ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

লালবাগ (পর্ব-৯)

নভেরা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
লালবাগ (পর্ব-৯) নভেরা হোসেন

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।

গল্প-উপন্যাস সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখার উৎকৃষ্ট মাধ্যম। পুরান ঢাকার লালবাগকে যেমন সময়ের ফ্রেমে বেঁধেছেন লেখক নভেরা হোসেন। ‘লালবাগ’ একটি নভেলা। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য পাতায়। নভেলাটি পড়তে পাঠক বাংলানিউজে চোখ রাখুন প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার।


রোখসানা ভয় করতাছে, চল ফিরা যাই।
ধুর ভয়ের কী? কাজ শেষ হইলে যখন টাকা পাবি দেখবি কত ভালো লাগে। আর তুই কী এই কাজে সাধ কইরা যাইতেছিস?
লাইলী কিছুটা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে রোখসানার হাত ধরে বসে থাকে।
সিএনজি রাজমনি ঈসা খাঁ সিনেমা হলের পাশের রাস্তায় একটা সাদা রঙের পাঁচতলা বাড়ির সামনে থামে। একটা লম্বা মতো ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই ওদের ভেতরে নিয়ে গেল। বাসাটা খুব সুন্দর করে সাজানো। ড্রয়িং রুমে নীল মখমলের সোফা, দেয়ালে সুন্দর ছবি টানানো। ড্রয়িং রুম পার হয়ে ভেতরের একটা রুমে গেল দুজনে। চল্লিশ-পাঁচচল্লিশ বছর বয়সী শ্যামলা বর্ণের এক মহিলা বিছানার ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে।
মহিলা রোখসানাকে দেখে কাছে ডাকে।
কীরে চুমকি এতো দেরি করলি কেন?
সরি আপা। রাস্তার যে অবস্থা, পুরান ঢাকা থেকে আসতে অনেক সময় লাগলো। এই যে আমার বান্ধবি, যার কথা বলেছিলাম, খুব ভালো মেয়ে। কেমন সুন্দর চুল দেখেন।
বুঝলাম, কাজ কেমন করে দেখা যাক। কী নাম তোমার?
লাইলী।
ঐটাতো বাপ-মায়ের দেয়া নাম, বদলায় ফেলো। আজ থেকে তোমার নাম রুমকি। পছন্দ হইছে?
শোনো রুমকি আমার এইখানে কাজে কোনো সমস্যা নাই। প্রতিদিনই কাস্টমার থাকে। যে টাইমে আসতে বলব আসবা। দেরি করা যাবে না, সময় মতো আসতে হবে, ঘড়ি ধরা কাজ। কাস্টমাররা অপেক্ষা পছন্দ করে না। সব শিক্ষিত লোকজন। কত নামি-দামি লোকের সাথে তোমার পরিচয় হবে। চুক্তিতে কাজ, এক কাস্টমারে পাঁচশ’ টাকা।
এটা কিন্তু আলতু-ফালতু জায়গা না। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে, অসুখ-বিসুখ বাঁধাবে না। এখানে শাড়ি, গয়না সব আছে। মেয়েরা পরিয়ে দেবে। যেদিন আসতে পারবে না আগে জানাতে হবে। রোজ কাজ করতে পারলে তোমারই লাভ। আমি শুধু ঘরের খরচটা রাখি। আমাকে নাসিমা আপা ডাকবে। ফোন নম্বরটা নিয়ে নিও রোখসানার কাছ থেকে। নাসিমা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাতে নেইল পালিশ দিতে থাকে।
লাইলী মাথা নিচু করে সব কথা শোনে। কী সুন্দর একটা সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ি পরা নাসিমা আপা, গা থেকে সুগন্ধ আসছে। লাইলী চারপাশে তাকাতে থাকে। বাড়িতে চাকচিক্য, অনেক মেয়ে ঘোরাঘুরি করছে।

