্য প্যাঁচানো ব্রিজ। ব্রিজটি উঠে গেছে উপরের চূড়োয়। পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে সবুজ গো-ট্রেন। ব্রিজ পেরিয়ে চট্টগ্রামীয় পাহাড়ি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলে একদিকে নির্জন বাড়িঘর, অপর দিকে জেলা শহরের ডিসির বাসভবনের মতো কাঁটাতারে ঘেরাও খোলা জায়গা। ভেতরে ব্যাডমিন্টন খেলার জাল। জালের উপর বসে আছে দেশি দোয়েলের মতো বিদেশি পাখি। বিষণ্ন বিকেলে পাখিটির মন খারাপ! একটু আড়ালে গো-ট্রেনের সিগন্যালবিহীন মফস্বলীয় রেলক্রসিং। একটু দূরে গাছগাছালিতে ঘেরা গ্রামের মতো ঘরবাড়ি। তালগাছের মতো একা দাঁড়িয়ে আছে নাম না জানা একটি বৃক্ষ। তার নিচে খুঁটিতে বাঁধা কোনো গরু নেই। দখিন দিকে কয়েকটি বেঞ্চ পাতা। পাহাড়ের নিচে দখিনে প্রায় সমুদ্র। সমুদ্র মানে বিশাল অন্টারিও লেক, যার দৈর্ঘ্য প্রায় চার শত কিলোমিটার। খোলা মাঠের কবিতা পাঠ বা খালি গলার গানের আমেজে হু হু করে ভেসে আসে সামুদ্রিক বাতাস। অদূরে থার্ডবিচের বালুতে নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে কেউ কেউ। মনে পড়ে কক্সবাজারের কথা। তখন বাংলাদেশের জন্য মনটা আরো হু হু করে ওঠে। মন খারাপ করা মুহূর্তে অমর নাথ ওরফে জাকির হোসেন আরো দূরে আঙুল দিয়ে দেখান- ঐ যে দেখুন, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজের মসজিদ। সত্যি তো, সে রকমই। জানি, সেটা ষাট গম্বুজের মসজিদ নয়। হয়ত কোনো ছয় গম্বুজের নিউক্লিয়ার পাওয়ার পয়েন্ট, নয়তো পানি শোধনাগার। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়- ষাট গম্বুজের মসজিদ। পকেটের মানিব্যাংকের ভাঁজ থেকে যত্ন করে রাখা দশ টাকার নোট বের করে দেখতে দেখতে বলে উঠি- তাই তো!
কল্পনার কুয়াকাটার জলে সূর্য ডুবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমরা ঘোরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসি। সেখান থেকে জাকির নাথ নিয়ে যান বার্চমাউন্ট রোডের ওয়াটার পার্কে। পার্কের পাশে একটি আর্টিফিসিয়াল ঝরনাধারা ঝরছে। যেখানে ঝরনার ফোয়ারা ছড়িয়ে পড়ছে, সেই ফোয়ারার পাশের দেয়ালে সবুজ প্রকৃতির ভেতর সূর্যের ম্যুরাল স্থাপন করতে গিয়ে শিল্পী তার নিজের অজান্তেই এঁকে রেখেছেন- বাংলাদেশের পতাকা। চমকে উঠি। আবারো বলে উঠি- তাই তো।
মরিশাসে একটি পাখির নাম ‘বাঙালি’ আর জলাভূমির নাম ‘বাংলাদেশ’। মন্ট্রিয়ল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলার সেপ্টেম্বর ০১, ১৯৯৫ সংখ্যায় রেজাউল করিম তালুকদার জানিয়েছেন যে, বাঙালিদের মতো গান গায় বলে পাখির নাম বাঙালি আর পাহাড়ের ওপারের নিচু জায়গাটায় প্রতি বছর বন্যা হয় বলেই এলাকাবাসী নাম দিয়েছে- বাংলাদেশ। কানাডায় বাংলাদেশ না থাকলেও বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে অন্টারিওর সাদবারি’র মাল্টিকালচারাল ব্রিজে। আর এদিকে ফলের ঋতুতে দূর থেকে অগ্নিকাঁকন মেপললিপ দেখে মনে পড়ে ফাগুনের লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়ার কথা।
এভাবেই বাংলাদেশ খুঁজতে খুঁজতে অমর বাবু অমরত্ব খুঁজে বেড়ান। নিয়ে যান স্টার বাকসে কফির জন্য। কফির সাথে দুই ধরনের কেকের অর্ডার দেন। বলেন- দুলাল দা, খেয়ে দেখুন তালের পিঠা, কলার পিঠা। খেতে খেতে আমি এবারো বলে উঠি- তাই তো!

বাংলাদেশ সময় ১৪৪৩, মার্চ ১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।