সম্প্রতি হাইকোর্ট রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমে ভাষা দূষণ, বিকৃতভাবে ভাষার উচ্চারণ এবং ভাষার ভুল ব্যবহার রোধ করার জন্য একটি আইন জারি করেছে।
ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর উদ্যাপনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এ প্রসঙ্গেই আমাদের কথা হয় বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও রাজনৈতিক অঙ্গণের কয়েক জন প্রবীণ ও তরুণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে।
কথা বলেন প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন উমর, ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক, কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, তরুণ কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল ও তরুণ কবি আলফ্রেড খোকন।
‘কী হচ্ছে তার মায়াকান্না না কেঁদে কেন হচ্ছে তার অনুসন্ধান করা জরুরি’: বদরুদ্দীন উমর
বাঙলা ভাষা নিয়ে তো এখন অনেকেই নানা রকম কথা বলছে বিভিন্ন মাধ্যমে। প্রতিদিন টেলিভিশনে বলছে, পত্র-পত্রিকায় লিখছে; বাংলার মর্যাদা থাকছে না, ভাষার ব্যবহার সঠিক হচ্ছে না, ভুল বানান, বিকৃত উপস্থাপন, উচ্চারণ ঠিক হচ্ছে না বলে হায় হায় করছে।
আমার তো মনে হয় যারা এরকম হায় হায় করছে তারাই এর জন্য জন্য দায়ী। এদেরকেই চিহ্নিত করা দরকার। সমাজের মধ্যে কি হচ্ছে সেদিকে খোঁজ খবর না রেখে মায়াকান্না কাঁদলে কী হবে? ভাষা সমাজ বিচ্ছিন্ন কোন ব্যপার নয়। কী হচ্ছে তার মায়াকান্না না কেঁদে কেন হচ্ছে তার অনুসন্ধান করা জরুরি।
সম্প্রতি ভাষার বিকৃতি রোধে হাইকোর্টে আইন জারি করেছে। কিন্তু আইন করে তো কোন কিছু হয় না। সমাজের মধ্যে একটা প্রক্রিয়া জারি থাকতে হয়। হাইকোর্ট বলে দিয়েছে বলেই ভুল বানানগুলি ঠিক হয়ে যাবে, উচ্চারণ ঠিক হয়ে যাবে, বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে বলা বন্ধ হয়ে যাবে, ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার হবে তা নয়। এভাবে কোন কিছু দাঁড়ায় না।
‘হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছে সেটা অত্যন্ত সময়োপযোগী ’: আহমদ রফিক
বাংলা ভাষার অবস্থা তো ভাল নয়। ভাষা আন্দোলন করার পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উচ্চ আদালতে, রাষ্ট্রীয় কাজে, শিক্ষামাধ্যমে বাংলা আজো পরিপূর্ণরূপে প্রচলিত হয়নি। আংশিকভাবে বাংলা প্রচলিত হয়েছে। সচিবালয়ের দাপ্তরিক কাজে, শিক্ষা মাধ্যমে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত বাংলা প্রচলিত আছে। এতোটুকু মোটেও যথেষ্ট নয়।
আমরা মূলত একটা ভাষিক রাষ্ট্র, যার প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলন করতে আজো পারিনি। যেমন তেমন ভাবে বাংলা ব্যবহার হচ্ছে, ভুল বানানে, ভুলভাবে বাংলা ব্যবহার হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছে সেটা অত্যন্ত সময়োপযোগী। রেডিও, টিভিতে যেভাবে বিকৃতভাবে ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে, হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে ভাষা উপস্থাপন করা হচ্ছে তা বাংলা ভাষার জন্য অমর্যাদাকর, অসম্মাজনক এবং জাতীয় পর্যায়ে আপত্তিকর।
একটা উদাহরণ দেয়া যায়, টিভিতে এভাবে বলে-- ‘সং প্লে করছি’। এইগুলির কোন অর্থ হয়? মেনে নেয়া যায়?
‘আইন করে ভাষার বিশুদ্ধতা সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা হয়তো যাবে না’ : হাসনাত আবদুল হাই
বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষায়, রেডিও-টিভিতে ভাষার বিকৃত উপস্থাপন বন্ধে বহুবার দাবি উঠেছে। কিন্তু এতোদিন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এখন হাইকোর্ট যে রুল জারি করল তা খুবই সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি।
হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছে তার অধীনে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করতে হবে। এবং এই আইন প্রয়োগ, সর্বস্তরে আইনের বাস্তবায়ন ও আইনকে বলবৎ করার দায়িত্ব নিতে হবে বাংলা একাডেমীকে। যেহেতু বাংলা ভাষার উন্নতি সাধন করা বাংলা একাডেমীর দায়িত্ব, সেহেতু ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সেই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
আইন করে ভাষার বিশুদ্ধতা সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা হয়তো যাবে না, তবে অনেকটা যাবে। এতদিন যারা ভাষা বিকৃত করত তারা এখন সাবধান হবে।
‘ভাষা নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেছে কিন্তু এটাতো হাইকোর্টের কাজ না’ : আহমাদ মোস্তফা কামাল
ভাষা নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেছে, এটাতো হাইকোর্টের কাজ না। বাংলাদেশে সর্বত্র সংবিধান সম্মতভাবে বাংলা ভাষা প্রচলন হয়নি তাই এই রুল জারি স্ববিরোধী। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না আসলে বাংলা ভাষার অবস্থাও এরকমই থাকবে।
একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন জাতি নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় অন্য ভাষা ব্যবহার করে না। কেবল মাত্র আমরাই (বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত অংশ) নিজেদের মর্যাদাবোধের চিহ্ন হিসেবে অন্য ভাষায় কথা বলি। আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনেকেই এরকম মনে করে। এই যখন মানসিকতা এই অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের আশা সুদূর পরাহত।
‘হাইকোর্ট নিজেও কিন্তু বাংলায় রুল জারি করে নাই ’ : আলফ্রেড খোকন
হাইকোর্ট রুলজারি করেছে, কিন্তু তারপরেও যদি কেউ ভাষার বিকৃত ব্যবহার করে তাহলে সেটা কী অপরাধ হবে তা কিন্তু ওই আইনে বলে নাই। আমি মনে করি এটা খুব একটা কার্যকরী কিছু হবে না। বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি ভুল বাংলা ব্যবহার করে।
হাইকোর্ট নিজেও কিন্তু বাংলায় রুল জারি করে নাই। বাংলাদেশে কোর্টের ভাষা কী? তাহলে বিষয় কি দাঁড়াল? যদি আমাদের আইন আদালতে বাংলা চালু না হয়, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হয় তাহলে এই সব রুল জারি করে কোন লাভ নাই।
আপনি দেখেন--- জাপান, চীন এরা সবাই সব কাজে নিজেদের মাতৃভাষা ব্যবহার করে। সেখানে আপনি যতই ইংরেজি জানেন তাতে কাজ হবে না। আর মাতৃভাষা বিষয়ে শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসেই কর্ম তৎপরতা না চালিয়ে সারা বছর ভাষা নিয়ে ভাবতে হবে।
আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট আছে, বাংলা একাডেমী আছে, এরা যদি সারা বছর কাজ করে তাহলে ভাষার উন্নতি, শ্রীবৃদ্ধি হবে ১২ মাসের ভার ১ মাসের উপর চাপালে কি কিছু হবে?