ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

জন্মদিন উপলক্ষে

সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আড্ডা

ভূমিকা : ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১১
সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আড্ডা

‘আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়
আবার নূরলদীন একদিন কাল্ পূর্ণিমায় দিবে ডাক--
জাগো বাহে, কোনঠে সবাই....’

‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকে এরকম বুকের-মধ্যে-ঢেউ-দোলানো সংলাপ লিখেছিলেন যিনি তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। পঁচাত্তর পেরিয়েও এখনো তিনি লেখালেখিতেই নিমগ্ন।

কবিতা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যসহ লেখালেখির প্রায় সব শাখাতেই তাঁর সমান বিচরণ।

২৭ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। ১৯৩৫ সালের এদিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

২৪ ডিসেম্বর রাতে তাঁর সঙ্গে কথা হয় সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য পরদিন বিকেল ৫টায় যাব তাঁর বাসায় গুলশানে। কিন্তু ২৫ ডিসেম্বর দুপুর আড়াইটায় তাকে ফোন দিলে তিনি আমাকে এক ঘণ্টা আগেই যেতে বললেন।

আমি মনে মনে তার ‘পরানের গহীন ভিতর’ কবিতার লাইন আওড়াতে আওড়াতে কিংবা তাঁর অসংখ্য গল্প-উপন্যাস বা নাটকের চরিত্রের সাথে কথা বলতে বলতে যখন তাঁর বাড়ির লাল টুকটুকে গেটের সামনে গিয়ে সিএনজি থেকে নামলাম তখন বিকেল ৪টা ১০। গেটের সামনে দাঁড়িয়েই বুঝলাম চাইলেই এ বাড়িতে প্রবেশ সম্ভব না। আগে ভেতরে ঢোকার অনুমতি নিতে হবে।

একসময় অনুমতি পেয়ে যখন তাঁর বাড়ির সীমানার মধ্যে প্রবেশ করলাম, মুগ্ধ হয়ে লক্ষ করলাম বাড়িটি তার নানা রকমের সবুজ গাছে ঘেরা। একটা-দুটো ছোট পাখি গাছের এ ডাল থেকে ওই ডালে উড়ে যাচ্ছিল। পাখিদের ঠোঁটে যেন শীতের বিষণ্নতা।

তার বসার রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম ‘নূরলদীনের সারাজীবনে’র স্রষ্টা সৈয়দ শামসুল হককে কি অবস্থায় দেখতে পাবো। সাক্ষাৎকারটা কি শেষপর্যন্ত ঠিকমত নিতে পারবো! অনেকের মুখেই শুনেছি মুড ভালো না থাকলে তিনি সাধারণত সাক্ষাৎকার দেন না। কিংবা সাক্ষাৎকার দেয়ার ব্যাপারে তাঁর অনাগ্রহটাই বেশি।

সে যাই-ই হোক, রুমে ঢুকতেই লক্ষ করলাম, হক ভাই সোফায় হেলান দিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাকে ঘিরে বসে আছেন এক দল তরুণ কবি। কবিরা হলেন--- নব্বই দশকের কবি রহমান হেনরী, প্রথম দশকের কবি অনন্ত সুজন ও  যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক জুননু রাইন

উপস্থিত তরুণ কবিরা প্রত্যেকেই আমার ঘনিষ্ঠজন। শুরুতেই আমাকে ফেইস করতে হলো হক ভাইয়ের বলা কিছু কথা আর প্রশ্নের--- ‘অনলাইন আসলে কি? এখানে লেখা কিভাবে পাওয়া যায়? অন লাইনে লেখা দিয়ে কি লাভ? বই পড়ার স্বাদ তো ই-বুকে পাওয়া সম্ভব না। ...’

