ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কুয়োপাড়ে উম্মা

খালেদ হামিদী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১১
কুয়োপাড়ে উম্মা

আপনারা এসব কী কইতাছেন! বাদীরে বিবাদী বানাইবার লাগছেন! কবীর ভাই এমেরিকান বসগো কাছে কুকের বিরুদ্ধে কমপেলেইন দিব না ক্যান! তেলাপোকার মতো কিচেনে যে-পোকাগুলা কিলবিল করে ভাতের লগে, তরকারির লগে, হেইগুলা পাইয়া হে কুকেরে, আপনাগোরে জানাইছে। আর আপনারা হেরে কইছেন, পোকা খাওন ভালা, পোকাতে ভিটামিন আছে।

কবীর ভাইয়ের মতো একটা শিক্ষিত লোকেরে হেইডা আপনারা কী জবাব দিছেন!  তেলাপোকার বাচ্চার মতো মাঝারি সাইজের বাদামি-কালা ডোরা-ডোরা পোকাগুলা আমরাও তো ভাত-তরকারির লগে পাই। আমাগো দুইজন তো পেস্টিং-এর কাম করে। কই, আপনারা যারা মাতবর সাইজা বইসা আছেন, কিচেনে পেস্টিং-এর ব্যবস্থা তো করেন নাই। কুকেরেও কন নাই সাবধানে রাঁধতে।   কবীর ভাই সরল-সোজা মানুষ। এতক্ষণ ধইরা যে হেরে অপমান করতাছেন, একবারও জিগাইছেন উনি কুকের বিরুদ্ধে কমপেলেইন দিছে নাকি পেস্টিং-এর লাইগা রিকোয়েস্ট করছে!  তাছাড়া, আপনারা তো জানেন, হে কমপেলেইন উইতডর করছে। উনার তো এই মিটিংয়েই আসা উচিত হয় নাই।

সালিশের এক কোণ থেকে প্রক্ষেপিত, পেট, বুক, হাত, বাহুমূল, বাহু ও পিঠে দীর্ঘ কৃষ্ণ পশম আর ঠোঁটের ওপর পরিমিত ঘন গোঁফযুক্ত মুন্সিগঞ্জের লম্বা-চওড়া মনিরের এতগুলো বিরতিহীন কথায়, মাতবর সিরাজ এবং তার চামুণ্ডা শামীম পূর্বাপেক্ষা অধিকতর মাত্রায় বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করলে, মনির : ‘এই কবীর ভাই, ওঠেন, এহানে আপনার বইয়া থাহনের কোনো দরকার নাই। চলেন!’ হেঁকে, নিজ উপবেশন থেকে এক লহমায় উঠে এসে কবীরকে অনেকটা হেঁচকা টেনে সভাচ্যুত করে।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/hamidi 820111002193148.jpgকাঠের রেলিংযুক্ত লোহার সিঁড়ির, পরস্পর বিলকুল পৃথক, কার্পেট মোড়ানো একেকটি ধাপ, অতিক্রমণকালে, একই সঙ্গে নিজের সামনে, ভেতরে এবং পেছনে আনখশিখর হতভম্ব কবীর, হঠাৎ নিজেরই হাতঘড়িতে চোখ পড়া মাত্রই, রাত বারোটার রিয়াদ থেকে চলে যায় কবেকার ভোররাত্রি তিনটার স্বদেশে। সারাদিন য়্যুনিভার্সিটির সারা ক্যাম্পাসে আড্ডা পিটিয়ে বাড়ি

এসে, পুনরায় বেরিয়ে বন্ধুসঙ্গের স্বর্গে নিজেকে হারিয়ে ফিরে পাওয়ার পর, পৈতৃকবাড়ির নিঃসঙ্গ শয্যায় অনিদ্রায় তড়পানোর কত না পর্যায়ে সারা দুনিয়ায় হামাগুড়ি দিতে ইচ্ছে হয়েছে কবীরের!  সমগ্র রাত্রি আড্ডা-ফেরত খাঁ-খাঁ অস্তিত্ব উদযাপনের অন্তিমে, ভোরের আজানের সমকালে, তার সত্তা নিংড়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে অক্ষর, শব্দ ও পঙ্ক্তির কতো না শতদল!

দোতলার রুমে এসে মনির হাত ছাড়ে কবীরের। আর অভিযোগের স্বরে পছন্দ ও সমর্থনের আবেগ ঢেলে দেয় : গতকাল বিকালে লিখিত কমপেলেইন পাঠায়া আইজ সকাল সাতটায় হেড অফিসে ফোন কইরা হেইডা উইতডর করছেন। হের আগে কাইল রাইতে আপনি সিরাইজ্যাগো রুম থিকা গেইটে ফোন কইরা সন্দিপ্যা আবিদউল্লার লগে এই কমপেলেইনের ব্যাপারে কথা কইছেন। আপনি মনে করছেন সিরাইজ্যা ঘুমাইছিল।   কিন্তু হালায় আপনার টেলিফোনের সব আলাপ হুনছে। ভোরে উইঠা হে হগল গার্ডেনাররে বুঝাইছে আপনি কুকের চাকরি খাইবার লাগছেন; হগলতে এক হইয়া এই অঘটন ঠেকাইতে হইব। এই কথা হুইন্যা আপনি ডরে কমপেলেইন উইতডর করলেন। আর সন্দিপ্যা আবিদউল্লা হালায় মুখচোরা কাপুরুষ। হে কাইল রাইতেও আপনার লগে আছিল আর আইজ সালিশে আইল না। আর, আপনারেও কই, এত লেখাপরা কইরা এত ডরাইলেন কিয়ের লাইগা! ডরাইয়া হেইডা উইতডর করলেন তো করলেন, আবার সালিশে গেলেন কোন আক্কেলে! দেশে থাকলে এই লোকগুলা আপনার সামনে খাড়াইতে পারত?  এই কিচেনে আর খামু না। রেডি হন, লন, বাইরে থিকা খাইয়া আহি।