ঘরে দুজন বেশ সুদর্শন ভদ্রলোক এসে প্রবেশ করে। রোখসানা লাইলীকে নিয়ে ভেতরের ঘরে যায়। ভদ্রলোকদের সাথে নাসিমা খুব লাস্যভাব করে।
আরে কী খবর মোস্তাক সাহেব! গরিবের ঘরে হাতির পাড়া! কতদিন পর আসলেন?
নাসিমা এটা কিন্তু ঠিক বললে না। গত মার্চে এসেছিলাম, এখন এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, গার্মেন্টসের কাজ নিয়ে সময় পাই না। হংকং, ব্যাংককে যেতে হয় প্রায়ই।
বাহ ওখানেতো খুব ভালো ভালো মেয়েদের সাথে মিট করতে পারেন নিশ্চয়। তাইতো বলি আমাদের ভুলে গেলেন কেন?
অরে না না মাথা খারাপ। ওদের কত অসুখ-বিসুখ। ভয়ে কাউকে টাচ করি না।
নাসিমা হা হা করে হাসতে শুরু করে।
মোস্তাক নাসিমার হাতটা ধরে বলে, কি আজ শুধু গল্পই করবে?
না না ভেতরে নতুন একজন এসেছে, একদম নতুন। তাকে চুমকি সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিচ্ছে, একটু অপেক্ষা করতে হবে বলে নাসিমা চোখ টিপে তাকালো মোস্তাকের দিকে। মোস্তাকের সাথে যে লোকটি এসেছিল তাকে ভেতরে নিয়ে যায় অন্য একটি মেয়ে।
ওকে মোস্তাক গেলাম।
লোকটি চলে যাওয়ার পর মোস্তাক দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নাসিমার পশে এসে বসে। নাসিমা মোস্তাকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে কিন্তু মোস্তাককে একটু আনমনা লাগে, ওর মধ্যে একটা অস্থিরতা টের পায়।
আমি একটা কথা বলি মোস্তাক।
বলো।
তুমি অন্যদের সাথে থাকো আমার খারাপ লাগে, কিন্তু আমার কাছেও এসো মাঝে মাঝে।
আচ্ছা আসব নাসিমা, তোমাকেই আমি প্রথম পেয়েছি, এটা ভোলা যায় না।
তাই?
হ্যাঁ।
নাসিমা মোস্তাকের সাথে আরও ঘন হয়ে ওঠে।

লাইলীকে একটা সোনালী রঙের কারুকাজ করা শাড়ি পরানো হয়েছে, মিলিয়ে নকল সোনার গয়না। ব্লাউজের পেছনে ফিতা বাঁধা। ঘরের টেবিলে একটা হুইস্কির বোতল সাজিয়ে রাখা।
মোস্তাক এসে ঘরে ঢোকে।
কী যেন নাম তোমার?
রুমকি।
হা হা হা আসল নাম বলো।
লাইলী মাথা নিচু করে রাখে।
কী ভয় পাচ্ছো? প্রথম এসেছো?
লাইলী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
শোনো রুমকি তোমাকে যদি আমার ভালো লাগে তাহলে নিয়মিত আসব। আগে নাসিমার কাছে আসতাম। কিন্তু ও ব্যবসা সামলে এতো সময় দিতে পারে না। বয়স হয়েছে, তত মজা পাই না। তোমাকে আলাদা টিপস দেব। দাও একটু ঢেলে দাও খাই।
লাইলী হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে বরফ দিয়ে মোস্তাকের হাতে দিলো। কয়েক পেগ খাবার পর মোস্তাক লাইলীকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। বাহ তোমার শরীরতো সুন্দর, ধনুকের মতো বাঁকা। একদম বুভুক্ষুর মতো লাইলীর শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মোস্তাক।

মোস্তাক সাহেব চলে যাওয়ার পর একজন ছাত্র আসে। সে লাইলীর শরীর স্পর্শ করে না। বসে বসে গল্প করে। যাওয়ার সময় লাইলীর ঠোঁটে গভীর চুমু খায়। ছেলেটি বলে জানোতো এই লাইনে চুমু খাওয়া নিষেধ? লাইলী অবাক হয়ে ছাত্রটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী নিষ্পাপ, সৌম্য-শান্ত। কেন এখানে এলো ঠিক বোঝা গেলো না। বসে বসে লাইলীর নগ্ন দেহের ছবি আঁকলো, বললো কাজ শেষ হয় নাই আবার আসবে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হাতে প্রথম দিনের এক হাজার টাকা, সাথে মোস্তাকের দেওয়া টিপস। টিপসটা লুকিয়ে নিয়ে এসেছে লাইলী, নাসিমা কিছু জানে না। ওখান থেকে টিপস আনার নিয়ম নাই। কেউ টিপস দিলে নাসিমা আপাকে দিয়ে দিতে হবে। ঘরে ফেরার পথে লাইলী লালু শেখের জন্য গরুর মাংস, মাছ কিছু সবজি কেনে। আজকের অভিজ্ঞতা লাইলীকে একদিনেই যেন অনেক পরিণত করে দিলো। একবার বাবলুর কথা মনে হয়। বাবলু কি এখন আর ওকে ভালোবাসতে পারবে? মনে হয় না। নিজেকে খুব অপরিষ্কার লাগে লাইলীর। ঘরে ঢুকেই সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করে। কিন্তু মনে কেমন যেনো একটা ভিন্ন অনুভূতি। এখন লাইলী আর কাউকে পরোয়া করে না। না সোবাহান, না লালু শেখ না থানার দারোগাকে। ভেতরে ভেতরে একটা আগুন জ্বলতে থাকে লাইলীর মনে। যে শরীর নিয়ে এতো দিনের ভয় তা যেন ওকে ছেড়ে চলে গেছে।