আমি জানি, হক ভাই প্রযুক্তি ব্যবহারে বহু আগে থেকে পারদর্শী। তবু তার কথার উত্তর দিতে দিতেই এক সময় আমিও অংশ নিয়ে ফেললাম সেই আড্ডাতে। মনে হলো ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের নেয়ার চেয়ে আড্ডাই হবে অনেক বেশি প্রাণবন্ত।

আমাদের কথার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডায় এসে যোগ দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকও। তবে তিনি যতবারই আমাদের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন ততবারই কোনো না কোনো খাবার নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। এমনকি সেদিন জন্মদিনের আগাম কেকও খেতে হয়েছিল আমাদের।

বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন উপলক্ষে সেই আড্ডারই কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

 

sayod samsul hauqরহমান হেনরী : এই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ৪০ বছর পূর্তি হলো। বিজয়ের ৪০ বছরে এসে স্যার আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্য কতদূর কি দাঁড়ালো বলে মনে হয়। আমাদের সাহিত্য আসলে কতখানি এগোলো।

সৈয়দ শামসুল হক : কিচ্ছু বলা যাবে না। বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে এখনো সামগ্রিক মূল্যায়ন কিছু করা যাবে না। যতটুকু হয়েছে ইনডিভিজুয়ালি। বাংলাদেশের সাহিত্য, আমার নিজের ধারণা এখনো এর মুখ তৈরি হচ্ছে। এটা শেষ হয়নি। তারপরে তো তার স্বাস্থ্য, তার চেতনা, তার জীবন-যাপন, সাহিত্যের ব্যক্তিত্ব এগুলো নিয়ে কথা...  

জুননু রাইন : আপনি কি এটা একাত্তরের পর থেকে ধরতেছেন...

রহমান হেনরী : ৪৭ সাল থেকেই ধরা যাক, তখন থেকেই তো পূর্ববঙ্গ সাহিত্য আলাদা হতে থাকে। পূর্ববঙ্গের ভিন্ন একটা চেতনা আসলো

সৈয়দ শামসুল হক : বাঙালি মুসলিম সমাজের ভেতরে এটা এসেছে ৪০-এর দশক থেকে। তুমি আবু রুশদকে বাদ দেবে কি করে। তুমি আবুল হোসেন, আহসান হাবীবকে বাদ দেবে কি করে। তার তো আর ৪৭-এর পরের লোক না। যদি ৪৭ নাও হতো তবু থাকতো লারজ নাম্বার অফ বেঙ্গলি মুসলিম রাইটারস। তিন তিনজন উল্লেখযোগ্য কবি আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমেদ। আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এরা প্রত্যেকেই কিন্তু ৪৭-এর আগের।

আনোয়ার সৈয়দ হক : আমার মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই কিন্তু বাঙালি মুসলমান সচেতন হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি। ৪৭-এর আগে কি হয়েছিল। ৪৭-এর আগে হয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার একটা এফেক্ট পুরো দেশ জুড়ে, পুরো উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং সেটাতে মুসলমানের যে মানসিক প্যাটার্ন সেখানে মুসলিমদের কিভাবে এফেক্ট করেছে। মূলত আধুনিক উপন্যাস বলতে যা বোঝায় ওইখান থেকে আবু রুশদ, রশীদ করিম এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এতে আমরা একটুখানি সচেতন হলাম.... এটা আগের মত না। ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের মত যে না এটা আমরা বুঝতে পারলাম।

ফেরদৌস মাহমুদ : হক ভাই, আপনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একসময় বলেছেন, আমাদের কথাসাহিত্য হচ্ছে নাবালকের সাহিত্য। আমাদের সাহিত্যের নাবালকত্ব ঘোচানোর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে আপনার লেখালেখি কতখানি ভূমিকা রেখেছে?