মনির, দু-বছর আগে দেশে ছুটি কাটিয়ে ফেরার সময় আনা, বর্তমানে মলিন, তার শাদা ফতুয়া আর আধ-নতুন কালো প্যান্টে প্রস্তুত হলেও কবীর যে কখন তার স্প্রিং-এর আরাম-শয্যায় এরই মধ্যে ক্রমান্বয়ে নিথর হয়ে এলিয়ে পড়েছে, এয়ার-টাইট রুমের চার দেয়াল এবং কাচ ও কার্টেইনযুক্ত একমাত্র জানালাটিরও দৃষ্টিগোচর হলো না। কবীর জ্ঞান না হারালেও দ্বিতীয়বারের মতো এসে পড়ল জনশূন্য কিন্তু থকথকে অন্ধকারে পূর্ণ এক বিশাল অতল কুয়োর ঠোঁটে। নিজের শতকরা দুশো ভাগ পতন-আশঙ্কামণ্ডিত অবস্থানের একেবারে শেষ বিন্দুতে। এই কূপের পরাবাস্তবতা অথবা অপরিসীম গহন বাস্তবতা, জনাকীর্ণ অবস্থায়ও সে প্রথম, দুই চর্মচক্ষে এবং অনতি পরেই চোখ বন্ধ করেও, প্রত্যক্ষ করেছে। একই সাথে সারা শহরে সেই চাকরি সন্ধানকালে আর এ দেশের সার্বিক পরিস্থিতিজাত জুজুর তাকে-ঘেরা দৃশ্যমান-অদৃশ্য, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সার্বক্ষণিক উপস্থিতির নানান উত্তুঙ্গ পর্যায়ে। এতৎঅঞ্চলের শৃঙ্খলার কোনোরকম বিরোধিতা না করেও এবং এমেরিকানদের আওতায় বসবাস সত্ত্বেও কেন তার বাঁচা মৃত্যু এবং মরণাধিক আতঙ্কে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে আশিকড়-আশিখর বিদ্ধ হয় বারবার, অবসরেও ভাববার অবকাশও মেলে না কবীরের। তাই বাম বাহুতে মনিরের আলতো স্পর্শ আর তৎপরবর্তী জোরালো-অথচ-মসৃণ আহ্বানে আঁতকে ওঠার পরিবর্তে অবধারিতরূপে কবীর হাশরের মাঠে মৃত্যুত্তর জাগরণের ধরনেই হতচকিত হয়।

ঘুম আইছে? শরিল খারাপ করছে? ওঠেন। হার্ড ড্রাইভার মনিরের ডাক প্রস্তাবে পরিণত হয় : আমার গাড়িতে কইরা সারা রাইত ঘুরবেন?  লন, বাইর হইয়া আগে খাইয়া লই।

কিন্তু পুলিশ আটক করতে না পারলেও গাড়ি থামালেই যে কবীর বহু সহস্রাব্দপ্রাচীন বরফাচ্ছন্ন ফসিলে পরিণত হতে পারে, মনিরের এতোদূর ধারণাও গড়ে ওঠে নি এখনো।   কবীর রজনীজোড়া ভ্রমণের প্রস্তাব সবিনয়ে নাকচ করাতেও গোটা ব্রোস্টেড চিকেন, নানরুটির আত্মীয় আরব্য রুটি খবুজ আর পেপসির ক্যান সহযোগে আতিথ্য সেরে কৃতার্থ বোধ করে মনির। ভিলায় ফিরে তার আদিরসের নানান অভিজ্ঞতা আলমারি থেকে আলনায় স্থানান্তরের এক পর্যায়ে, কবীর হঠাৎ এবং হঠাৎ-ই, নিজেকে আদতে একজন মানুষ, বিশেষত, পুরুষ ব’লে সগৌরবে টের পায়। এরই মধ্যে অবশ্য রেস্তোরাঁয় প্রবেশের খানিক আগে, খাজ্জান স্ট্রিটের কিং খালেদ টাওয়ারের সম্মুখ-সিঁড়িতে উপবিষ্ট বোরকাবৃত তিন আরব তন্বীর মধ্য থেকে স্ফীতকায় অনাকর্ষণীয় চেহারার একজন চকিতে উঠে এসে কবীরের পাৎলুন টেনে হাদা হেলুয়া, এটা সুন্দর মন্তব্য ছুড়ে দিলে, না থেমেও কিঞ্চিৎ সূক্ষ্ম পুলকে নড়ে উঠেছে কবীর অসম্ভব সুস্বাদু মুরগির নিতম্বে কামড় আঁকবার আগের মুহূর্তগুচ্ছে। অন্যান্য দুপুর-রাত্রি-সন্ধ্যা-বিকেলের মতো নীল ছবি না চালিয়েই, এই মাহে রমজানের ভোররাত দুটোয়ও, দুই পৃথক বিছানায় শায়িত উভয়েরই লুঙ্গি, পরিহিত অবস্থায়ই দুই তাঁবু হয়ে ওঠে। প্রত্যেকের স্বাবলম্বনের পরপরই, মনিরের পরিচিত নির্লজ্জতায় দৃষ্টিপাত মাত্র কবীর বিস্ময় মানে : কী করে প্রতিবারই বিশাল অংশ সিক্ত হয় তার পরিধেয়র! রমজান উপলক্ষে পুরো রাত্রিজুড়ে খোলা দোকানপাট-রেস্তোরাঁয় সরগরম, ঝলমলে নগরের স্মৃতি স্বপ্ন হয়ে চক্ষে হানা দিলে ভোরের আগেই উভয়ের রাত্রি নিভে যায় নতুন আয়ুর আমেজে।

