ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আহমদ ফরাজের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ : গাজী সাইফুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১১
আহমদ ফরাজের কবিতা

প্রখ্যাত কবি আহমদ ফরাজ। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ১৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের ছোট্ট শহর কোহাতে।

দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি তাঁর এক সহপাঠিনীর দ্বারা কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত হন। তাঁর পিতা ‘আগা বুর্গ’ ছিলেন একজন নামকরা কবি, মাঝেমধ্যেই তিনি কবিদের নিয়ে আড্ডা জমাতেন, যেখানে ফরাজও কখনো সখনো অংশ গ্রহণের সুযোগ পেতেন।
 
ওই সময়ই ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই তানহা তানহা (একা একা)। ১৯৬৬ তে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দারদ আশুব’। এই বই প্রকাশের পরপরই তিনি আলোচিত হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণীর কাব্যমোদীদের সঙ্গে। জড়িয়ে পড়েন প্রগতিশীল রাজনীতিতে। এ সময় তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন রেডিও পাকিস্তান ও পিটিভিতে।

আহমদ ফরাজ ছিলেন দেশ-কাল সচেতন কবি। মিলিট্যারি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলম ধরায় ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক সরকারের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন এবং ছয় বছরের জন্য পাকিস্তান থেকে নির্বাসিত হন।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/ahmed-faraz-0120111005194516.jpgআহমদ ফরাজের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে-- কবিতা সংগ্রহ দশটি, নাটক একটি এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার একটি। ওসব বই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচুর প্রশংসিত হয়েছে। কবিতা সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে, Janaan Janaan (১৯৭৬), Be Awaz Gali Koochoon Mein (১৯৮২), Nabeena Shehr Mein Aaina (১৯৮৪), Sab Awazeen Meri Hain (১৯৮৫), Pas Andaz Mosam(১৯৮৯), Bodluk (A play in verse) এবং Peman (১৯৯৪)।

তাঁর রচনা সমগ্র Assasa শিরোনামে চার খণ্ডে প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড আরব আমিরাতের আকিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়। আহমদ ফরাজ প্রয়াত হন ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট। তিনি উর্দুতে কবিতা লিখলেও, এখানকার কবিতাগুলো অনুবাদ করা হয়েছে ইংরেজি থেকে।

কারাগারের একটি সকাল

প্রতিটি নক্ষত্রই ঘণ্টা বাজায়,
যখন রাত নামে সন্ধ্যার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে।
পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ বাতাসের নিবিড় সান্নিধ্য
যেন বা কেউ হঠাৎ শুনিয়ে যায় ভালোবাসার গান।
মধ্য উঠোনে, বিমূর্ত গাছগুলোর
উদ্বাস্তু ছায়া
নকশা করা মানচিত্র আঁকে আকাশে ফেরার।

ছাদের ওপর চাঁদ,
প্রিয়ঞ্জনা, উদার
চোখ রাখে দীপ্তিমান ধূলোয় মাখা নক্ষত্রের দিকে।
প্রতিটি কোণ থেকে, কালো-সবুজ ছায়া
ফেনায়িত তরঙ্গের মতো এগিয়ে আসে আমার পানে
যেন বা ভেঙে পড়বে মাথার ওপর--
বেদনার ঢেউ হয়ে যা জাগে আমার কল্পনায় প্রতিটি মুহূর্তে
আমার বিচ্ছিন্নতার মতো আমার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে।
এই ভাবনা থেকে পাই আমি সান্তনা :
অত্যাচারিরা আদেশ দেয়
‘বাতিগুলো নিভিয়ে দাও
যে ঘরে প্রেমিক-প্রেমিকরা হয় মিলত’,

কিন্তু তারা আকাশ থেকে চাঁদ মুছে দিতে পারেনি আজও
কিংবা পারবে না আগামীকালও, কোনো স্বৈরাচারই সফল হবে না কোনোদিন।
নিপীড়নের কোনো বিষই পারবে না তিক্ততায় ভরে দিতে আমার পেয়ালা
যদি আচমকা কারাগারের একটি সকালকে পারি মধুময় করে তুলতে
কিংবা একটি মুহূর্ত পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের।

[ইংরেজি অনুবাদ : আগা সাহিদ আলী ]


শুনেছি লোকেরা তাকায় তার দিকে

শুনেছি
লোকেরা তাকায় তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে
তাই তাকে দেখার জন্য আমিও কিছুদিনের জন্য গেলাম তার শহরে!

শুনেছি
আশাহতদের জন্য তার রয়েছে গভীর অনুরাগ
তাই নিজেকে ধ্বংস করব আমি আর দেখব সে কী করে!

শুনেছি
তার কোমল চোখেই রয়েছে বেদনার্তের বাজার
সুতরাং আমিও পরিভ্রমণ করব তারই পথে আর দেখব ওই চোখ!

শুনেছি
কবিতার প্রতিও তার রয়েছে উষ্ণ আবেগ
সুতরাং আমার দক্ষতা দিয়ে কবিতা লিখে দেখাব জাদু এবং দেখব সে কী করে!

শুনেছি
যখন সে কথা বলে ফুল ঝরে তার মুখ থেকে
যদি এটাই হয় ঘটনা, আমি তার সঙ্গে কথা বলব এবং দেখব কত ফুল ঝরে!