সৈয়দ শামসুল হক : সেটা আমি কেন বলব, সেটা তোমরা বলবে। নাবালকত্ব ঘোচাতে পেরেছি কিনা এটা তোমরা বলবে। আমি বলেছি যে বাই অ্যান্ড লারজ সাবালক হয়নি বাংলাদেশের সাহিত্য। শুধু এইটুকু বলা যায় আমি সচেতন। কবিতা যেখানে গেছে সামগ্রিকভাবে উপন্যাস সেখানে যায়নি।

রহমান হেনরী : ছোটগল্পের ক্ষেত্রে কি বলবেন।

সৈয়দ শামসুল হক : উপন্যাসের চেয়ে বেটার।

ফেরদৌস মাহমুদ : আমাদের উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা না হওয়ার কারণটা আসলে কি, ব্যর্থতাটার কারণই বা কি ছিল?

সৈয়দ শামসুল হক : কারণ একাধিক। গল্প বলাটাতো মানুষের জন্য নতুন নয়। কিন্তু আমরা উপন্যাসের ভঙ্গিটা নিয়েছি ইউরোপ থেকে। কিন্তু তার আগেও তো আমাদের এখানে গল্প বলা হতো। আমরা কিন্তু সেদিকটায় তাকাইনি। কিন্ত কবিতায় আমরা সরে এসেছি। এমনকি শামসুর রাহমান যে টেলিমেকাস, ভেনাস, আগামেমনন করেছেন তোমরা  কেউ করছ না। তোমাদের কথা কি বলব, আমিই করিনি তার সমসাময়িক হয়েও।

উপন্যাস সে জায়গা থেকে সরে আসেনি। তাও বলতে গেলে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি উপন্যাস, ফরাসি উপন্যাসের আদলে বাংলা উপন্যাস লেখা হয়েছে।

রহমান হেনরী : ওদের উপন্যাসওতো অনেকখানি সরে অন্য দিকে যাচ্ছে। ওদের ট্র্যাডিশনাল উপন্যাস যেটা সেটার মতোই আমাদের এখানে হচ্ছে।   

সৈয়দ শামসুল হক:  সেদিক থেকে নাবালক বলেছি। আঙ্গিক উপাস্থাপনার দিকে থেকে নাবালক বলেছি। আঙ্গিক উপস্থাপনা নাবালক হয়েছে, প্রথম কথা হচ্ছে আমরা বিগত শতাব্দীর ইউরোপিয় উপন্যাসের মডেলটাকে এখনো ধরে রেখেছি। আর হচ্ছে, উপন্যাস সম্পর্কে একটা ধারণা আমাদের মধ্যে এখনো কার্যকর রয়েছে, যেটা হওয়া উচিত নয়--- গল্প বলাটাই উপন্যাসের মূল কাজ। অথচ উপন্যাসের মূল কাজ কি কেবল গল্প বলাই শুধু?

ফেরদৌস মাহমুদ : না...

সৈয়দ শামসুল হক : তাহলে...

 রহমান হেনরী : আমাদের এখানে হয়ত সেভাবে ‍উপন্যাস-লেখক তেমন আবির্ভূতও হননি।

 সৈয়দ শামসুল হক : আবির্ভূত হননি তা না। তবে খুব কম। কম বলেই সেটা ব্যতিক্রম। সেটা সাধারণ নিয়মে পড়েনি।

 রহমান হেনরী : আমাদের উপন্যাসের রূপ আসলে কি হতে পারত।

সৈয়দ শামসুল হক : এটা বলার চেয়ে, তাহলে, কারও কারও কাজ আমাদের পড়ে দেখতে হবে। ওয়ালিউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ পড়ো, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ পড়।

ফেরদৌস মাহমুদ : সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তো এগুলো বেশির ভাগই লিখেছেন দেশের বাইরে থেকে। তিনি তো দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন, ছিলেন ফ্রান্সে। ওয়ালিউল্লাহকে সামনে রেখেই আমি অন্য একটা কথা বলতে চাই।

কয়েক দিন আগে আমরা বাংলানিউজে শহীদ কাদরীর একটি সাক্ষাৎকার আপ করলাম। তিনি সেখানে বলেছেন ‘লেখকের মাতৃভূমি ত্যাগ করা আত্মহত্যার সামিল’।

আপনিও তো দীর্ঘ দিন দেশের বাইরে ছিলেন, সেখানে বসে অনেক কিছুই লিখেছেন...

