ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ব্যানকো [পর্ব-২]

মূল : হেনরি শ্যারিয়ার, ভাষান্তর : আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১১
ব্যানকো [পর্ব-২]

[দুনিয়াজুড়ে সাড়া জাগানো এবং দীর্ঘদিন ধরে বেস্ট সেলার, জেলপালানো কয়েদির মনোমুগ্ধকর আর শিহরণ জাগানিয়া কাহিনী ‘প্যাপিলন’। ফ্রান্সে জন্ম নেয়া হেনরি শ্যারিয়ার ওরফে প্যাপিলন লিখিত বাস্তব এই ঘটনা নিয়ে একই নামে হলিউডে সিনেমাও হয়েছে।

 

১৯৩১ সালের অক্টোবরে ফরাসি আদালত কর্তৃক বিনা অপরাধে (প্যাপিলনের দাবি মতে) খুনের আসামি হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৪ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত পরবর্তী ১৩টি বছর হেনরি শ্যারিয়ারের জীবন কেটেছে জেল পালানো এবং আবারো জেলে ফেরার মধ্যে দিয়ে। তবে সত্যিকারার্থে প্যাপিলন জেলমুক্ত হন ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর। এদিন এল ডোরাডো কারাগার থেকে প্যারালাইসিস আক্রান্ত আরেকজন প্রতিবন্ধী কয়েদি পিকোলিনোসহ মুক্ত হন প্যাপিলন।

হেনরি শ্যারিয়ারের দীর্ঘ ১৩ বছরের ফেরারি এবং জেল-জীবনের  হৃদয়স্পর্শী, দুর্ধর্ষ, মানবিক আর আবেগমথিত অমানবিক সব অভিযানের কাহিনী লেখা হয়েছে প্যাপিলন-এ।

এরপরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে শ্যারিয়ার রচিত দ্বিতীয় বই ‘ব্যানকো’ তে। স্পেনীয় দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে জন্মভূমির মুক্তি আনয়নকারী মহান নেতা সিমন বলিভারের দেশ এবং বর্তমান সময়ের আলোচিত নেতা হুগো শ্যাভেজের দেশ ভেনিজুয়েলা’র একজন নাগরিক হিসেবে শুরু হয় তার নয়া জীবন। প্যাপিলনের শেষ পৃষ্ঠায় ছিল এল ডোরাডো পেনাল সেটলমেন্টের অফিসার প্যাপিলনকে ‘গুড লাক’ বলে বিদায় জানাচ্ছেন।

আর ব্যানকো’র কাহিনী শুরু ঠিক এর পর থেকে। প্যাপিলনের মতই ব্যানকো-ও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনায় জমজমাট, শ্বাসরুদ্ধকর আর এক নিঃশ্বাসে পড়ার মত। যারা প্যাপিলন পড়েননি তাদেরও নিরাশ করবে না এই কাহিনী। এখানে প্যাট্রিক ও’ব্রায়ান-এর করা ব্যানকো’র ইংরেজি অনুবাদের সংক্ষেপিত বাংলা রূপান্তর করা হয়েছে। বিভিন্ন নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই অনুসরণ করা হয়েছে, যেমন- ফরাসী শব্দ ‘পাপিলঁ’-কে করা হয়েছে প্যাপিলন, আবার লেখক অঁরি শারিয়ারকে করা হয়েছে হেনরি শ্যারিয়ার।


http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/banco www20110929173743.jpgবারে যাওয়ার পথে চলতে চলতে আমি বললাম, জোসে তুমি এবং তোমার পুরো পরিবার আমাকে মুক্তির প্রথম দিন থেকেই আপন করে নিয়েছো- এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমি প্রায় তোমার সমবয়সী। তোমাদের এই নিঃশর্ত আতিথেয়তার প্রতিদানে অসৌজন্যমূলক কিছু করে আমি কৃতঘ্ন হতে চাই না। তুমিও একজন পুরুষ মানুষ। সুতরাং তুমি ভাল করেই বুঝতে পারছো যে, যদি আমি তোমার মেয়েদের মাঝে থাকি তাহলে ওদের যে কোন একজনের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়াটা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে আমি তোমার মেয়েদের মধ্যে সবার বড় জনের চেয়েও বয়সে দ্বিগুণ। এছাড়া আমি আইনগতভাবে বিবাহিত, ফ্রান্সে। তাই চল; ভাল হয় বারে গিয়ে এক-দুই পাত্র পান করি, এরপর তুমি আমাকে সস্তা দরের কোন বোর্ডিং হাউসে নিয়ে যাবে, যেখানে আমি কুলোতে পারবো।

