ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

রিটনের ডালপুরিয়ানা এবং অভিবাসী সাহিত্য

সাইফুল ইসলাম, ছড়াকার ও সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১১
রিটনের ডালপুরিয়ানা এবং অভিবাসী সাহিত্য

একেবারেই সাধারণ মানুষ আমি। একসময় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে।

কিন্তু এখন আর তা করি না রাজনৈতিক নেতাদের দীনতা, মেধাহীনতা ও স্বার্থপরতার কারণে। তবে বলতে পছন্দ করি যে, এই দেশকে আমি ভালবাসি। এ কারণে বয়সানুযায়ী ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে থাকতে চেষ্টা করেছি জনতার কাতারে।
 
আমাদের এই দেশের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। হয়তো এ কারণেই ভাষাটা এ দেশের মানুষের কাছে এতো প্রিয়। তাইতো দেখা যায় ভাষার প্রশ্নে সশস্ত্র বর্বর পাকিস্তানিদের মুখোমুখি খুব সহজেই দাঁড়াতে পেরেছিল ছাত্ররা। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য। এদেশের মানুষ এ কারণেই তাদের মাতৃভাষায় যারা লেখালেখি করে তাদেরকেও ভালোবাসে প্রাণ দিয়ে, সম্মান করে মুরুব্বির মতো।

কিন্তু যখন দেখা যায়, এ ভাষার কোনও ‘লেখক’ সচেতন অথবা অবচেতনভাবে তাদের মাতৃভাষাকে খাটো করছে তখন খুব কষ্ট পাই। এ ধরনের একটি কষ্ট থেকেই এ লেখার অবতারণা।

গত ৯ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালের সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘কালের খেয়া’য় লুৎফর রহমান রিটনের একটি লেখা প্রকাশ পেয়েছে যার শিরোনাম ‘খুব মিস করি। ’ লেখার শুরুটা এমন ‘মিস করি’ কথাটা বাংলায় বলা খুব কঠিন। মিস করার বাংলা হয় না, নাকি হয়? জুতসই কোনও বাংলাই খুঁজে পাচ্ছি না। ’

ছড়াকার হিসেবে পরিচিত রিটন এখন কানাডার অটোয়ায় সপরিবারে বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যে এদেশে বেড়াতে আসেন। তিনি অটোয়া থেকে টরন্টো পর্যন্ত পাঁচ শ’ কি.মি. পথ পাড়ি দেন ‘ডালপুরি’ খেতে, কাঁঠালের জন্য ছুটে যান ডেনফোর্থ পর্যন্ত উড়োপথের দেড় শ’ ডলারের রিটার্ন টিকেট কিনে। বাংলাদেশের ডালপুরি কাঁঠাল, কাঁঠালের বিচি ভর্তা কানাডায় সুলভ নয়। রিটন বাঙালির সে সব প্রিয় জিনিস ‘মিস’ করছেন বলে পুরো কানাডা পঁই পঁই করে খুঁজে ফিরেছেন। আর সে সব ‘মিস’ করা জিনিসপত্তর খুঁজে ফেরা নিয়েই লুৎফর রহমান রিটনের ‘খুব মিস করি’ শিরোনামে লেখাটি।

কিন্তু রিটন ‘মিস করা’র বাংলা খুঁজেছেন কি? মিস করির বাংলা খুঁজে না পেয়ে তার কলম এক পলও থমকে দাঁড়িয়েছিল কি?