সৈয়দ শামসুল হক : শহীদ বলেছে তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। সেটা তার উপলব্ধি। আমার উপলব্ধি এক নাও হতে পারে। খুব নিষ্ঠুর একটা কথা বলি, মানুষ যখন নিজে উপলব্ধি করে যে `আমি ব্যর্থ হয়েছি`, তখন নিজের বাইরে কিছু কারণ শনাক্ত করতে চায়।

শহীদের যত কিছু দেওয়ার তা দেশে থাকতেই দিয়েছে। দেশে থাকলেও এর বেশি কি দিত সেটা অনুমান করে কিছু বিচার করা চলে না। রবীন্দ্রনাথ আর ৫ বছর বেশি বেঁচে থাকলে কি লিখতেন সেটা নিয়ে গাঁজার আসরে বসা যেতে পারে সাহিত্য আড্ডায় নয়। তার যতটুকু দেবার দিয়েছে। সুকান্ত যতটুকু দেবার দিয়েছেন। র‌্যাঁবো যতটুকু দেবার দিয়েছেন।

দেশ ত্যাগ করেছে বলে যদি শহীদ বলে এটা আত্মহত্যার সামিল, তাহলে নিজের না লেখাটার একটা রিজন সে নিজের মতো করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। দ্যাটস মে বি রাইট অর রং। আমার বলার অধিকার নেই। এটা সে-ই বলবে।

রহমান হেনরী : সেটা ডিফেন্স ম্যাকানিজমও হতে পারে তার...

সৈয়দ শামসুল হক :  দেশ ত্যাগ করেননি এরকম খারাপ লেখক নেই?

ফেরদৌস মাহমুদ : তা নিশ্চয় আছে। তবে দেশ ত্যাগ করেছেন এমন অনেক বিখ্যাত লেখকও আছেন।

রহমান হেনরী : সৃজনশীল রচনার এমন কোন জায়গায়টায় আপনি হাত রাখেননি, আমরা খুঁজে পেলাম না... এটা নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম কিছুক্ষণ আগে।

জুননু রাইন : আপনার সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়েও কথা হচ্ছিলো...

ফেরদৌস মাহমুদ : জুননু যেহেতু সিনেমার প্রসঙ্গ তুললই। এ কথার সূত্র ধরেই বলি, আপনি তো প্রচুর সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, ৩০টির বেশি হবে। আমার প্রশ্ন হলো--- যদি লাতিন ফিল্মের কথা বলি, ইতালিয়ান ফিল্মের কথা বলি কিংবা ইরানের ফিল্মের কথা বলি, ওগুলোর বিচারে আমাদের ফিল্মের নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজটা দাঁড়িয়েছিল কি-না।

সৈয়দ শামসুল হক : আমাদের সময়ে চেষ্টা ছিল, সেই চেষ্টা অফ হয়ে গেছে সত্তুর-একাত্তর সালে। আর সেসময় তো আমি ছেড়ে দিয়েছি। চিত্রনাট্য লেখাটা ছিল আমার কাছে কলমের থেকে উপার্জনের পথ।  

একজন পেশাদার লেখক হিসেবে, যেমন ধরো সাহিত্যিক সাংবাদিকতাও করে, সাহিত্যিক অধ্যাপনাও করে, ওটা আমার একটা প্রফেশন ছিল।

আমি মনে করি, লেখাটা হচ্ছে সার্বক্ষণিক কাজ। খণ্ডকালীন লেখক, কবি হয় না।

ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার একটা গান----  হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস/দম ফুরাইলেই ঠুস/তবু তো ভাই একটুখানি হয় না কারও হুঁশ| ঠুসের সাথে হুঁশের মিল দিয়ে যে এমন একটা গান লেখা যেতে পারে, বিষয়টা আমার কাছে খুব অবাক লাগে...