পরের দিন মধ্যাহ্নের দিকে ঘুম ভাঙতেই কবীরের কানে বাজে স্মৃতি : বাগানের কাজ ফেলে দৌড়ে এসে নিরীহ আনিস গতকাল সকালে বলেছিল, আপনি জুমার নামাজও পড়েন না, সুযোগ পাইলেই এই দেশের সমালোচনা করেন; এইসব কথা সিরাজ কোম্পানিরে জানাইয়া দিব কইছে।  

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/hamidi 91120111002193844.jpgএই এমেরিকান জোনে কর্মরত বাঙালিদের কেউই মার্কিন কোম্পানির লোক নয়, আরব কোম্পানির মানবসম্পদ। এই পশ্চিমা পাড়ার মুসলিম নাগরিক, লেবানিজ আবে জাবেলির পরামর্শে, তাঁর ভাগ্নে আরব কোম্পানিটির হেড অব অপারেশনসের সঙ্গে, প্রমোশনের আশায় এরই মধ্যে দেখা করে কবীর। সাক্ষাৎকালে হঠাৎ কল্পনাতীতরূপে কবীরের নিগৃহীত হবার বিষয়টিও উল্লিখিত প্রথম স্মৃতিকে ভেদ করে তার একেবারে মর্মে পৌঁছে যায়। প্রথম কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর না দিতেই আকস্মিকভাবে মনিবটি ক্ষোভে ও বিদ্বেষে কর্ণবিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ে ইংরেজিতে : গেদের মতো নখ রেখেছো কেন!  আমি এরকম চরিত্রদের চামড়া তুলে ফেলি। যাও, দূর হও আমার দৃষ্টি থেকে!
   
রুম ত্যাগের প্রাক্কালে কম্পমান কবীরের চোখে টলায়মান অশ্রু দেখে মনিবের ভাষা তৎক্ষণাৎ বদলে যায় : তুমি আমার মুসলিম ভাই; তোমাকে সাহায্য করতে পারি কিনা দেখব।  
ফিল্মি ধর্ষকের ঢঙে হি-হি-হি হেসে আরেক ঘটনা কবীরের এসব স্মৃতিপুঞ্জকে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে ছুটে যায় সব কটি আরব দিগন্তে : ডাউন টাউন থেকে ফিরছিল কবীর। সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ ছোকরা, পিক-আপ ড্রাইভার, হঠাৎ ব’লে ওঠে : সাদিক, শোয়াইয়া দুগদুগ! দোস্ত, তোমার সাথে একটু সঙ্গম করতাম!  

ছেলেটি অনেক বয়োকনিষ্ঠ বলেই হয়তো সঙ্গে সঙ্গে সাহস ও বুদ্ধি দানা বাঁধে কবীরের :
আওয়াল আনা দুগদুগ ইনতা; বাদিন ইনতা মুনকিন ফি দুগদুগ আনা!  আগে আমি তোমাকে করব; পরে তুমি আমাকে করতেও পারো।
 