‘তুমি একজন সত্যিকারের মানুষ। ’ সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে বললো জোসে। ‘অন্তরের উষ্ণতা দিয়ে তোমার সঙ্গে আমাকে করমর্দন করতে দাও আগে- একজন ভাইয়ের মর্যাদায়। আমার মত তুচ্ছ একজন মানুষের জন্য তুমি যা ভেবেছো তা এক কথায় অসাধারণ। শোন এনরিক, তুমি সম্ভবত খেয়াল করেছো এই দেশটি, মানে ভেনেজুয়েলা, তুমি যে দেশ থেকে এসেছো তার মত নয়। এখানে প্রায় কেউ-ই আইনগতভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নয়। তোমাদের একে অন্যকে পছন্দ হয়েছে?-- ঠিক আছে! ভালোবাসাবাসিতে মেতে উঠো। এবং যদি এতে সন্তানের আগমন ঘটে, তাহলে ঘর বাঁধো। যেমন সহজে এখানে সম্পর্ক গড়া যায় ঠিক তেমনি সহজে ত্যাগও করা যায়। আবহাওয়া এখানে খুবই উষ্ণ এবং এই উষ্ণতার কারণেই এখানকার মেয়েগুলো টগবগে উষ্ণ স্বভাবের অধিকারী। তারা ভালোবাসা আর শারীরিক প্রেমের জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে। এখানকার মেয়েরা সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয় দ্রুত। অবশ্য মারিয়া একটি ব্যতিক্রম; যদিও সে আঠারোয় পড়েছে তথাপি ওর সঙ্গে এখনো কারো সে ধরণের কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আমি মনে করি তোমার নিজ দেশের নৈতিকতার মাপকাঠি অনেক উঁচু স্তরের, কারণ আমাদের এখানে এমন অসংখ্য মেয়ে আছে যারা সন্তানের মা হয়েছে কিন্তু পিতৃ-পরিচয় নেই। এবং অবশ্যই এটা একটা গুরুতর সমস্যা এখানে। কিন্তু এর প্রতিকারে তুমি কি করতে পারো? সদাশয় প্রভু বলেছেন, একে অন্যকে অবশ্যই ভালোবাসতে এবং সন্তান উৎপাদন করতে। আর এই দেশে মেয়েরা কখন নিজেকে কোন পুরুষের কাছে বিলিয়ে দেয় তার হিসাব বড় একটা রাখে না- মোদ্দা কথা তারা কোন সামাজিক বা লোকাচারজনিত নিয়মনীতির বন্ধনে নেই। তারা স্রেফ ভালোবাসতে চায় আর বিনিময়ে চায়ও ভালোবাসা’ই। ব্যাপারটা ঠিক তাই, অত্যন্ত স্বাভাবিক; এর বেশি কিছু নয়। যৌনাকাংখার তাড়নায় যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাকে চাইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বিশ্বস্ত।   যখন এই যৌন-ভালোবাসার জোয়ার কেটে যায়, তখনকার ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়- সেটা ভিন্ন কাহিনী। এতদসত্ত্বেও তারা চমৎকার মাতা হয়ে থাকে, সন্তানের মঙ্গলে অন্যান্য সমাজের মায়েদের মতই চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত, এমনকি যখন সন্তান নিজের পেট নিজে চালানোর মত কর্মক্ষম হয়ে ওঠে তখনো তাদের আগলে রাখে মমতার বন্ধনে, সহসাই কামাই-রুজিতে লাগিয়ে দিতে চায় না।

সুতরাং, যদিও আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি তুমি এক ধরনের দ্বৈরথে ভুগছো সারাক্ষণ, তারপরও আমি বলবো তুমি আমাদের সাথেই থেকে যাও। তোমার মত একজন মানুষকে নিজের বাড়িতে পেয়ে  আমি আনন্দিত। ’

পানশালায় পৌঁছে গেলাম আমরা। একই সঙ্গে এটা বারও আবার মুদি দোকানও। জনা বারো লোক বসে আছে। আমরা সামান্য কিউবা-লিব্রেস পান করলাম- কোকাকোলা আর রামের মিশ্রণে তৈরি এক ধরনের শংকর পানীয় এটা। অনেকেই আমার সঙ্গে এসে করমর্দন করে তাদের গ্রামে স্বাগত জানালো। প্রত্যেকবারই জোসে আমাকে তার পারিবারিক বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এই ফাঁকে আমরা প্রচুর মদ্য পান করলাম। যখন বিল কত হয়েছে জানতে চাইলাম জোসে রীতিমত রেগে গেল। সমস্ত বিল ও-ই দিতে চায়। তারপরেও আমি বারম্যানকে তার টাকা না নিয়ে আমারটা নিতে রাজী করালাম।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/BANCO ahsan kabir[222]20110929171342.jpg

এসময় কেউ একজন আমার কাঁধে হাত রাখলো : মারিয়া। ‘বাসায় চল। লাঞ্চের সময় হয়েছে। মদ আর খেয়ো না। তুমি বেশি পান করবে না বলে আমায় কথা দিয়েছিলে। ’ লক্ষ্যণীয়, মারিয়া কিন্তু অবলীলায় আমাকে তুমি বলেই সম্ভোধন করছে।