জুননু রাইন : এটা আমার আব্বা গাইতো... এখন আমিও গাই...

সৈয়দ শামসুল হক : চিন্তা করো...

রহমান হেনরী : এই গানটি গেয়ে আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম...

অনন্ত সুজন : কে গায়নি এই গানটা...

ফেরদৌস মাহমুদ : এই গানটা লেখার প্রেক্ষাপটটা জানতে চাচ্ছিলাম।

সৈয়দ শামসুল হক : এটা একটা সিনেমার গান.... সিনোমার নাম ‘বড় ভালো লোক ছিল’।

জুননু রাইন : তখন কি গান লেখা হতো এভাবে, যে কাহিনি এই... এখানে গানটা কিরকম হবে ...

সৈয়দ শামসুল হক : গান তো আমি নিজে ওইভাবে লিখতে চাইনি। চিত্রনাট্য লেখার পর গানের জায়গায়টা এখন কে গান লিখবে তাকে বুঝিয়ে বলা...মহা ঝামেলার ব্যাপার। তখন আমি বললাম আচ্ছা আমিই লিখব...  

জুননু রাইন : হক ভাই, আর তো কেউ গান লিখল না পরে কেউ। অবশ্য ফজল শাহাবুদ্দীনও দু’একটা ভালো গান লিখেছেন...

অনন্ত সুজন : পরে অবশ্য ফজল শাহাবুদ্দীন খুব বেশি গান লেখেননি।

ফেরদৌস মাহমুদ : সিনেমার জন্য গান আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মনিরুজ্জমান বা নাসির আহমেদও লিখেছেন।

রহমান হেনরী : কেন মারজুক রাসেল, কামরুজ্জামান কামুরা তো গান লিখেছে।

সৈয়দ শামসুল হক : শামসুর রাহমানও লিখেছেন গান। আমারই ছবিতে। ১৯৫৮ সালে যখন আমি ‘মাটির পাহাড়’ সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখি তার সবক’টি গানই শামসুর রাহমান লিখেছেন।

ফেরদৌস মাহমুদ : হক ভাই, এবার আপনার স্মৃতিকথা ‘প্রণীত জীবন’ নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। এই বইটি নিয়ে আমি লিখেছিলামও। আপনি ওই বইতে ভূমিকাতে লিখেছিলেন--‘কোনো আত্মজীবনীকেই আমি উপন্যাসের অধিক সত্য বলে মনে করি না। ’ আত্মজীবনীকে আপনি উপন্যাস বলছেন, এ বিষয়টা সম্পর্কে যদি বলতেন।  

সৈয়দ শামসুল হক : উপন্যাস মানে ওই অর্থে উপন্যাস না। উপন্যাস কি, উপন্যাস হচ্ছে গিয়ে এটা ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারত। যে উপন্যাসটি আমার কাছে ভালো লেগেছে ওটা আমার কাছে বাস্তবের চেয়েও বাস্তব। সম্ভবপর ওটা।

মনে করো ‘পদ্মানদীর মাঝি’, মানিক বাবুর ‘পদ্মানদীর মাঝি’ যদি পড় তোমার একবারও মনে হবে না যে বানানো কথা। ইট কুড হ্যাভ হ্যাপেনড... তার চেয়েও বড় কথা এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে তুমি একটা জীবনের প্রতি একটা দৃষ্টিপাত করবার অবকাশ পাচ্ছ। এভাবেও জীবন চলতে পারে, এধরণেরও অভিজ্ঞতা হতে পারে। আত্মজীবনীও লোকে সেভাবেই পড়ে, সবটাই যে ধারাবাহিকভাবে এভাবে ঘটেছে আমি সেভাবে নিজের কোনো গল্পও বলি নি।

hauq ফেরদৌস মাহমুদ : আত্মজীবনীতেও কি কল্পনার আশ্রয় থাকতে পারে... 