এই প্রতিক্রিয়ায় নবযুবক শুধু একটি কথাই বলে : ইনতা ফি মোখ!  তোমার আক্কেল আছে!  
আনা ফি এলম্, আনা লাজিম ফি মোখ!  আমার পড়াশোনা আছে, আমার অবশ্যই বুদ্ধি আছে!  
এই শেষ সংলাপটি ছুড়েও ভিলার সামনে পিক-আপ থেকে নেমেছিল কবীর কিছুটা ভয়ে-ভয়ে।   অথচ সেদিন মনিবটিকে কিচ্ছু বলারই সাহস হয়নি কবীরের। তার নিজেরই ভাবনা হয়, উন্নত বিশ্বের স্বীকৃত গেইজম আর আরবের অস্বীকৃত কিন্তু ব্যক্তি ও সমাজজীবনে বহু শতাব্দী ধরে চর্চিত, রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের অভাবে যা এখানে ইজম হয়ে ওঠেনি, প্রাকৃতিকতা বিষয়ে, এ দেশে আগমনের আগে বিশদ কোনো ধারণাই ছিল না তার।   প্রকৃতি না হয় তার আঙুলের ডগাগুলোকে ফিনিক্সের নখের মতো উত্তলই করে রেখেছে! বহুকালের দীর্ঘ ঘন গোঁফ হ্রস্ব করে, কপোল-চিবুক কামিয়ে আর নখ কেটেই তো গিয়েছিলো সে মনিবের দপ্তরে!  এই মনিবই দু-বছর আগে যে স্বদেশের বাতেন ও তারিক কর্তৃক সানন্দে বিদ্ধ গৌরবর্ণ নাঈমকে ‘অপবিত্র প্যাসিভ’ গাল দিতে দিতে তাঁরই মাথার লাল-শাদা রুমালের সাথে ব্যবহৃত দুই বৃত্তের কালো শক্ত চাকতি দিয়ে বেদম পিটিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, সাক্ষাতের পূর্বে কবীরের তা মনেই পড়েনি। এই পৃথিবীর সমস্ত ক্রিয়ায় কর্ম নয়, কর্তারই জয় অনিবার্য বলে তারিক ও বাতেন আরব কোম্পানিটির লোক হয়ে মার্কিনিদের ভিলায়-বাগানে পার্ট টাইম করে আজো আহরণে ব্যস্ত রয়েছে রিয়ালের পর রিয়াল। কবীরের চিন্তাগ্রস্ততায় তারই মগজের কোনো এক বিন্দুতে সিরাজ পুনরায় দাঁড়িয়ে যায়। কানে বাজে, ফখরুলও বলে : সিরাজ আপনে আর মনিররে আরইব্যা গো লাহান মনে করে;  নাঈমের কথা হে-ই হেড অফিসে কইয়া দিছিল বইলা অনেকে কওয়া-কওই করে।  

হঠাৎ স্মৃতির ঘোর বা মোহগ্রস্ততা থেকে নিজের অজান্তেই পাশ ফিরে মুক্ত হতেই মনিরের অনুপস্থিতিতে খানিক শূন্যতা বোধ করে কবীর : অভিন্ন ডে-অফ-এও সে কোথায় গেলো!  

মিনিট পঁচিশেক পরে বাথরুমের দরোজায় টোকা পড়ে, শীতের দুপুরে যখন বিবস্ত্র কবীর বাথটাবে হেলান দিয়ে নাতিশীতোষ্ণ জলে নিমগ্ন।   উদাসীন কবীর দরোজা খুলতেই মনির অকপটে বলে : বাথটাবে ফোম করেন নাই?  করলে আপনারে এইরকম ল্যান্টা দেখতে হইত না!
 
বিগত কয়েক ঘণ্টায় পূর্বাপেক্ষা অধিকতর স্মার্ট হয়ে ওঠা কবীর ছাড়ে না : এটা বাংলাদেশ না; আমার কলিং বেল শুনে সেদিন বিকেলে আবে জাবেলিও দরজা খোলে আগাগোড়া উলঙ্গ অবস্থায়।  
মনির মুচকি হেসে লাঞ্চের তাড়া দিলেও স্নান সারতে কবীরের লেগে যায় আরো তিরিশ মিনিট।

সুইমিং পুলসংলগ্ন স্ন্যাক বারের টোস্টে কবীর বহুবার সকালে সারা পৃথিবীতে জেগে ওঠার আনন্দ পায়। আজ বিলম্বহেতু এর প্রত্যাশা বলবৎঅযোগ্য জেনেই মনিরের আনা গোটা সিদ্ধ আলু, অফ হোয়াইট পানির মতো ঝোলে মটরের ভাঙা দানাগুচ্ছ আর কাঁচা মাংসের মতো দেখতে বেকড বিফের মোট মূল্য আহারের আগেই পরিশোধে উদ্যোগী হলে মনির মনে কিছু নেয় না।

চলেন কাঁচা মাংস খাই! মনিরের রসিকতায় কামের ইঙ্গিত পেলেও তেত্রিশ বছরের কান্তিমান গৌর কবীর, লম্বা-চওড়া-কালো-প্রায় নিরক্ষর-চল্লিশোর্ধ্ব মানুষটির মৌলিক পরিচ্ছন্নতায় নির্ভরতাই খুঁজে পায়। তাই সিরাজের ওই সন্দেহের কথা শুনলে, কবীর নিশ্চিত, মনির সঙ্গে সঙ্গে সিরাজকে ঘুষি মারতে দৌড়ে যাবে।

খাবার প্রথম মুখে নিয়েই মনির স্মৃতি পাড়ে : একদিন দুপুরে আগের পজেটের (প্রোজেক্ট) মুদিরের (আরব মনিব) বাড়িতে ঢুইকা দেখি, হালায় বাগানে গোসল করতাছে; গায়ে একটা সুতাও নাই।   হালার ঝোলাটা কত্ত বড়!  আমি দুই কদম পিছু হটলে হে কয় : তা’ল সাদিক; ইনতা রাজ্জাল, আনা রাজ্জাল, সাওয়া সাওয়া; মাফি মুশকিলা। দোস্ত আসো, তুমিও পুরুষ, আমিও পুরুষ, একই রকম; কোনো সমস্যা নাই।