লালু শেখ মেয়েকে কিছুই বলে না। সারাদিন সোবাহানের গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে। হালা, সুমুন্দির পুত, ড্রাগের ব্যবসা করো? মানুষ মারতে যাও? এখন ঠেলা সামলা। জেলের ভাত কেমন মজা খাইয়া দেখ। আমার কথাতো শুনলিনা। কত কইলাম বাপ-দাদার সারেংয়ের কাম কর না হইলে ভালো একটা ব্যবসা কর। চকবাজারে জুম্মান ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাই। সে তোরে সব পথ বাৎলাইয়া দিব। হুনলি আমার কথা? এখন নিজের বোনটারে রাস্তায় বাইর করলি! কত কিছু দেখনের আছিল কপালে। লালু শেখ বিলাপ করতে থাকে আর একটা সরু কাঠি দিয়ে ঘরের দরজায় দাগ কাটে।
আব্বা তুমি আর এইসব গজব দিয়ো না। মামলায় ভাইজানের কী হয় কে জানে? নিজের ছেলের প্রতি একটু মায়া-মহব্বত নাই তোমার?
কীসের মহব্বত? কীসের মহব্বত? যে ছেলে বাপ-মারে মানে না, লেখাপড়া ফালাইয়া পাড়ায় পাড়ায় ঘুইরা বেড়ায়। তার নামে এই নালিশ আসে, ওই নালিশ আসে। যে ড্রাগের ব্যবসা করে তারে আমি পোলা মনে করি না। এই পোলার মরা মুখ দেখতে চাই!
ছি আব্বা, ছি! তুমি মানুষ না আর কিছু? কেমন কইরা ছেলের নামে এমন কথা কইলা? আমার সাথে ভাইজান কী করলো, তাওতো আমি তারে দুষি নাই! সে বড় ভাই, আমারে শাসন করছে।
লালু শেখ রাগে গজগজ করতে করতে পাড়ার মোড়ের দোকানে চলে যায়।

লাইলী সপ্তাহে প্রায় পাঁচদিন কাজে যায়। এই কাজে নতুন এসেছে বলে ওর অনেক চাহিদা। সবাই এসে নতুন মেয়ে খোঁজে। একেকদিন একেক কাস্টমার। কেউ খুব ভদ্র। ভালো ব্যবহার করে, যত্নের সাথে ওকে উপভোগ করে, টিপস দেয়। আবার দু-একজন হিংস্র প্রকৃতির। দাঁত দিয়ে লাইলীর স্তন কামড়ে রক্তাক্ত করে। বার বার উপগত হয়, তাদের কামনা পূরণ হয় না। মোস্তাক লাইলীকে বেশ পছন্দ করেছে। সপ্তাহে একবার আসে, ওর জন্য নানা উপহার নিয়ে আসে। কিন্তু নাসিমা সব রেখে দেয়।

লাইলী রোখসানাকে নিয়ে আবার জেল হাজতে যায়। সোবাহানের নামে চার্জসিট হয়ে গেছে আগেই। দ্রুত বিচার আইনে খুব দ্রুত রায় হয়ে যাবে। এখন ড্রাগসের মামলা তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়। সোবাহান কেমন যেন আশা হারিয়ে ফেলেছে। লাইলীকে বলে আমার জন্য কিছু কইরা লাভ নাই, যা হওনের তাই হইবে।

নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]

আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-৮)

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।