সৈয়দ শামসুল হক : আত্মজীবনীতে কল্পনার আশ্রয়? আত্মজীবনীকে উপন্যাসের অধিক সত্য বলে মনে করি না, উপন্যাস যে রকমের সত্য... দিস ইজ ট্রু, ইট কুড হ্যাভ হ্যাপেনড.... কারণ আমরা যখন পেছনে নিজেদের দিকে তাকাই--- সব সময় একই রকমের মাপে একই রঙে দেখি না।

আমারই এক বন্ধু ছেলেবেলায় একজনকে ভালোবাসতেন, তার সঙ্গে বিয়ে হয়নি। তাকে আমিও চিনতাম। সে তাকে এখন চিন্তা করে যে, কী ফর্সা ছিল!আমরা জানি সে মেয়েটি মোটেই ফর্সা ছিল না। এটা তার কল্পনা। তার ভাবতে ভালো লাগে মেয়েটি বেশ ছিল, টুকটুকে ফর্সা।

সেটাই তার কাছে সত্য। এটা তাকে বলে বোঝানো যাবে না। দ্যাটস হাউ ইটস চেইঞ্জেস, দ্য ট্রুথ ইজ নট ইন কালার। বাট দ্যাট হি ওয়াজ ইন লাভ। এটা শুধু তোমাকে একটু ঘনিয়ে তোলার জন্য। তোমাকে একটা সংকেত পাঠাবার জন্য। বেশ ফুটফুটে, টুকটুকে ফর্সা, তোমার মনে একটা ছবি তুলল। মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ।

যদি বলতো একটা মেয়েকে আমার খুব পছন্দ। চিন্তা করে দেখো, তোমার মনে কিন্তু কোনো কিছুই আসতো না।

যদি বলি, বেশ টুকটুকে...ফর্সা, ফুটফুট করে কথা বলত, দুটো বেনী... আসত... মেয়েটার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাহলে বেশ তথ্যটা পেয়ে যেতে।

যদি বলতাম একটা মেয়ে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছে...

ফেরদৌস মাহমুদ : নাহ তাতে কোনো ছবি ভেসে উঠতো না।

রহমান হেনরী : জীবনের কোনো পর্যায়ে এরকম, হয়ত খুবই ভালো লাগতো। একটা প্রণয় ছিল কিন্তু কোনো কারণে তাকে পাওয়া হলো না, এরকম কোনো ঘটনা আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কখনও ঘটেছে।

সৈয়দ শামসুল হক : আমি চেয়েছি পাইনি এরকম ঘটনা হয়নি।

রহমান হেনরী : প্রণয়ে কোনো ব্যর্থতা হয়নি...

সৈয়দ শামসুল হক : প্রণয় বলে কথা না, সব কিছুতেই। আমি যা চেয়েছি তাই-ই পেয়েছি, হয়েছি। আমি লেখক হতে চেয়েছি লেখক হয়েছি। আমি ইতিহাসে এমএ পাশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করিনি।

জুননু রাইন : আবেগটা বেশি হয়ে গেলে সাহিত্যের মেসেজটা স্ট্রং থাকে না। আমাদের সাহিত্যেও এই প্রবণতা আছে, বাংলা সাহিত্যের কৈশোর বলতে কি আপনি এটাকেই বুঝিয়েছেন।

সৈয়দ শামসুল হক : খানিকটা অনুমান তুমি ঠিকই করেছো। আমরা যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি জায়গা দিয়েছি। আমি একাধিকবার বলেছি, কবিতায় যুক্তির সিঁড়ি হচ্ছে সবচেয়ে স্ট্রং। কবিতার স্ট্রাকচার ইজ ভেরি লজিক্যাল। সেইখানেই আমরা, সেটাকে বাদ দিয়ে আবেগ। যার জন্য এখন আমি যেসব কবিতা চারদিকে পড়ি অধিকাংশ কবিতাই অসম্পূর্ণ কবিতা কিংবা অতিকথন।