বিদেশে আমাদের দেশের দুই ধরনের অভিবাসী রয়েছেন। এক ধরনের অভিবাসীরা দেশের বাইরে যান মূলত শ্রম বিক্রি করে টাকা আয় করার জন্য। উইক এন্ডে বাইরে বেড়ানো তাদের পোষায় না টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। ফলে এরা বিদেশি সংস্কৃতির ‘অমৃত-স্বাদ’ আহরণ করতে পারেন না। এ কারণে এরা ঘরে বসেই হিসাব-নিকাশ করেন যে, দেশ থেকে করে যাওয়া ঋণের টাকা কিভাবে শোধ হবে, বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানকে কিভাবে টাকা পাঠানো যাবে। সময় পেলেই তারা বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান-প্রেমিকাকে চিঠি লেখেন নিশ্চয়ই। সেসব চিঠিতে থাকে নানান স্মৃতিকথা। খাবার-দাবারের কথাও লেখা থাকে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেসব চিঠিতে মিস করি কথা লেখা থাকে না নিশ্চই, বরং লেখা থাকে ‘খুব মনে পড়ে’ (এর আরও একটি সমার্থক শব্দ-সমষ্টি হতে পারে ‘পেট পোড়ে’, এটি যদিও আঞ্চলিক, তারপরও আবেগ আর মধুরতায় পূর্ণ একটি শব্দবন্ধ)। যেমন, নেত্রকোণা অঞ্চলে মা-খালারা বলেন: ‘বাবা রে, আমার লাইগ্যা তর পেট পুড়ে না (পোড়ে না)?’  

আমি নিশ্চিত যে ওইসব অভিবাসীর স্বজনরাও এদেশ থেকে চিঠি লেখেন, তাতেও লেখা থাকে ‘খুব মনে পড়ে’ই। এই শ্রেণীর অভিবাসীদের রেমিটেন্সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ে। দেশকে ঘিরেই যেহেতু এদের চিন্তা-ভাবনা, তাইতো এরা ভুলতে পারে না এদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা, রীতি-নীতিকে। বরং বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করে আরো বেশি করে ‘মনে পড়ে’ দেশকে। ফলে দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে, পেট পোড়ে। এই মন কাঁদায় কোনও ভণ্ডামি নেই, নেই নকল বা মেকি-ন্যাকা ভাবের প্রকাশও।
এদেশ থেকে আরো এক শ্রেণীর লোক অভিবাসী হন: শিল্পপতি, আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক, এনজিওকর্মী, সুবিধাবাদী রাজনীতিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা। এরা প্রধানত এদেশের অভিজাত (বা আৎকা লাফ দিয়ে অভিজাত বনে যাওয়া) শ্রেণী থেকে আগত। দেশেই এরা ‘প্রিভিলেজড সোসাইটির’ সদস্য হিসেবে আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন করে থাকেন। এদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ঘটে খুব সহজেই। এরা বিদেশে যেতে পারেন রাষ্ট্রীয় বা কোনও প্রতিষ্ঠানের খরচে। বিদেশে যাওয়ার এ সুযোগ এক সময় তাদের সেখানে স্থায়ী বসবাসেও প্রলুব্ধ করে। তখন তারা বিদেশে পাড়ি জমান পরিবার-পরিজন নিয়ে। পরদেশ হয়ে দাঁড়ায় তাদের সন্তানদের জন্মভূমি, তার নিজেরও দ্বিতীয় জন্মভূমি। ফলে তাকে ভুলতেই হয় তার প্রথম জন্মভূমির শিক্ষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতিকে। কারণ, এসব না ভুললে যে তাদের ঠাঁই হবে না বিদেশ-বিভুঁইয়ে।

বিদেশে গিয়ে রিটন বাংলাভাষাকে ভুলে যাচ্ছেন এজন্য কোনও কষ্ট হয় না, কারণ, যিনি বিয়োগ হয়েছেন, তিনি আর যোগ হবেন না, এটা জানি। কিন্তু কষ্ট হয় যখন দেখি যে এ-ভাষায় তিনি অপ্রয়োজনীয় বিদেশি শব্দ ঢুকিয়ে ‘বাংলিশ’ জাতীয় খিচুড়ি ভাষা সৃষ্টিতে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কষ্ট হয় তখন যখন দেখি যে, এরাই বাংলা একাডেমী পুরস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ আর মর্যাদাকর পুরস্কার বাগিয়ে নিচ্ছেন বাংলাসাহিত্যে ‘বিশেষ অবদান’ রাখার জন্য।

সাইফুল ইসলাম, ছাড়াকার ও সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।