ঠিক পশ্চিমা কালচার; সাড়ে তিন বছর আগে স’নায় একই অবস্থায় মি. এসপিনোজাকে দেখে আমিও পিছু হটলে হাই ইউ ডুয়িং ম্যান? বলে সেই যে তিনি আমাকে জড়তামুক্ত করলেন, তারপর থেকে এতে আমার আর কোনো অসুবিধাই হলো না। এসপিনোজার ছয় বছরের ছেলেটা তখন তার সঙ্গে কথা বলছিলো।   কবীরের এই সংযোজনে উভয়ের আরো বহু কথা রুমের বাতাসে ধৃত হলে কবীরই আচমকা নাঈমের প্রসঙ্গে নামে, আর, আমাগো দেশে এইরকম পোলা হয়তো লাখে একটা আছে কিন্তু এখানে তো শতকরা ষাইট জনই এই কাম করতাছে।   ভাইয়ে ভাইয়ে উম্মা, মানে, মিল আছে আরকি, বোঝেন না!

মনিরের এই পুনঃহাস্যরসে এখানকার নারী-পুরুষের দার-পরিগ্রহের সংকটটি অনুধাবনের প্রচেষ্টা নেয় কবীর : মোহরানার টাকা নগদ পরিশোধ করে বিয়ে করতে হয় তো, তাই এই অবস্থা। ‘আরব নিউজ’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এখনো তো কয়েক লক্ষ যুবক বেকার। এটাকে অবশ্য পুরা আরব ও পারস্যবিশ্বের হাজার হাজার বছরের কালচারও বলতে পারেন। শেখ সাদীর নাম শুনছেন?

আমি কি লেহা-পরা করছি?  মনিরের এই নির্ভেজাল স্বীকারোক্তিতে কবীর আরো কদ্দুর এগোয় : শেখ সাদী নিজে লিখেছেন, একদিন সকালে তাঁর ওই অভ্যাসের দরুন খেপা প্রতিবেশীরা তাঁর ঘরের দরজা ভেঙে দেখে মদের পাত্র কাত হয়ে আছে; সাদী ঘুমাচ্ছেন আর ক্লান্ত এক বালক বসে আছে পাশে।   তারা সাদীকে দারোগার হাতে সোপর্দ করে। ইরানের সেই সময়কার রাজা ছিলেন শেখ সাদীর ভক্ত। কিন্তু ওই কাজের অপরাধে রাজা তাঁর ফাঁসির আদেশ দিতে বাধ্য হন। ফাঁসির দড়ি নামার সময় সামনে বসে রাজা বললেন : আপনার শেষ কথা কী?  

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/hamidi 220111002193234.jpgসাদী বললেন : আমি অপরাধ করেছি, সত্য। কিন্তু জগতে আমিই তো প্রথম এই অপরাধ করি নাই।   আমার আগে যারা করেছিল, তাদের জীবিত অন্তত একজনকেও আপনি শাস্তি দিলে সেই সাজা দেখে আমি একটা শিক্ষা নেব।
 
সাদীর এই কথায় তাঁর প্রতি রাজার এতদিনের ভক্তি আরো বেড়ে যায়। রাজা বলেন : আপনি সত্যিই জ্ঞানী, মহাজ্ঞানী। তারপর আদেশ দেন : এই, ফাঁসির দড়ি ওঠাও! আর নামিও না!!  শেষে রাজা কবিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।

লাঞ্চ শেষে মনিরের উপসংহার : এখন ওইরকম জ্ঞানী আছে, হেইরকম রাজা নাই।

ইন্টারকমে কল করে কবীরের বিকেলের ঘুম কেন ভেঙে দিলেন বব থরম্যান, কবীর জানতে চায় তাঁর ভিলায় গিয়ে। ইংরেজি জানে না বিধায় সঙ্গে যেতে রাজি হয় না মনির। আর কিছু না, থরম্যান তাঁর কর্মস্থল রিয়াদ এয়ার বেইসের ক্লিনার, আরেক আরব কোম্পানির আলীকে গেল সপ্তাহের মতো আজও দেখতে যাবেন। মানিকগঞ্জের নিরক্ষর বিত্তহীন আলী আরবি শিখেছে, ইংরেজি নয়। তা এজন্যই কী, কবীর নিজেকেই বলে : পৃথিবীর সব অর্থবিত্ত কথা বলে ইংরেজি ভাষায়! থরম্যান উদার, পরোপকারী এবং অমায়িক এক ব্যতিক্রমী এমেরিকান বিধায় তাঁর প্রতি আলাদা একটা টান বোধ করে কবীর। আরেক বাঙালিকে দিয়ে নড়বড়ে বাংলায় লেখানো চিঠির ইংরেজি অনুবাদ করে এবং ববের মৌখিক ইংরেজি উত্তর লিখিত বাংলায় আলীকে জানিয়ে দুজনকেই বেশ কয়েকবার পরোক্ষে সাহায্য করেছে কবীর। সেই পত্রগুচ্ছের বিষয় অনুসারে আলীর ভাইকে এ দেশে আনার খরচ জোগাতে, আলীদেরই আবাসনের দিকে যাত্রা করতে, কবীরকে পাশে বসিয়ে, ব্র্যান্ড নিউ ফোর্ড গাড়িতে স্টার্ট দেয় থরম্যান। গাড়ি আন্ডারগ্রাউন্ড, হাইওয়ে এবং অতঃপর প্যারাবোলা আকৃতির ফ্লাইওভারে ওঠা পর্যন্ত লাঞ্চের সময় মনিরের দেওয়া দুই মার্কিন ভিলায় পার্ট টাইমের প্রস্তাব এবং সংশ্লিষ্ট অগ্রিম কল্পনায় কবীর নিশ্চুপ থাকায়, আর্থিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছো? বলে প্রথমবারের মতো বিস্ময়কররূপে সরব হয় থরম্যান। কবীর সম্পর্কের আবেগে আর্দ্র হয়ে নিজেরই মাথায় প্রশ্ন তোলে : দুই হৃদয়ের কি কোনো অভিন্ন বেতার তরঙ্গ থাকে?