এমন কি ইমেজ ক্ল্যাশ করে, তুমি নুন দিয়ে শুরু করেছ গোলাপ দিয়ে শেষ করেছ।

তুমি দেখো ‘বনলতা সেন’ দেখো, বনলতা সেনের ইমেজের পারম্পর্য... দেখো.... তুমি দেখেবে যে একটা কমন ফিল্ম থেকে এসেছে। তুমি রবীন্দ্রনাথের মনে করো ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লেখা ওই যে সুদূর নিহারিকা ... । নজরুলের ‘বল বীর চির উন্নত মম শীর’ তার ভেতর দেখবে ইমেজের একটা কনসিসট্যান্সি আছে। এটাই হচ্ছে লজিক, ওয়ান অফ দি বেসিক লজিক কবিতার হচ্ছে এই। তুমি চুন বলে গোলাপ ফুলে যেতে পারবে না। তুমি চুন বললে পানে যেতে হবে, খয়েরে যেতে হবে...

ফেরদৌস মাহমুদ : আমার কাছে মনে হয়, নজরুলের কবিতা বা ওই সময়ের কবিদের কবিতা এক জায়গা থেকে শুরু করলে একরৈখিকভাবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পৌঁছতো।

কিন্তু এসময়ের কবিতা একরৈখিক জায়গা থেকে বের হয়ে বহুরৈখিকতার দিকে গেছে। যে কারণে এই সময়ের কবিতায় এক জায়গা থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে লাইন টু লাইন জাম্প করার একটা প্রবণতা আছে। এটা দোষের না গুণের আমি ঠিক বুঝতে পারছি না...

সৈয়দ শামসুল হক : এটা তো প্রমাণ হাজির না করলে বলতে পারব না।

রহমান হেনরী : জাম্প করলেও শেষ পর্যন্ত একই ফিল্ডে থাকছে কিনা।

সৈয়দ শামসুল হক : এখন তুমি বলছ এটা। আমার চোখে পড়েনি এসব। আমার চোখে হচ্ছে--- সাংঘর্ষিক, দেয়ার ইজ নো লজিক্যাল কনসিসট্যান্সি।

জুননুন রাইন : ফেরদৌস যেটা বলছে এটাই ঠিক আছে, এটাই ভালো কবিতা বা কিছু। তবে এটা কিন্তু আসলে নাই...এটা আমার বলা ঠিক হচ্ছে না। আমিও এসময় লিখি। আমার মতে কমপ্লিট বাক্য নাই যেটা থেকে জাম্প করা যায়...

রহমান হেনরী : বলা হচ্ছে বহুরৈখিক, বলা হচ্ছে ওপেন এনডেড, কিন্তু বহুরৈখিকতা কিন্তু আমি কোথাও পাচ্ছি না...

ফেরদৌস মাহমুদ : শুনেছি, অনেক আগে আনন্দবাজারের সাগরময় ঘোষ ‘দেশ’ পত্রিকায় আপনার লেখা ছাপতে চেয়েছিলেন, কিন্ত পরে আর ছাপেননি। অথচ দেখা গেছে পরবর্তীকালে ‘দেশ’ আমাদের এখানকার দু’একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে কিছুটা জনপ্রিয় ইমেজের লেখকদের লেখা ছেপেছে। আপনি বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন।

সৈয়দ শামসুল হক : এ সমস্যা তো আমার না। এটা ওদের সমস্যা। আমি আমার দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছতে পারিনি।

