ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

যতো ফুল ততো ভুল | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৭
যতো ফুল ততো ভুল | তানিয়া চক্রবর্তী ধারাবহিক গদ্য

ফুলের মতো মোহময় কিছু বোধহয় আর সৃষ্টি হয়নি পৃথিবীতে। এতো বৈচিত্র্য, এতো রঙ, এতো আকার ভাবা যায় না। স্থাপত্য, কবিতা, গান, ছবিতে— কোথায় নেই ফুলের বিস্তার! ফুল নিয়ে মিথ, ফুল নিয়ে ইতিহাস বলে শেষ করা যায় না। আসলে ফুল একটা দ্বন্দ্বের অবসান। এই ঈদ এই আসন্ন মহালয়া, এর সন্ধিক্ষণে ফুলই বোধহয় সবচেয়ে ইতিবাচক উপহার হতে পারে যে কারোর জন্য। এবং খেয়াল করে দেখবেন, ধনীর থেকে ধনীতম ব্যক্তিও এই ফুলের সান্নিধ্য তাদের আড়ম্বরের উপাদান থেকে বাদ দিতে পারেন না।

আমার তো মনে হয় ফুল দিয়েই একমাত্র সাম্প্রদায়িকতাতেও ইতি টানা যায়। গাছ জীব, গাছের প্রাণ আছে, আমরা সব জানি কিন্তু ওদের স্থিরতা আমাদের মাঝে মাঝে এটা ভুলিয়ে দেয়।

বলা হয়, মানুষের মতো গাছেরও অনুভূতি আছে। যে মুহূর্তে তাকে কাটা হয় সে তীব্র ভীতসন্ত্রস্ত বোধ করে।

ধারাবহিক গদ্য
১৯৭০ অক্টোবর, রাশিয়া একটি পরীক্ষামূলক প্রতিবেদন প্রকাশে দাবি করে যে, গাছ শুধু কাঁদেই না চিৎকার করে। তা সূক্ষ্ম বলে তারা তা রেজিস্টার করার চেষ্টা করেছেন যন্ত্রের মাধ্যমে। ফুলের গল্প শুনলে জীবনকেও রূপকথা ভাবতে ভালো লাগে। বলা হয় “পপি ফুল”র নামকরণ হয় গ্রিক দেবতা সোমনাস’র নাম অনুযায়ী। পপি ফুল থেকে যেমন ওষুধ প্রস্তুত করা সম্ভব তেমন তীব্র মাদক আফিম, মরফিন, হেরোইনও প্রস্তুত হয়। তাই বলা হয় পপি ক্ষেতের হাওয়া প্রাণীদের ঘুমও পাড়িয়ে দিতে পারে। এ ব্যাপারে মহুয়া ফুলও কম যায়নি। গাছে এই ফুল বেশীক্ষণ থাকে না, রাতে ফুটে রাতেই খসে পড়ে। আদিবাসীরা সাগ্রহে এর সংগ্রহ করেন। মহুয়া গাছের ডাল থেকে বানানো লাঠি সদ্য বিবাহের একটা বিশেষ উপকরণ। শবদেহের কর্মেও এর ব্যবহার আছে। এই ফুলের থেকে ওষুধ প্রস্তুত হয়। তাছাড়া ভাজা বা সেদ্ধ হিসেবেও খাওয়া হয়। এই ফলের রস তো সুখকর নেশার এক আবেগময় উপাদান। “মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো” এই গান পাড়ার মাইকে বাজা অবস্থায় শোনেনি এমন লোক কম আছে। আর গোলাপ তার কথা আর কী বা বলি— অর্থনৈতিকভাবে একজন দরিদ্র প্রেমিকেরও প্রেমিকাকে মুগ্ধ করার চাবিকাঠি গোলাপ। শুধু আবেগ দিয়েই গোলাপ সমস্যা সারায় তা কিন্তু নয়, বাস্তবিক গোলাপের ভিটামিন হার্টের অসুখ আর ক্যানসার সারাতে সক্ষম। আর কিছু জায়গায় তো জুঁই চা ও স্যালাডের সঙ্গেও খাওয়া হয়। আরও কতো ফুল যে কতো কাজে ব্যবহৃত, তার তো ইয়ত্তা নেই।
সংগুহীত ছবিনিজের সম্পর্কে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “আমি কবি, তাই আঘাতও করি ফুল দিয়ে”। অ্যানিমোন ফুল নিয়ে গ্রিক মাইথোলজিতে দারুণ গল্প আছে। এর আরেক নাম “wind flower”। অ্যাডোনিস এর মতো সুপুরুষ যুবার মৃত্যুর পর তার রক্তে নাকি এই ফুলের জন্ম হয়। পরবর্তীতে যীশুর রক্তকেও এই ফুল দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ক্রুসিফিকেশনের ছবিতেও এই ফুল দেখা যায়। যে ফুলেরা মাইথোলজিজুড়ে- সাগরকুসুম, কারনেশন, পপি, গোলাপ, পদ্ম, সূর্যমুখী আরও কতো। গ্রিসে আলাদাভাবে ফুলেরও দেবী ছিলেন। লিলিফুলকে গ্রিকরা তাদের দেবতা হেরা আর রোমানরা তাদের দেবতা জুনোর চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়াও লিলিকে পবিত্র মেরির চিহ্ন হিসেবে জানা হয়ে থাকে। আর পদ্ম নিয়ে তো বহু আশ্চর্য মিথ আছে। ইজিপ্টে ইজিজ দেবতার জন্ম মনে করা হয় পদ্ম ফুল থেকে। এছাড়াও নারীর যৌনক্ষমতা, তার প্রসব সব এই পদ্ম দিয়েই ভাবা হয়ে থাকে।  

