ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

টোমাস ট্রান্সট্রোমার : বাকহীনতাও আটকাতে পারেনি যার ভাষা

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১১
টোমাস ট্রান্সট্রোমার : বাকহীনতাও আটকাতে পারেনি যার ভাষা

১৯৯৬ সাল থেকে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কোন কবি’র হাতে নোবেল যায়নি। গত কয়েক বছর থেকেই নোবেল ঘোষণার আগে গুঞ্জন ওঠে যে, এবার কবিতা নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের হাতেই নোবেল যাচ্ছে।

কিন্তু প্রতি বছরই গুঞ্জনকে পেছনে ফেলেন নোবেলের বিচারকরা। তবে এ বছর সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমার [সুইডিশ উচ্চারন-থোমাস ত্রান্সত্রোম্মের] সাহিত্যে নোবেল পেয়ে গেলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতিবারই সম্ভাব্য বিজয়ীর তালিকায় ট্রান্সট্রোমারের নামটি থাকত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফসকে যেত।

ট্রান্সট্রোমারকে শুধু কবি বললে ভুল হবে; তিনি একাধারে লেখক, কবি এবং অনুবাদক। তার কবিতা নিজ দেশে তো বটেই; সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।

সুইডিশ এ কবির জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল সুইডেনের স্টকহোমে। তার বাবা পেশায় ছিলেন সাংবাদিক এবং মা শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার কলহ তার হৃদয়ে বিষাদের ছাপ ফেলে দেয়। এক পর্যায়ে তাকে মা-বাবার বিচ্ছেদও দেখতে হয়। এরপর বাবার সাথে ট্রান্সট্রোমার খুব একটা দেখা হয়নি। ছেলেবেলায় তিনি গ্রীষ্মের ছুটিতে রানমার দ্বীপে সময় কাটাতেন। এ দ্বীপটি আজও তার হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। তাঁর কবিতায় এ দ্বীপটির চিত্র দগদগ করে ফুটে উঠতে দেখা যায়।

ট্রান্সট্রোমার একসময় প্রত্নতত্ত্ব এবং প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। তখন তিনি স্বপ্ন দেখতেন, সময়টা যদি এ সুন্দর পৃথিবীটা ভ্রমণ করেই পার করে দেওয়া যেত! কিন্তু বয়সের সাথে সাথে তিনি মিউজিক এবং পেইন্টিংসের প্রতি আগ্রহবোধ করেন।

স্কুলে পড়া অবস্থায়ই শুরু করেন কবিতা লিখতে। যত দিন যায় কবিতার প্রতি তিনি ঘোর অনুভব করেন। প্রকৃতিপ্রেমী টমাস পড়াশোনা করেছেন মনোবিদ্যায়। ১৯৫৬ সালে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি কর্মজীবন শুরু করেন।

কিন্তু এ চাকরি খুব একটা উপভোগ করছিলেন না ট্রান্সট্রোমার। যার কারণে ১৯৬০ সালের পর তিনি মনোবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

তবে তার আগেই কবি হিসেবে তিনি সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ‘17 dikter ’(১৯৫৪) কবিতার বইটি দিয়ে কবি হিসেবে পরিচিতি পান। কিন্তু এক সময় তিনি কাজ ও লেখালেখি নিয়ে খুবই দ্বন্দে ভুগতে থাকেন। কাজের ফাঁকে সময় বের করতে খুবই সমস্যায় পড়তে হয় তাকে।

৬০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাজ এবং লেখালেখির সময়কে ভাগ করে নেন। নিয়মতান্ত্রিক জীবনে প্রবেশ করে তিনি লেখার জগতে আবারও নিয়মিত হয়ে ওঠেন। তবে কাজের জায়গা পরিবর্তন করেন। স্টকহোম থেকে ৬০ মাইল পশ্চিমে তিনি তার পরিবার নিয়ে চলে যান  Västerås শহরে।
ভ্রমণ পিপাসু কবি ট্রান্সট্রোমার ১৯৬৬ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশ করেন কবিতার বই Klangar och spar