আমার কাজ লেখা। একজন লেখক তার ভাষাভাষির মানুষের জন্য লেখে, এবং তার রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যারা তাদের জন্য বেসিক্যালি লেখে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস কলম্বিয়ার মত একটি ছোট দেশে বসে লিখছেন, তিনি কি আমার জন্য লিখছেন? যেখানে আজিজ মার্কেটের ছেলেরা পড়বে তাদের জন্য একটু লিখি। লিখছেন কলম্বিয়ার জন্য। তার লেখার আমরা হচ্ছি উপড়ি পাওনা।

‘আনন্দবাজার’ আমার লেখা ছাপল কি ছাপল না, দেশ আমার লেখা চাইলো কি চাইল না ইট ইজ নট মাই ম্যাটার। আমি চাই আমার দেশের মানুষের কাছে পৌঁছতে, এই বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছতে। আমি বাংলাদেশের লেখক, বাংলাভাষার লেখক। এর বাইরে বাংলাভাষাভাষী অন্য যারা আছে সেটা হচ্ছে তাদের আমার উপড়ি পাওনা।

কলকাতায় আমার দু’চারটে বইয়ের এডিশন হয়েছে, কিছু বিক্রি হয়েছে। এখন তারা ডাকে, যাই বক্তৃতা দিই । কিন্তু এটা আমার মূল কাজ না, আমার মূল কাজ হচ্ছে আমার দেশে।

জুননু রাইন : হক ভাই গত জন্মদিনের অনুভূতিতে আপনি বলেছিলেন, প্রতিদিনই তো জন্ম হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে জন্ম হচ্ছে নিজের ভেতরের নিজের নতুন জন্ম হচ্ছে নতুন স্বপ্নে মত করে। এবার অনুভূতি কি হতে পারে।

সৈয়দ শামসুল হক: আমি জন্ম মৃত্যুর কথা ভাবিই না। সত্যিই তোমাকে বলি---জন্ম এবং মৃত্যু আমার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। জীবন হচ্ছে আমার কাছে ব্যাপার। জীবনটা হচ্ছে: জন্ম আমি চাইওনি, আমার কোনো হাতও ছিল না। আই জাস্ট হ্যাপেনড টু বি আ বয়... আর মৃত্যুও আমার হাতে নেই। মৃত্যু যখন হবার তখন হবে। কিন্তু এই মাঝখানের যে জীবন সেটা আছে। যদি এমনি জাগতিক অর্থে বলো আমি আরও কয়েক বছর সময় চাই। কিছু লেখা আছে সেগুলো লিখতে চাই। আর বেঁচে থাকার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। আর এই জীবনের পর কি আছে তাও জানি না। কাজেই এই আনন্দটা আরেকটু স্থায়ী হোক।

বেসিক্যালি সকাল বেলা, এভরি মর্নিং আই রিমেম্বার মাই মাদার। আমার মা, পৃথিবীতে আমার প্রথম ঠিকানা, তার গর্ভ। এটা হচ্ছে আমার প্রথম বাড়ি। ওইখানে ছিলাম। আমার জন্মদিনে মায়ের কথা খুব মনে করি। তারপর পিতা আছে। এই যে মরে যাওয়া... নিজে কি করেছি, কি অর্জন করলাম এইটা কিছু না।

তারপর খুব আশা করি আমার বন্ধুরা যারা জীবিত ছিলেন তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হবে। শামসুর রাহমান ফোন করতেন, শওকত ওসমান ফোন করতেন। এরা নেই কিন্তু এখন এদের কথা খুব ভাবি। বাবা-মার পরই বন্ধুদের কথা খুব মনে হয় যারা চলে গেছেন। লিস্ট করছিলাম প্রায় ২৬ জনের মতো বন্ধু আমার চলে গেছে। যাদের সঙ্গে একসঙ্গে মনে করো প্রায় ১৬ বছর বয়স থেকে।

রহমান হেনরী : সবশেষে আমরা সকলে আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

বাংলাদেশ সময় ১১০, ডিসেম্বর ২৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।