মিশরে মমির দেহের হাতে একটি পদ্ম ফুল দেওয়া হতো আর এই ভাবনা পোষণ করা হতো যে, সে তার ইতিবাচক জীবনে পরের জন্মে প্রবেশ করবে। হিন্দুধর্মে ব্রহ্মাকে পদ্মজাত বলা হয়ে থাকে। গ্রিক মিথে যুবক নার্সিসাসের গল্প আমরা সবাই জানি। বলা হয়, তার মৃত্যুর পর জলে নিম্ফ ফুলের সৃস্টি হয় তাই পরবর্তীতে নার্সিসাস নাম নেয়, যা স্বার্থপরতা ও আত্মমোহমুগ্ধ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বলা হয় গোলাপেরও নাকি কাঁটা ছিলো না, আদম আর ইভের পাপের পর গোলাপে কাঁটা সৃস্টি হয়। এসব বুঝেই হয়তো কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, “যত ফুল তত ভুল কণ্টক জাগে/মাটির পৃথিবী তাই এত ভাল লাগে”।

অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, “A flower blossoms for its own way”।

মাদার টেরেসা ফুল সম্পর্কে বলেছেন, “we need to find God and he cannot be found in noise and restlessness. God is the friend of silence. See how nature— trees, flowers, grass ---grows in silence: see the stars, the moon and the sun, how they move in silence to able to touch souls”।
 
ভিক্টর হুগো বলেছেন, “A garden is a walk in and immensity to dream in— what more could he ask? A few flowers at his feet and above him the stars”।
 
অড্রে হেপবার্ন বলেছেন, “I’m an introvert… I love being by myself, love being outdoors, love taking a long walk with my dogs and looking at the trees, flowers, the sky”
 
ফ্রয়েড বলেছেন, “Flower are restful to look at. They have neither emotions nor conflicts”।
 
আমাদের আসন্ন  শরৎ -এর বিষণ্ন ফুল শিউলি, গায়ে শিশির মেখে তিনি হাজির হন। লাতিন ভাষায় এর নামের অর্থ হলো বিষণ্ন ফুলগাছ। তাকে আরও বলা হয় ‘দুঃখের বৃক্ষ (tree of sorrow)’ কারণ, দিনের আলোতে তারা উজ্জ্বলতা হারায়। শিউলির আরেক নাম পারিজাত/রাগাপুষ্পি। ওড়িয়া ভাষায় গঙ্গা শিউলি নামে ডাকা হয়। শিউলি ফুলের বৃন্ত দিয়ে দারুণ হলুদ রঙ প্রস্তুত হয়। হিন্দু পৌরাণিক গল্পে বলা হয়, ইন্দ্রের অভিশাপেই শিউলি গাছে বীজ থাকলেও ফল আসে না। পারিজাতিকা নামে এক রাজকন্যা সূর্যের প্রেমে তাকে কামনা করেন। কিন্তু না পেয়ে আত্মহত্যা করে সেখানেই তার ভস্ম থেকে পারিজাতবৃক্ষ বা শিউলি জন্মায়। তাই এই বিরহের চিহ্ন হিসেবে সূর্যের আগমন মাত্রই সে ঝরে পড়ে।