লাইব্রেরির চাকরি আর কতদিন করবে! আল-সালাম এয়ারক্র্যাফটে দাপ্তরিক কাজের জন্য এপ্লাই করে দেখতে পারো। তুমি বললে আমি ফর্ম এনে দেব।

বরাবরের মতো হিতাকাক্সক্ষায় পূর্ণরূপে বাক্সময় হতে শুরু করেন বব। কবীর নিজের বিষয়ে কিছুই না বলে আরবে মার্কিন ভূমিকা সংক্রান্ত প্রশ্ন তুললে বব প্রথমেই, এই অঞ্চলে, বাংলাদেশের শ্রম প্রচ- নির্মমতায় শোষিত হবার পুরো পদ্ধতির সমালোচনা করেন। অকপটে স্বীকার করেন তিনি, এই পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় এমেরিকার কর্তৃত্বও দায়ী।  

এ দেশে গণতন্ত্রের কথা বলে না কেন তোমাদের সরকার?  কবীরের জিজ্ঞাসায়, বব থরম্যান, একমাত্র এমেরিকান, কবীরদের পাড়ায় অশ্রুতপূর্ব এবং এতৎঅঞ্চলে উচ্চারণ-নিষিদ্ধ এক ভয়ংকর সত্য, কবীরই অনুভব করে,  সারা জগতের বাতাসে-পবনে-বায়ুতে-হাওয়ায় বিকীর্ণ-প্রকীর্ণ করেন : এমেরিকা এ দেশের তৈলসম্পদ পেয়ে গেছে তো, তাই এখানে আর গণতন্ত্রের দরকার নেই। আমাদের সরকার একটা শয়তানের সংগঠন। ফ্লোরিডায় তৈরি কৃত্রিম খনিতে আগামী দুই শ বছরের তেল এখান থেকে নিয়ে মজুদ করা হয়েছে। আরবের খনিগুলো একসময় তৈলশূন্য হয়ে পড়বে। শূন্য হলে প্রতিটি খনির চারপাশের এলাকায় ভূমিকম্প হবে। অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধসে পড়বে। আরব জাতি আবার ভিক্ষা করবে। কিন্তু রাজ পরিবারের লোকেরা ইয়োরোপ-এমেরিকায় পাড়ি জমাবে। এখন থেকেই তারা সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে।

বব থরম্যানকে বুকে চেপে ধরতে ইচ্ছে করে কবীরের। গাড়ি ততক্ষণে আলীদের অসংখ্য ক্যারাভ্যানময় ঘন কম্পাউন্ডে প্রবেশ করলে থরম্যান বলেন : নিরীহ আলীকে তোমারও ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে।

কিন্তু আলী এবং তার সহকর্মীদের কয়েকজন কবীরের কুশল জিজ্ঞাসায় নিরুত্তর থাকায় এবং আপ্যায়নের ব্যবস্থাকল্পে অপর ক্যারাভ্যানে চলে যাওয়ায় কবীর ববকে মুসলিম উম্মাহ বিষয়ে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়। বব আবারও অভূতপূর্ব এমেরিকান হিসেবে ঝিলিক দিয়ে ওঠেন : ইঙ্গ-মার্কিন প্ররোচনায় অথবা যেভাবেই হোক, ইরান-ইরাক আট বছর যুদ্ধ করেছে। ইরাকের সুবাদে প্রথমে কুয়েতে এবং পরে খোদ ইরাকে ঢুকে পড়েছে পশ্চিমা শক্তি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে এই আরব রাষ্ট্রগুলি মৌন অপরাধ করে যাচ্ছে। তাহলে তুমি বলো উম্মাহ কোথায়? আমি নিজেকে খাঁটি খ্রিস্টান মনে করি। আমি বলবো, পশ্চিমা সভ্যতা খ্রিস্টীয় ঐশী চেতনার ফল। কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে তো কোনো ঐক্য দেখি না!