জোসে অন্য একজনের সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছিলো। মারিয়া তাকে কিছু বললো না কিন্তু বাহু আঁকড়ে আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো।
‘তোমার বাবাকে ডাকলে না?’
: তাকে থাকতে দাও। সে যখন মদ্যপান করে, আমি কিছু বলতে পারি না। এবং আমি কখনোই তাকে ক্যাফে থেকে ডেকে বাসায় নিতে আসি না। যাহোক, তার এসবের দরকার নেই।
‘তাহলে আমাকে যে নিতে আসলে?’
: তুমি আলাদা। খামোখা ভেজাল করো না এনরিক! আমার সঙ্গে চল।

ওর চোখ দু’টো এমন মমতায় আপ্লুত ছিল এবং এতটাই সহজিয়া ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো যে আমি আর তর্ক না করে বাসায় ফিরে এলাম।
‘তোমার একটা চুমু পাওনা হয়েছে,’ বাড়িতে প্রবেশ করতেই মারিয়া কথাগুলো বলে তাঁর ঠোঁট জোড়া আমার গালে, মুখের এক্কেবারে কাছাকাছি ছোঁয়ালো।

গোলাকার টেবিলটিকে ঘিরে আমরা সবাই লাঞ্চ শেষ করেছি, এসময় জোসে ফিরে এলো। মারিয়ার ছোট বোনটি পিকোলিনোকে খাওয়ায় সাহায্য করছিল অর্থাৎ অল্প অল্প করে খাবার মুখে তুলে দিচ্ছিল।

জোসে এসে আমাদের সঙ্গে বসলো। তাকে কিছুটা নেশায় ধরেছে, তাই বিচার-বিবেচনা না করেই কথা বলে যাচ্ছিলো। ‘মেয়েরা আমার, এনরিক তোমাদের ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। ’ সে বলে চলেছে, ‘এতটাই সন্ত্রস্ত যে সে এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। আমি তাকে বলেছি, সে এখানে থাকতে পারে এবং আমার মেয়েরা কী করতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে বিবেচনা করার মত তারা যথেষ্ট পরিণত। ’

মারিয়া আমার দিকে ঘুরে তাকালো, তাকে বিষ্ময়াহত দেখাচ্ছিল, সম্ভবত আশাহতও হয়েছে। ‘সে যদি যেতে চায়, পাপা, তাকে যেতে দাও। কিন্তু আমার মনে হয় না সে অন্য কোথাও এখানকার চেয়ে ভাল থাকবে। ’ এবার আমার দিকে ঘুরে বললো, ‘এনরিক, কাপুরুষতা কোরনা। যদি তুমি আমাদের কাউকে পছন্দ করে থাকো এবং সেও তোমাকে পছন্দ করে, তাহলে তুমি কি জন্যে পালিয়ে বাঁচতে চাইছো?’
: এই কারণে যে সে ফ্রান্সে বিবাহিত। জবাবটা জোসে দিল।
‘শেষ কবে তুমি তোমার স্ত্রীকে দেখেছো?’
: তের বছর হয়েছে।
        
 ‘আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপারটা দেখি তা হল, যদি আমাদের কোন মেয়ে কাউকে ভালোবাসে, তাহলে তাকে যে বিয়েই করতে হবে এমন কোন কথা নেই। যদি কেউ কোন পুরুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, তাহলে ধরতে হবে এটা শুধু তাকে ভালোবাসার জন্যেই, এর বেশি কিছু না। তবে তোমার পক্ষেও আমাদের বাবাকে তুমি যে বিবাহিত এটা জানানো যুক্তিযুক্ত এবং উচিৎ হয়েছে। কারণ এর ফলে তুমি আমাদের যে কারো কাছেই কোন প্রতিশ্রুতি বা দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ থাকবে না, শুধুমাত্র ভালোবাসা ছাড়া। ’

শেষে মারিয়া আমাকে অনুরোধ করলো কোন ধরনের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই তাদের সঙ্গে বসবাস করে যেতে। একই সঙ্গে তারা পিকোলিনোর দেখাশোনাও করবে এবং আমি নির্বিঘ্নে কাজকর্ম করে যেতে পারবো। সে এটাও বললো যে আমি এ বাবদ কিছু মাসোহারাও দিতে পারি, অনেকটা পেয়িং গেস্টের মত-- শুধুমাত্র মানসিকভাবে আমাকে ভারমুক্ত করার জন্যেই মনে হলো তার এ প্রস্তাব। আমি কি রাজী হবো?