ফুলের নির্যাস দিয়ে সুগন্ধী তথা পারফিউম বানানো একটি প্রাচীন রীতি— ল্যাভেন্ডার, জ্যাসমিন, ইউক্যালিপটাস, নার্সিসাস ফুল থেকে ৪৫০ খ্রি. নাগাদ পারফিউমের আবির্ভাব হয়। সেসময় বিখ্যাত  চিকিৎসক ইবনে গোলাপের নির্যাস থেকে এটি বানানোর প্রথা নিয়ে আসেন।

সংগুহীত ছবিফুলকে প্রসাধনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে অভিনব ব্যবহার করতে জানে দক্ষিণ ইথিওপিয়া অঞ্চলের সুরমা ও মুরসি প্রজাতির মানুষেরা। কলাগাছের শুকনোপাতা গলার মাফলার, শুকনো ঘাস মাথায়, ফুলের মুকুট আর কখনও-সখনও একটি ফুল মুখে। পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ার বর্ডারে বহু আদিবাসী  বাস করেন তারা তাদের দর্শন ও রীতি বিভিন্ন হলেও তাদের মৌলিক দিক হলো তারা ফুলের সাজসজ্জায় ঘনীভূত। ফুল, পাতা, প্রাণীর খোল, শিং এসব দিয়ে তারা দেহকে অনন্য ক্যানভাসে বদলে দেয়। আগ্নেয়গিরির  পাথর ও মৌল খনিজ তারা আঁকায় ব্যবহার করে।
 
এই যে আমরা পড়ছি আর ভাবছি যে গ্রাম্য, বন্য এইসব জায়গায় হয়তো ফুলের প্রসাধনী ব্যবহার বেশি একেবারেই কিন্তু তা নয়। বড় বড় ফ্যাশন উইকে ফুল একটা মুখ্য উপাদান হিসেবে থেকে অসাধারাণ সব স্টাইল তৈরি করে এবং সেগুলো যথেষ্ট পরীক্ষণীয় ভাবে করেন শিক্ষাপ্রাপ্ত ফ্যাশন ডিজাইনাররা। আর ফুলের সাধারণ ব্যবহার যে মানুষ কতো প্রকারে করে তা তো বলাই বাহুল্য। ফুল থেকে প্রস্তুত রঙ দিয়ে হোলি বা দোলে বিশুদ্ধ জিনিস বানানোর প্রয়াস থাকে। যেমন লাল রঙ তৈরিতে লাগে পলাশ, জবা, গোলাপ; কমলা তৈরিতে লাগে কমলা রঙের গাঁদাফুল; হলুদের হলুদ গাঁদা; সবুজ রঙ তৈরিতে গুলমোহর গাছ। এসব রঙে কোনো বিষাক্ত কেমিক্যাল তো দূরে থাক এমনকি ত্বকের উপকারী উপাদানও কখনও-সখনও মজুত থাকে।
 
এই সমস্তই তো গেলো ফুলের মোহময়ী সুখদায়ী গল্প। কিন্তু ফুলকে মানুষ ভয় পায় এমনটাও কী ভাবা যায়! বলা হয় “BLACKTHORN” নামে একটি ফুল, যে গাছকে বলা হতো “witch’s tree”। ১৯৪০ সাল নাগাদ রটনা রটেছিল, কোনো ব্যক্তির কাছে এটি থাকা মানে তিনি ডাইনিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। আর বলা হতো, গর্ভবতী মহিলার কাছে এই ফুল রাখলে গর্ভপাত হয়! ফুলের নাম “ARUM LILIES” যার আরেক নাম “DEATH FLOWER” বা মৃত্যুর ফুল। ফুলের নাম “COW PARSLEY” যার আরেক নাম ভয়ঙ্কর “BREAKING YOUR MOTHER’S HEART’’ বা মায়ের হৃদয় ভেঙে দেওয়া। ফুলের নাম ব্যাট ফ্লাওয়ার বা ডেভিল’স ফ্লাওয়ার, এই ভুতুড়ে ফুল পাওয়া যায় চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড— এদের চূড়ান্ত অশুভ মনে করা হয়। অথচ ভাবুন, এরাও সেই ফুলই তো।
 