মুসলিম অনৈক্যের অভিজ্ঞতা আর শূন্য তৈলখনির চিত্রকল্পে কবীর পুনরায় সেই জল নয়, তেল নয়, থকথকে অন্ধকারময় বিশাল অথৈ গহ্বরের নিকটবর্তী হয়। আর, ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নে পতনের পরিবর্তে এক পাশ হতে ও-পাশে অহেতুক উল্কার ধরনে পলকের জন্যে জ্বলে ওঠে হকিং-এর বিগ ব্যাং, কবীরেরই মাথার ভেতর। নিজ অস্তিত্বে এক সর্পিল শৈত্যের আক্রমণ এড়াতে সে আলীদের সন্ধানে ববকে একা রেখে বেরুতেই হাস্যরত তাদের সকলেরই সাক্ষাৎ মেলে : একে তো সুন্দর মানুষ, তার উপরে আবার সা’বের লগে ভডভডাই ইংলিশ কইতাছেন দেইখা আমরা মনে করছি আপনে হের দেশি;  দুই-চাইরডা বাংলা শিখছেন।

কবীর এতে সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ বোধ করলেও অনতি পরেই নিজের এনটিটিকেই ব্যঙ্গাত্মক ঠেকে নিজের কাছে। পরক্ষণে ‘ধুত্তোরি! আমি এত সেনসিটিভ কেন!’ বলে নিজের মন কিংবা মনস্তত্ত্বকে ধাক্কা দিয়ে ববের অনুরোধে আলীদের সাথে তাস পেটাতে বসে যায়।

এশার আজানের সময় ভিলায় ফিরে কবীর রুমে ঢুকতেই গাজীপুরের চল্লিশোর্ধ্ব ইব্রাহিম মোল্লা আধখোলা দরোজা সজোরে ঠেলে ভেতরে আসে। মান বাংলা বলতে নিজের ধরনে সচেষ্ট, গার্ডেনার, সদা হাসিখুশি-শ্রদ্ধাশীল মোল্লা এখন উদ্বেগে অস্থির, চিকন ঘামে প্রায় সিক্ত। এসেই জানায় : এখান থেকে কাজ সাইরা বাথা গিয়া ছোট্ট হোটেলটার কিচেনে ঢুকলাম। ওই আমার পার্ট টাইমটা আর কি! কাপ-পিরিচ দশটাও ধুই নাই, ষাইটের মতো বয়স এক সৌদি লোক, কোত্থেকে আইসা তার ভাষায় কইল : কোথায় চাকরি কইরা আইলি?  জানস না আমাদের দেশে পার্ট টাইম হারাম!  

বইলাই আচানক তোপ (আপাদকণ্ঠ ফুল হাতা, কলারযুক্ত সফেদ জামা) খুইলা ফেলল আর আমারে প্যান্ট খুলতে কইল। কী বিরাট, মোটা রে বাবা! তার লগে হেঁচকাহেঁচকি কইরা দৌড়াইয়া বাহির হইয়া লিমোজিনে কইরা চইলা আইলাম! আর তাড়াহুড়া কইরা উইঠা দেখলাম ড্রাইভার এক পাঠাইন্যা। সে আমাকে বলল : পাঁচ দিন তক কুছ নেহি মিলা!  

আমার এই অবস্থায়ও আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম পাঁচ দিন আগে তার কী মিলছিল। সে কইল : ফিলিপিনো ল্যাড়কা।  

আগের ভয়ের সাথে রাগ যোগ হইল আমার। পাঠাইন্যা মুসলিম কিনা জিগাইলাম। সে গর্ব কইরা কইল : জরুর! জরুর!  আর তার এক হাতের দুই আঙ্গুল (তর্জনী ও মধ্যমা) প্রায় এক কইরা দেখাইয়া (মোল্লাও কবীরকে দেখালো) কইল : লেকিন ইয়ে নেহি মিলেগা তো ইয়ে ভি (সাথে সাথে বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীতে রিং তৈরি করে) মারনা পড়েগা।  
শুনে বহুদিন পর কবীর হাসে, অট্টহাসে। সন্ত্রস্ত মোল্লাও হেসে গলে পড়ে চেয়ারে।

বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নির্বিঘ্ন হবার আনন্দে অনেকটা হেলেদুলে রুমে ঢুকে মনির জানায় : কবীর ভাই, হুনছেন?  সিরাইজ্যা ধরা খাইছে। সাত মাস আগে যে হে দেশে গিয়া আনিস, ফখরুল, এয়াকুব আর মোজাম্মেলের ভাই-বেরাদারগো লাইগা ভিসা পাঠানর কথা কইছিল, হেইডা ছিল ভুয়া। হে এই চাইর জন থিকা পাঁচ হাজার রিয়াল কইরা লইয়া তিন মাসের ছুটির সময় দেশে সেমি-পাক্কা ঘর তুলছে। খবর সব এখন বাইর হইছে। আর সিরাইজ্যা স্বীকার যাইতাছে না, কইতাছে এজেন্টে সব ট্যাকা মাইরা দিছে। সিরাইজ্যা এতদিন এই ভিলায় মাতবরি করনে বেকুব আনিসরা হেরে মারতেও পারে নাই। বিকালে আপনি যাওনের পরে খুব হাউকাউ হইল। দেহেন গিয়া সিরাইজ্যা এখন মাথা নামাইয়া হাঁটতাছে। হে নাকি কইছে চাকরি কইরা সব ট্যাকা শোধ করব। কইলেই হইল?  এইডা আরেকটা মিথ্যা আশ্বাস আর কি! হে ক্লিনার থিকা গেইট গার্ড হইয়া ছয় শ রিয়াল বেতন পাইলেও, সাথে পার্ট টাইম কইরাও এত ট্যাকা শোধ করতে পারব না। বিশ হাজার রিয়াল যোগাইতে এই দুনিয়ায় হের আরো কয়েকবার জনম লইতে হইব। হে তো শুধু এই চাইর জন না, বাথার বাংলাবাজারের আরো কয়েকজন থিকা ট্যাকা নিছে।   আপনি হেরে, ভিলার নিচতলার হগলের একতারে ডরাইছেন না? হেই একতা এখন ভাইঙ্গা গেছে। ডরের কিছু নাই। আর আপনি তো কুকের চাকরি খাইতে চান নাই, হেরে অন্য পজেটে টেরাঁসফার করাইতে চাইছিলেন।
 