শুনেছি
চাঁদ নিজেই সারারাত তাকিয়ে থাকে তার দিকে
আর নক্ষত্রেরা আকাশ থেকে খসে পড়ে তাকে এক নজর দেখার জন্য!

শুনেছি হরিণী চপল-চোখ জোড়া তার খুবই মারাত্মক

শুনেছি বিশ্বের সব হরিণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে এবং তাকেই শুধু দেখে।

শুনেছি দিবাভাগে প্রজাপতিরা তার উদ্দেশ্যে কটুক্তি করে
আর জোনাকিরা রাতে ওড়া বন্ধ করে তাকায় বিস্ময়ে, নিষ্পলক!

শুনেছি তার বাঁকা চাহনি কালো রাতের চেয়েও কালো

শুনেছি সন্ধ্যায় তার নিজেরই ছায়া তাকে পেছনে ফেলে যায় দেখার জন্য তাকে।

শুনেছি সুর্মা-টানা চোখ জোড়া তার মায়াবি বড়!
সুতরাং অ্যান্টিমনি বিক্রেতারা ঈর্ষার চোখে তাকায় তার দিকে, বারে বারে!

শুনেছি গোলাপও ঈর্ষান্বিত তার ঠোঁটের দিকে চেয়ে
সুতরাং আমি দোষ দেবো না বসন্তের কিংবা ওই চোখের যারা তাকে দেখে!

শুনেছি ভ্রুযুগল তার একটি আয়নার মতো
সাধারণ পোশাকে সজ্জিত হয়ে নিজেই তাকায় নিজের দিকে, দেখে নিজেরই কায়া!

শুনেছি যদি কখনো সে পরিধান করে তার গলার হার
চুনি আর মুক্তোর সৌন্দর্যও হার মানে তার কাছে এবং তারাও তাকেই দেখে!

শুনেছি সম্ভাবনার রাজ্য তার নির্মাণ করে দেয় কতগুলো কল্পিত চোখ
আর কোণে কোণে পেতে দেয় দড়ি-শয্যা, যেখানে সে খায় দোল!

শুনেছি তার শরীর শিল্পীত বড় ভাস্কর্যের আদলে গড়া
ফুলেরাও তাই তাদের মুখাবরণ খুলে আর তাকেই দেখে!
সাইপ্রিস বৃক্ষের মতো দীর্ঘকায় সে
তবু ভরে থাকে আশা জাগানিয়া গোলাপে
ওই বৃক্ষে যে সব কুড়ি ফুটে ফলের জন্ম দিতে আমিও দেখব তাদের!
এক পলক তাকালেই সে লুটে নেয় আমার হৃদয়ের ক্যারাভান
সুতরাং ইচ্ছের ভ্রমণকারীরা তাকায় তার দিকে ভয়ে,

শুনেছি স্বর্গ ঘুমোয় তার শোবার ঘরের পাশে!
ওই রাজ্য জ্বলে উজ্জ্বল আলোয় ক্ষণে ক্ষণে, আমি দেখি এখান থেকে!
যদি সে চায় স্বর্গ ঘুরে বেড়ায় তার চারপাশে
যদি সে হাঁটে ঈষৎ থেমে গিয়ে তাকায় তার দিকে আর তাকেই দেখে!  
কার এমন সৌভাগ্য যে দেখবে তাকে নিরাভরণ, হায়
মাঝেমধ্যে তার বাড়ির দেয়াল আর তোরণগুলোই শুধু দোল খায় শূন্যে!
ধরো, যা কিছু বললাম সবই গল্প-- সবই আমার কল্পনা
যদি হয় তা শুধু একটি স্বপ্ন আমার দেখতে চাই পুনরাবৃত্তি তার, বার বার!

আমি কি আরও কিছুদিন থাকব তার শহরে নাকি ফিরে যাবো নিজ ঘরে?
ফরাজ, এসো, আমরা দু’জনেই তাকাই, দেখি নক্ষত্ররা কী বলে, আমার এ ভ্রমণপর্ব সম্পর্কে।

[ইংরেজি অনুবাদ : আসিফ জে. নকশবন্দি]
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/ahmad foraz 5520111005200326.jpg

যখন তুমি কাছে আসো

এমনকি যখন তুমি কাছে আসো তখনো আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয় না
আমার এ অপেক্ষা শুধু তেমার জন্য নয়, নিজের জন্যই আমি থাকি দিওয়ানা।
যার সঙ্গে আমি মিলিত হই, বলতে পারি নাম তার
যেন পুরো বিশ্বটাতেই বিশ্বাস আমার হয়েছে একাকার।
যখন সে থাকে অনেক দূরে আমি তুলি আমাদের প্রেমের প্রসঙ্গ
যদি সে থাকে আগের মতো, নিশ্চয়ই করবে না বিশ্বাস ভঙ্গ।
আমি আমার চোখে ধরেছি অশ্রু সারা পৃথিবীর
এই সান্তনা মেনে যে একজন শুনছে আমার কথা হয়ে নিবিড়।
ফরাজ, আমার জীবনেরও সুখ যে সে, কী করব বলো
দোষ যে পড়ে তার ওপর আমার সকল হৃদয় বেদনার।

[ইংরেজি অনুবাদ: আয়েশা কালজুভি]

বাংলাদেশ সময় :  ১৮০১, অক্টোবর ০৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।