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল বলে আবিষ্কৃত  “RAFFLESIA ARNOLDII” আসলে একটি মৃত ফুল, এটি ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় ফুল। ১৮১৮ সালে সুমাত্রার জঙ্গলে এটি আবিষ্কার করা হয়। ফুলটি নিজেই একটি গাছ। ফুলের ওজন ১১ কেজি। গোলকের ব্যাস তিন ফুট। আর সবচেয়ে ছোট ফুল হলো সুজিপানা, আদতে মূলহীন অঙ্গজ জননকারী গাছ।
 
মাংসাশী যে সমস্ত ফুলগাছ আছে স্বাভাবিকভাবেই তারা ফাঁদ প্রস্তুতকারক। কী অদ্ভুত না, ফুল সেও কিনা মাংসাশী। এর থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীর সবকিছুই শুধু নির্মল, ভালো, মনের মতো হয় না। সমস্ত ক্ষেত্রের দু’টো দিক থাকে। সাধারণত এই মাংসাশী গাছ অসাধারণ অনুকৃতি করে রূপধারণ করে নয়তো রূপের আকর্ষণে পতঙ্গদের ফাঁদে ফেলে। মনুষ্যজীবনেও কিন্তু এরকম ঘটনা ঘটে। এর পরেও কী গাছকে শুধু গাছ ভেবে বসে থাকা যায়। গাছের জননের ভেদগুলোতেও মানুষের মতো সাদৃশ্য আছে।

সংগুহীত ছবি
কয়েকটি অদ্ভুত মাংসাশী গাছ যেমন “cephalotus”,  এর দেহে খাদ্য ব্যবহারে একটা নিদারুণ বিভাজন আছে— ১. আকর্ষণের জায়গা, ২. পিছলানোর জায়গা, ৩. হজম করার জায়গা। এর থেকেও বোঝা যায়, কতোটা কর্মকুশল এর দেহের অংশভাগ; দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকাতে মূলত এর বিস্তার দেখা যায়। আর একটি ফুলগাছ “nepenthes”, সমুদ্র-পাহাড়ে এর বসতি, দেহাংশের উপরিতল রসালো অংশে ভরপুর যার ফলে কীট একবার কাছে এলেই “ফাঁদে পড়িয়া বগা কান্দে রে অবস্থা”। “DIONAEA” যার অন্য নাম “ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ” বিশ্বের অন্যতম সুন্দর ফুল। শিকারকে টুকরো টুকরো করে রসেবসে ১০ দিন ধরে খান! আসলে এর খাবার হজম করতে ১০ দিন লাগে।
 
সে যাই হোক ফুলের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার থেকে একটু আধটু ফুলের গায়ে মূর্ছা যাওয়া ভালো! আসলে সত্যি এমন অসংবেদী মন পাওয়া মুশকিল যে ফুলের গন্ধ, রূপ, তার শান্ত আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারে। ফুল বোধহয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সবচেয়ে জোরালো ইতিবাচক ইঙ্গিত। সেই ফুল নিয়েও প্রতিকূল ভাবনা আছে এই বিশ্বে ভাবতে না পারলেও এটা সত্যি। তবে সুন্দরের ক্ষমতা ময়লার চেয়ে অনেক বেশি কারণ, সে তীক্ষ্ণ তাই ফুলের ফুলেল সমারোহ আমরা নিশ্চিত এড়াতে পারব না। মৃত্যুর মুহূর্তে তাই বোধহয় ফুল দিয়ে আমাদের বোঝানো হয়, আবার ফিরে এসো এই বাহারের ভূমিতে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।