ঠিকমত বিচার বিবেচনা করার মত ফুরসত ছিল না আমার। কয়েদি হিসেবে তের বছর কাটানোর পরে স্বাভাবিক মুক্ত জীবনাচারের এইসব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আমার কাছে প্রায়ই নতুন মনে হচ্ছিল। আর ব্যাপারগুলোও যেন খুব দ্রুতই ঘটে যাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে মারিয়া। সেটাই ভালো। ’
: আজ বিকেলে কাজের খোঁজ করতে গোল্ডমাইনে যাওয়ার সময় তুমি কি আমাকে সঙ্গে নেবে? সেক্ষেত্রে আমরা পাঁচটায় রওনা দিতে পারি, রোদ তখন হাল্কা হয়ে আসে। আমাদের গ্রাম থেকে গোল্ডমাইন দেড় মাইলের পথমাত্র। ’
‘তথাস্ত। ’

পিকোলিনোর অভিব্যক্তি আর ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট ফুটে উঠছিল আমার এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে ও কতটা খুশী হয়েছে। তার প্রতি মেয়েগুলোর সহৃদয়তা আর যত্নআত্তি পিকোলিনোর অন্তর জয় করে ফেলেছে। আদপে আমার এখানে থাকাটা প্রধানত ওর জন্যেই ছিল। কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, এখানে আমাকে সম্পর্কের এক দীর্ঘসূত্রতায় জড়িয়ে পড়তে হবে, এবং সম্ভবত এটা আমার এতদিনকার বুনো হয়ে যাওয়া ধাতে সইবে না।

বিগত তের বছরের দীর্ঘ সময় যাবত আমার মাথায় যে প্রতিশোধস্পৃহার ঝড় বয়ে গিয়েছে, যা আমাকে যন্ত্রণাবিদ্ধ ওই বছরগুলোতে এক লহমার তরেও শান্তিতে ঘুমোতে দেয়নি, সহসাই এখানে পৃথিবীর এ শেষ প্রান্তে এসে তার সব রেশ ছেড়ে-ছুড়ে আমার অভিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোন যতি আমি আসলেই টানতে চাইছিনা- শুধুমাত্র একটি মেয়ের প্রেমকাতর মুখের দিকে চেয়ে। সামনে আমার দীর্ঘতর পথ পড়ে আছে। এবং এ যাত্রাপথে আমার যতিগুলো হবে সংক্ষিপ্ততম সময়ের জন্যে। নতুন করে আবার পালে হাওয়া লাগানোর জন্যে যেটুকু সময় অপেক্ষা করা যথেষ্ট, ঠিক ততটুকুই। আর তারপর আবার পূর্ণবেগে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা। কারণ কেন বিগত তেরটি বছর আমি মুক্তির জন্য লড়াই করছিলাম তার পিছনে একটি কঠিন সত্য ছিল, এবং শেষ পর্যন্ত এ লড়াই আমি কেন জিততে পারলাম তার পিছনেও সেই কঠিন সত্যটিই ছিল মূলমন্ত্র স্বরূপ। এ সত্যটা আর কিছুই না-- প্রতিশোধ! ফরাসি আদালতের জুরিবোর্ড, মিথ্যা সাক্ষীর দল, পুলিশ-  এদের সবারই পাওনা বাকি পড়ে আছে আমার কাছে। এগুলো শোধ করতেই হবে আমাকে। এটা এমন একটা বিষয় যা আমি তের বছরের জেল জীবনে কক্ষনোই ভুলতে পারিনি।
          
 গ্রামের স্কয়ারটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। একটি দোকানের নাম দেখলাম প্রোসপেরি। দোকানদার নিশ্চয়ই কর্সিকান অথবা ইতালিয়ান। ছোট্ট দোকানটিতে একজন কর্সিকাবাসীর ঐতিহ্যের ছাপ সুস্পষ্ট। দোকানের মালিক মঁসিয়ে প্রোসপেরি খুব ভাল ফ্রেঞ্চ বলেন। আমার সঙ্গে বাতচিতের পর তিনি ক্যারাটাল স্বর্ণখনির ম্যানেজারকে আমার পক্ষে চাকরির সুপারিশ করে একটা চিঠি লিখে দিলেন। নিঃস্বার্থ এ পরোপকারী ব্যক্তিটি আমাকে টাকা দিয়েও সাহায্য করতে চাইলেন। আমি তাকে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানিয়ে দোকান থেকে বেড়িয়ে এলাম।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/10121a20110929174856.jpg‘এখানে কি করছো প্যাপিলন? কোন নরক থেকে এ জায়গায় হাজির হলে তুমি, বৎস? চন্দ্র থেকে অবতরণ করনি তো? নাকি প্যারাস্যুট থেকে নামলে বাবা? আস ভায়া, আগে তোমাকে একটা চুমু খেয়ে নেই!’ বিশাল এক লোক, কড়াভাবে রৌদ্রভাজা, বড়সর এক খড়ের হ্যাট মাথায়- নিজের পা জোড়ার ওপর লাফিয়ে উঠলো। আমার বিষ্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে ‘আমাকে চিনতে পারছো না’ বলে সে তার হ্যাট খুলে ফেললো।
বিগ শার্লট! বিগ শার্লট, যে প্যারিসের প্লেস ক্লিচি গাওমঁতের সিন্দুক ভেঙ্গেছিল। বেটিগনল্স স্টেশনের সিন্দুকের ক্ষেত্রেও সে একই কীর্তি করেছিল। আমরা সহোদর দুই ভাইয়ের মত গভীর আবেগে একে অন্যকে আলিঙ্গন করলাম। এই আশ্চর্য মোলাকাত আমাদের অনুভূতিতে এমনই নাড়া দিয়েছে যে দু’জনের চোখ দিয়েই আনন্দ আর আবেগের ধারা নেমে এলো। আমরা একে অন্যের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলাম।