ইব্রাহিম মোল্লা মনিরকে শেষ কথাটি বলতে না দিয়ে সহজাত শ্রদ্ধাশীলতায় এগোয় : মনির ভাই, আমিও আপনার মতো কবীর ভাইয়ের লগে আছি, থাকব। মুরুব্বিরা কইছে : মূর্খ খারাপ লোকের সাথে বেহেশতে যাওয়ার চাইতে শিক্ষিত ভালো মানুষের লগে দোজখে যাওনও বহুত ভালো।

কিন্তু মনির ও মোল্লার সামনেই অথচ উভয়েরই অগোচরে, কয়েক নিমেষে, তারই এ পর্যন্ত অতিক্রান্ত আয়ুর সমস্ত সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরজুড়ে প্রতারিত মানুষদের সঙ্গে জীবন বদল করে স্তব্ধ কবীর।   ঈদের সপ্তাহখানেক আগেও এখানকার বাঙালি সমাজ স্বদেশে টাকা ও উপহার সামগ্রী পাঠানোর ব্যস্ততায় মুখর।   এরই মধ্যে ব্যাংক-মারফত যারা টাকা পাঠায়নি, তারা পরিচিত কেউ দেশে যাচ্ছে শুনলেই তার ওপর প্রায় হামলে পড়ছে। আর, আলীদের মতো যাদের বেতন দুশো রিয়ালেরও কম এবং মার্কিন পাড়ায় বসবাসের সৌভাগ্য হয়নি তারা লুকিয়ে-চুরিয়ে অথবা পুলিশের শ্যেনদৃষ্টির সাময়িক আড়ালে ফেরিঅলা সেজে বাড়তি উপার্জনের চেষ্টায় ঘনিষ্ঠ রয়েছে। কবীর দেখে, এই মানুষদের চোখের কোণে প্রতিদিনই মরুবালুকার নামে জমে একেক কণা মাতৃভূমি।

আরে দেখেন, কবীর ভাই আবারও চিন্তা করতাছেন! কী অত চিন্তা করেন!  চলেন, বাইর হই। পরথমে একটু বাথা যামু, আমার এক দেশির লগে পাঁচ মিনিট দেখা করুম, হের বাদে বেরামু। মোল্লা ভাই, আপনিও চলেন।

মনির-চালিত কার-এ, তার তাগাদায়, অতঃপর তিনজনই বাথায় এলে বাংলাবাজারের সামনে কবীর ছাড়া বাকি দুজনই নেমে পড়ে। জনম-লির চলমান ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ কবীরের চোখে পড়ে, গাড়ির পাশের ফুটপাতের সামনের অংশে, বাংলাবাজারের প্রবেশমুখের কিনারে, এক পুলিশ শার্ট-লুঙ্গি পরিহিত বাংলাদেশের একজন নাগরিককে চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি-পদাঘাতে ভেঙে ছত্রখান করছে। কিন্তু এই সংঘট্টের আশেপাশে কোনো লোকসমাগম নেই।  

হুনলাম এরে বাংলাবাজারের ভিতর থিকা বাইর করছে; পান-বিড়ি বেচতে ছিল, তাই। চলেন, আমরা লং ডেরাইভে যাই, এয়ারপোর্ট টাচ দিয়া আহি।

বলেই মনির গাড়ি ছাড়লে মোল্লার মন খারাপ হয়। ‘কবীর ভাই!’ ডেকে সে আরো নিথর হয়ে পড়ে।

পেছনের সিটে মোল্লার ডানে উপবিষ্ট কবীর নিজের চোখের ভেতরে টের পায় সেই প্রকা- খাদ, এবার বহু দূর থেকে ধীরে ধেয়ে আসছে তারই দিকে। নিজের অজান্তেই দু হাত প্রসারিত-প্রলম্বিত করলে, মাথায় স্পর্শ পেয়ে মনির কিঞ্চিৎ চমকে ওঠে। কিন্তু কবীরের মনে হয় খাদটির থকথকে অন্ধকার সে দুই মুঠোয় কচলাতে পারবে। নিয়নের সারি সারি আলো ও রাত্রির আঁধারে ঝলমল, দুই ধারে বৃক্ষশোভিত সুনসান এয়ারপোর্ট রোডে অনন্ত পর্যন্ত ছুটে চলেছে মনিরদের গাড়ি। আর, বর্তমানকে তাক করে কবীরের পশ্চাতে ওই সরীসৃপ-শৈত্য একের পর এক অতিক্রম করে চলেছে মানবেতিহাসের সব কটি সূর্যাস্ত।

বাংলাদেশ সময় ১৯৩৫, অক্টোবর ০২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।