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/transtromer_custom20111006233247.jpgটোমাস ট্রান্সট্রোমার কাব্যজগত মূলত গড়ে উঠেছিল নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়েই। তাই তাঁর কবিতা ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তিনি তার নিজস্ব স্বত্ত্বাকে কবিতার মধ্য দিয়ে বার বার তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি মানবমনের ভেতরের কথামালাগুলোকে কবিতার ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। একই সাথে কবিতায় তিনি তুলে এনেছেন পরাবাস্তবতাকেও। তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন, মৃত্যু ভাবনা এবং অসুস্থতা; সেই সাথে জীবনের সাথে এ বিষয়গুলোর দ্বন্দ নিয়ে লিখেছেন Mörkseende (১৯৭০)।

তার কবিতা আত্মকেন্দ্রিক থাকলেও মাঝে মাঝে তিনি বিতর্কিত বিষয় নিয়েও কবিতা লিখেছেন। যেমন, সমুদ্রের সাথে মাটির মানুষের যুদ্ধের বিষয়গুলো উঠে এসেছে তার কবিতায়। এমনকি মানুষের বাক স্বাধীনতা নিয়েও তিনি কবিতায় কথা বলেছেন। তিনি বাল্টিক দ্বীপপুঞ্জে আবাসরত মানুষগুলোর জীবনযাত্রা এবং সেখানকার রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কবিতায় বলেছেন। তখনও বাল্টিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সেসময় টোমাস ট্রান্সট্রোমারের রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে মৌলিক লেখকরা ক্ষুব্ধ হন।

হঠাৎ করে ১৯৯০ সালে স্ট্রোক করে ট্রান্সট্রোমার বাকশক্তিহীন হয়ে যান। স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না। এরই মধ্যে আগের বছর তিনি তার দশম কবিতা গুচ্ছের বই প্রকাশ করেন। স্ট্রোকের পর নিশ্চুপ হয়ে গেলেও তিনি কবিতা লেখা বন্ধ রাখেননি। একটু বিরতি দিয়ে আবার ফিরে আসেন ১৯৯৬ সালে Sorgegondolen (grief gondola) কবিতার বই নিয়ে। বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এ বইটি। শুধুমাত্র সুইডেনেই এ বই বিক্রির হয়েছিল ৩০ হাজার কপি।

সুইডিশ একাডেমির সেক্রেটারি Peter Englund নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর  তাৎক্ষনিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জীবনের বড় অংশজুড়ে তিনি কাজ করেছেন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে। তিনি শুধু লেখাকে পেশা হিসেবে নেননি। তাই তার একটা অন্যরকম বিশেষত্ব আছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, তার কবিতার সংখ্যা হয়ত খুব কম। কিন্তু ভাষা ও বিষয়বস্তু নির্ধারণের ক্ষেত্রে টোমাস ট্রান্সট্রোমার আর সবার চেয়ে ভিন্ন। তিনি লিখেছেন জীবনের প্রশ্ন নিয়ে, তাঁর স্মৃতি নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে। তার সৃষ্টি সবাইকে অনুভব করায় যে, ইতিহাস, স্মৃতি এসব কিছু আমাদের মানুষের তৈরি। এটাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও তাঁর কবিতা এ পর্যন্ত জীবিত সব কবিদের মধ্যে সবচে বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬০টি ভাষায় তার কবিতা অনুবাদ হয়েছে।

পিটার তার বক্তব্যে এও উল্লেখ করেন যে, তিনি বাক শক্তি এমনকি চলার শক্তিও হারিয়েছেন।

বাকশক্তি-চলার শক্তি হারিয়ে কবির ভাষাকে আটকে রাখা যায়নি। ভাষাকে বন্দী করা যায় না। এ বছরের নোবেল পুরস্কার পেয়ে সেটাই প্রমাণ করে দিলো টোমাস ট্রান্সট্রোমার।

তিনি তো তার কবিতায়ই বলে দিয়েছেন, "I am the place / where creation is working itself out"।

বাংলাদেশ সময় ২৩০৫, অক্টোবর ০৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।