‘দোস্ত! অনেক দূরের প্লেস ব্লানচে আর কয়েদখানার পুরনো সুর শুনতে পাচ্ছি, আহ্! কিন্তু কথা হচ্ছে কোন চুলো থেকে উঠে আসলে তুমি? তা পোশাক-আশাকে তো মনে হচ্ছে, তুমি শালা একজন ইংরেজ লর্ড। তারচে’ বড় কথা তুমি আমারচে’ অনেক কম বুড়িয়েছো। ’

: আমি সবেমাত্র এল ডোরাডো জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি।
‘এল ডোরাডোয়! কদ্দিন ছিলে?
: এক বছরের কিছু বেশি।
‘আমাকে কেন জানাওনি? আমি জামিন হয়ে আগেই ছাড়িয়ে আনতে পারতাম। যীশুর কীরে! জানতাম এল ডোরাডো জেলখানায় কিছু রথী-মহারথী রয়েছেন, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি যে তুমিও তাদের মাঝে তশরিফ এনেছো, মক্কেল কোথাকার!
: আসলে তোমার সঙ্গে আবার মোলাকাত, এটা একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা।
‘তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, প্যাপি? সিঁউদাদ বলিভার থেকে এল ক্যালাও পর্যন্ত পুরো ভেনেজুয়েলান গায়েনা জেল পালানো ঘুঘু আর মার্কামারা সব গুরুতে সয়লাব হয়ে আছে। আর যেহেতু ছাড়া পেয়ে তোমার ভেনেজুয়েলার মাটিতে এটা পয়লা অবতরণ, তাই ভবিষ্যতে পারিয়া উপসাগর থেকে এই এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত চরাচরে সাবেক স্যাঙ্গাতদের যে কাউকে খুঁজে পেলে বিস্মিত হওয়া উচিৎ হবে না তোমার। আমাদের মত সমাজচ্যুত বানচোতদের সব শালাই এ পথের বাধ্যতামূলক যাত্রী এখন। অর্থাৎ বেপথু সব চিড়িয়াই একের পর এক এখানে হাজির হচ্ছে। তা তুমি কোথায় ডেরা বেঁধেছো?
: জোসে নামের এক সদাশয়ের আশ্রয়ে। তাঁর চারটি কন্যা আছে।
‘হ্যাঁ, আমি চিনি তাকে। সজ্জন ব্যক্তি, যদিও জলদস্যু। চল, তোমার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসি ওর ওখান থেকে। এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গেই থাকছো, খবরদার কোন গাঁইগুঁই চলবে না!’
 : আমি একা নই। আমার সঙ্গে প্যারালাইজড  এক বন্ধু আছে। এবং তারও দেখাশোনা করতে হয় আমাকে।

‘কোন অসুবিধা নেই। আমি ওকে আনার জন্য আর একটা গাধার ব্যবস্থা করছি। আমার বাড়িটা বিশাল। সেখানে নিগ্রো একজন মেয়েমানুষ আছে। সে তাকে মায়ের মত যত্ন করবে। ’

দ্বিতীয় আরেকটা গাধা জোগাড় হতেই আমরা মারিয়াদের বাড়ি উপস্থিত হলাম। এই হৃদয়বান মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টা খুবই বেদনাদায়ক হয়ে দাঁড়ালো। শুধুমাত্র এ প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরই তারা কিছুটা শান্ত হলো যে আমরা এখানে এসে মাঝেমধ্যে ওদেরকে দেখে যাবো আর ওরাও ক্যারাটালে গিয়ে আমাদেরকে দেখে আসতে পারে। ভেনেজুয়েলান গায়ানাবাসীদের আতিথেয়তা কতটা ব্যতিক্রমধর্মী আর আন্তরিক তা সব সময়ে আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারি না। আমার রীতিমত লজ্জাই লাগছিল তাদের ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তটিতে।

দুই ঘণ্টা পর আমরা শার্লটের ভাষায় তার শ্যাঁতো’য় উপস্থিত হলাম। মূল ভূমি জুড়ে হালকা ধরনের বহু ঘর সমৃদ্ধ বড়সর একটি বাড়ি। এখান থেকে ক্যারাটালের ছোট্ট হ্যামলেট গ্রাম, তারপর এল ক্যালাও পর্যন্ত সমগ্র উপত্যকা দৃষ্টিগোচর হয়। এই অদ্ভূত সুন্দর নিষ্কলুষ বনভূমির ডানপাশে মকুপিয়া স্বর্ণখনির অবস্থান। শার্লটের বাড়ির পুরোটাই জঙ্গল থেকে কেটে আনা শক্ত গাছের গুড়িতে তৈরি। তিনটি শোবার ঘর, একটি সুন্দরমত খাওয়ার ঘর আর পাকঘর। ভিতরে দু’টি গোসলখানা আর বাইরের সব্জিবাগানেও রয়েছে একটি ছিমছাম টয়লেট। বাড়িতে সাধারণত আমরা যে সমস্ত শাকসব্জি খাই, তার প্রায় সবগুলোরই উপস্থিতি দেখা গেল শার্লটের সব্জিবাগানে। আরও আছে ভালো জাতের প্রায় পাঁচ শ’রও বেশি মুরগি নিয়ে একটি পোল্ট্রি খামার। আছে কিছু খরগোশ, গায়ানা পিগ, দু’টো ছাগল আর একটি শূকর। সবই শার্লটের বর্তমান সুখ আর সম্পদের সাক্ষ্য দিচ্ছে-- সেই শার্লট, যে একজন প্রাক্তন দাগী আসামী, যে সিন্দুক ভাঙ্গার ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ এবং তার দ্বারা অতীতে এ ধরনের সাড়াজাগানো বেশ কিছু চৌর্য্যবৃত্তির কাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ফ্রান্সে।

‘এবার বল প্যাপি, আমার আস্তানা তোমার পছন্দ হয়েছে? এখানে আমি সাত বছর আছি। যেমন এল ক্যালাও-এ তোমাকে বলেছিলাম- এটা মঁমার্তে আর জেলখানার জঘন্য পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আর মুক্ত, আমার একান্ত আপন ভূবন! কেউ কি কখনো ভাবতে পেরেছিল যে আমার মত চিড়িয়া এরকম একটি শান্ত, সুস্থির জীবনের সুখভোগ করবে? তোমার কি মত, দোস্ত?’

: আমি জানি না, শার্লট। বন্দিত্বের পাঁকচক্র থেকে খুব দেরিতে মুক্ত হয়েছি আমি। তাই এ বিষয়ে পরিষ্কার কোন ধারণা ব্যক্ত করার মত স্বাভাবিকতা এখনো আমার মধ্যে তৈরি হয়নি। এ বিষয়ে আমার অবশ্য কোন দ্বিমত নেই যে তরুণ বয়সে আমরা বল্গাহীন জীবন কাটিয়েছি এবং সে সময়টা কেটেছেও অসাধারণ সব ক্রিয়াকর্মে। এবং তারপর...আমি আসলে  কিছুটা অতীতমুখী হয়ে গেছি তোমার এখানে এসে-- তোমার এই, সব ধরনের ঝঞ্ঝাট থেকে নিরাপদ দূরত্বের শান্ত সুখী জীবন দেখে। বলতেই হয়, সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় তুমি এটা নির্মাণ করেছো। আমি অবশ্যই বুঝতে পারছি যে এর পেছনে পুরোদস্তুর কঠোর পরিশ্রম, অসাধারণ ত্যাগ- সবকিছুই বিনিয়োগ করতে হয়েছে তোমাকে। আর দেখ, আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, আমি এখনো নিজেকে এ পর্যায়ে ভাবতে পারছি না।

ডায়নিং রুমের টেবিল ঘিরে বসে আমরা মার্টিনিক পাঞ্চ পান করছিলাম। ওদিকে বিগ শার্লট বলে চলেছে, হ্যাঁ, প্যাপিলন, আমি দেখতে পারছি তুমি আমাকে দেখে অভিভূত হয়েছো। তুমি ঠিক ধরেছো যে আমি এখন নিজের পরিশ্রমে জীবিকা নির্বাহ করি। দৈনিক আঠারো বলিভারের মজুরি আমার মত লোকের পক্ষে নগণ্যতর ঠিক, কিন্তু এটায় আনন্দ আছে। মুরগিগুলো ডিম ফোটাচ্ছে, খরগোশ বাচ্চা দিচ্ছে, ক্ষেতে টমেটো ফলছে ভালো...। এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো যা আমরা তুচ্ছ নজরে দেখি তা-ই আজ দীর্ঘদিনের চেষ্টায় আমাকে আজ ভালো প্রতিদান দিচ্ছে।
‘এ্যাই, এই হচ্ছে আমার কৃষ্ণকলি। কনচিটা! আমার দু’জন বন্ধু এসেছে। একজন অসুস্থ; তোমাকে তার সেবা-যত্ন করতে হবে। আর এ হচ্ছে এনরিক বা প্যাপিলন। সে আমার ফ্রান্সের বন্ধু, বহু পুরনো দোস্তি।

‘আমাদের ঘরে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি। ’ কালো মেয়েটি বললো। ‘শার্লট তুমি ভেবোনা, তোমার বন্ধুদের যথোপযুক্ত যত্ন নেওয়া হবে। আমি নিজে তাদের ঘরে গিয়ে তদারকি করবো।

এবার শার্লট আমাকে তার জেল মুক্তির কাহিনী শোনালো-- খুব সহজ পন্থায়। কারাজীবনের প্রথম থেকেই তাকে সেইন্ট-লরেন্ট-ডু-ম্যারোনিতে রাখা হয়। ছয় মাস পর সাইমন নামের এক কর্সিকান ও বিচারাধীন কয়েদীর সঙ্গে সেখান থেকে পালায় সে। ‘আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে একনায়ক গোমেজের মৃত্যুর কয়েকমাস পরই ভেনেজুয়েলায় পৌঁছলাম। এই মুক্তহস্ত, উদারহৃদয় লোকগুলো নিজেদের মত নতুন জীবন গড়ে তুলতে আমাদের সর্বাত্মক সাহায্য করেছে। ধীরে ধীরে এই সাধারণ জীবনটা আমি পছন্দ করতে শুরু করলাম। বুঝতে পারছো তো কি বলছি? সন্তান প্রসবের সময় আমার একজন স্ত্রী মারা গেছে নবজাতকসহ। তারপর এই কালো মেয়েটা, যাকে তুমি এইমাত্র দেখলে, কনচিটা ওর নাম, সে তার সত্যিকারের ভালোবাসা আর অনুভূতি দিয়ে আমাকে বরণ করে নেয় এবং সে আমাকে সুখী করতে পেরেছে। কিন্তু প্যাপি, তোমার কি অবস্থা? তুমি নিশ্চিতই একটা কঠিনতর দীর্ঘ সময় পার করে এসেছো। তের বছর দীর্ঘ যন্ত্রণার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছো। বল দেখি কাহিনীটা। ’

আমি টানা দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করে বিগত বছরগুলোতে আমার অমানবিকভাবে নিগৃহীত হবার কাহিনী-সংক্ষেপ বর্ণনা করলাম।

এটা ছিল খুবই মনোহর একটা বিকেল। আমাদের উভয়ের জন্যই পুরনো স্মৃতিচারণের পক্ষে এ বিকেলটা ছিল স্বর্ণালী, অত্যন্ত উপযোগী। স্মৃতি রোমন্থনটা একদিকে কষ্টকর ছিল, মঁমার্তে সম্পর্কে সেখানে আমরা একটা শব্দও তুলিনি, অপরাধ জগৎ সম্পর্কেও কোন কথা নয়, নিজেদের জীবনের ব্যর্থতা বা অক্ষম ক্রিয়াকাণ্ডের কোন স্মরণ ছিল না,যন্ত্রণাকর কোন স্মৃতিও তেমন একটা আসেনি। মনে হচ্ছিল আমাদের জন্য নতুন করে জীবনের ওইসব ঘটনাগুলো আবার ঘটছে- যখন আমারা লা মার্টিনিয়েরে অবতরণ করি, আমি ১৯৩৩-এ আর শার্লট ১৯৩৫-এ।

চমৎকার সালাদ, ছাগ-দুধের পনির, একটি গ্রিলড মুরগি আর সুস্বাদু একটি আম, উন্নতমানের চিয়ান্তি মদে ভরপুর-- সবকিছু টেবিলে সাজাচ্ছিল শ্রীমতি কনচিটা। বোঝা যাচ্ছিল শার্লট আমাকে তার গৃহে যথোপযুক্তভাবে অভ্যর্থনা জানাতে পেরেছে এবং এজন্য সে সন্তুষ্ট। এবার গ্রামের বাজারে গিয়ে একদান মদ্যপানের প্রস্তাব দিল শার্লট। আমি বললাম, পরিবেশটা এখানে এতটাই মধুর লাগছে যে এটা ছেড়ে বাইরে বের হতে উৎসাহ বোধ করছিনা মোটেই।

‘ধন্যবাদ, বন্ধু। ’ আমার কর্সিকান স্যাঙ্গাৎ বলল। তার কথায় প্রায়ই প্যারিসীয় ধাঁচ ফুটে উঠছে।
‘এক্কেবারে হক কথা বলেছো, এখানেই আমরা আরামে আছি। কনচিটা, তুমি এনরিকের জন্য একজন বান্ধবী জোগাড় করবে। ’

‘ঠিক আছে। এনরিক, আমি আমারচে’ সুন্দরী এক তরুণীর সঙ্গে তোমার মোলাকাত করিয়ে দেব। ’
‘কিন্তু তুমিই তাদের মধ্যে সবচে সুন্দরী’ শার্লট যোগ করলো।  

‘হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু ভায়া, আমি যে একটা কাল্লু।

: তুমি যে এত সুন্দরী এটাই তার প্রধান কারণ, পুতলী সোনা আমার। কারণ তুমি বিশুদ্ধ স্বভাবা নারী একজন। ’

ভালোবাসা আর আনন্দে কনচিটার বড় বড় চোখ জোড়া চিক চিক করে উঠলো।   স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, যে ওর মনমন্দিরে দেবতার আসনে আবাস গেড়েছে ব্যাটা বিগ শার্লট।
ছিমছাম বড়সর এক বিছানায় শুয়ে শার্লটের রেডিওতে লন্ডন থেকে প্রচারিত বিবিসির খবর শুনছিলাম। কিন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে এই বায়বীয় যোগাযোগ আমাকে সহসাই কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দিল-- এইসব খবরে এখন আর আমার কিছু আসে যায় না। আমি নব ঘুড়িয়ে দিলাম। নতুন স্টেশনে ক্যারিবিয়ান সঙ্গীত বেজে উঠলো। ক্যারাকাসের গান হচ্ছে। কিন্তু নগর জীবনের এই সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গ যাতে বড় শহরে জীবনাচারের রং লেগে ছিল- আমার ভাল লাগলোনা। অন্তত আজকের বিকেলের জন্যে তো নয়ই। আমি তাড়াতাড়ি রেডিও বন্ধ করে দিয়ে বিগত কয়েক ঘণ্টার ঘটনাবলী নিয়ে ভাবতে বসলাম।

কোন বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম? আমরা দু’জনে প্যারিসে যে জীবন কাটিয়েছি তা নিয়ে আজ কোন আলোচনা করিনি, সেটাই কি ভাবনার বিষয়? না। অথবা আমাদের জগতের সেইসব ভাগ্যবানদের কথা যাদেরকে এই জীবন যন্ত্রণার ঘানি টানতে হয়নি? আবারো ‘না’। তাহলে কি বলতে হয়, আমাদের মত কঠিন পাত্রদের জন্য জেল জীবনের আগের ঘটনাগুলো ধর্তব্যের কোন বিষয়ই না! আমাদের পরবর্তী জীবনে ওসব ঘটনার কোন প্রভাবই কি পড়েনি?

বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি, এপাশ-ওপাশ করলাম। বেশ গরম লাগছিল তাই বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলাম না। ঘর ছেড়ে বাগানে এলাম। বড় একটা পাথরের ওপর বসলাম, যেখান থেকে উপত্যকা আর স্বর্ণখনির পুরোটাই দেখা যাচ্ছিল। সবকিছুই আমার চোখে জ্বলজ্বল করছিল তখন। মালবোঝাই আর খালি ট্রাকগুলো সুশৃঙ্খলভাবে যাওয়া-আসা করছে।

স্বর্নের খনির গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসছে এই পদার্থ। পর্যাপ্ত পরিমাণে এই ধাতব বস্তু কিংবা এর বিনিময় মূল্য অর্থাৎ টাকা যদি তোমার কাছে থাকে তাহলে পার্থিব যে কোন সুখ কিনে নিতে পারবে তুমি। পৃথিবীর প্রধান চালিকাশক্তি এই স্বর্ণ, অথচ খনিতে কত স্বল্প ব্যয়ে এটা আহরিত হচ্ছে। শ্রমিকরা এখানে খুবই কম মজুরীতে চিনির বলদের মত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে মুখ বুজে। এটা কি এই কারণে যে, ভাল পন্থায় বাঁচার জন্যই এ ব্যবস্থা! আর ওদিকে শার্লট, ওর স্বাভাবিক জীবনাচার, স্বাধীনতা হারিয়েছে, কারণ সে প্রচুর পরিমাণে এই স্বর্ণের মালিক হতে চেয়েছিল। অথচ সেই শার্লটই এখানে এই বিপুল সম্পদের ধারে কাছে থেকেও বাড়ির কাছের এ আরশীনগর সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি আমার কাছে। মনে হচ্ছে এ সম্পর্কে ও পুরোপুরি নিরুৎসাহী। এই খনিতে স্বর্ণের পরিমাণ কত-- এই মামুলী তথ্যটাও তো সে আমাকে দেয়নি আলাপচারিতার সময়। এখানে এসে বর্তমানে তার জীবনাচারের মূল অনুসঙ্গ মনে হচ্ছে ওই কালো মেয়েটি, এই বাড়িটি, পোষা জীব-জন্তুগুলো আর তার সব্জি বাগানটি। এমনকি সে টাকা-পয়সা সংক্রান্ত কোন প্রসঙ্গই তোলেনি আমার কাছে। নাহ্! শার্লট শালা দার্শনিক হয়ে গেছে। আসলেই আমি ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম বিষয়গুলো ভেবে।

*ব্যানকো [পর্ব-১]
[চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৬৫০, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।