ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাবার অভিধান

মেহেদী উল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১১
বাবার অভিধান

উপুড় করা ভাঙাকুলা দুইবার বাজল নারকেল গাছটার গোড়ায়। শব্দ হলো ঢব ঢব।

আজ শেষ শব্দটি হলো না।
   দীর্ঘ নয় বছরের নিয়ম ভেঙেছে। প্রথম দিককার শব্দ ছিল ঢবরিনঝিন ঢবরিনঝিন ঢবরিনঝিন। রমণীর কাঁচা হাতের কাঁচের চুড়ি আর কুলা গাছটায় একসঙ্গে বাজতো; বাড়ির ভেতর থেকে ডাক আসতো, কর্কশ ভোঁতা গলায়- ‘ও বৌ, হইছে নি তুমার। ছাই ফেলতে এতক্ষণ লাগে নি। ’ তবুও গাছটার নিচে ছাইয়ের ঝাড় দিয়ে অন্তত তিনবার কুলাটাকে গোড়ায় পিটিয়ে নিতো রোকেয়া।    
   আজ এক্ষণে এমন কেউ ডাকলো না। নতুন বউ পুরাতন হয়ে গেছে, বাড়ির কি মনের অন্তর-বাহিরে কত কী ঘটে গেছে, এতদিন পরই বা কী, যা হবার ছিল, ভাগ্যের অভিধানে লেখা ছিল বিবর্ধিত সত্য করে তা তো ঘটে যাচ্ছে, ঘটে যাবে নিশ্চিত। ভেতর থেকেই কে যেন টেনে ধরল হাত। ছাই ফেলা হল; কিন্তু কুলা--  গাছে তিনবার বাজলো না। দুই বারের পর নিজের ভেতর থেকেই কে যেন ডাক দিয়ে উঠলো- ‘ও পোড়া কপাইল্লা। ভাইগ্যে তর ছাই পড়ছে। কুলার ছাই ঝাইড়ে কী হবে?’

   শাড়ির আঁচল চোখে টানে রোকেয়া, জল গড়িয়ে পড়ে শিকড়ে। শিকড়েরও ঠিকানা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এক একটা শিকড় কই কই চলে গেছে! উৎস আছে, শেষের দেখা নেই। গাছটার পূবে রসুই ঘর। একটু আগে চুলা থেকে ছাই উঠানোর সময় দেখেছে, এপাশ ওপাশ হয়ে চলে গেছে শিকড়। শিকড়ের কী শক্তি, প্রায় প্রায় গায়ে আগুন লাগায়, ধোঁয়াও মনে হয় লাগায়, তবু তার কত তর!  নারিকেল মালার সঙ্গে কোড়াত কোড়াত শব্দ হয়ে ছিঁড়ে গেছে কয়েকটা। কিন্তু রোকেয়ার কোনো কাজ আমরা দেখাতে চাইলেও দেখাতে পারবো না।
 
 ছাইয়ের ঢিবির ওপর ভাঙাকুলাটা রেখে দেয় এবার। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল মাটির গায়ে গড়াগড়ি খায়। অতো বিবর্ণ কিংবা বর্ণিল মার্বেল নয়, তবু থাক; রক্ত মার্বেলের মতো জমাট গোল হয়ে চামড়ার ভেতর কোন পথে যেন গড়াগড়ি খায়, মাটি টের পায় তা বুঝি। শিকড় এসে ঠেকলে পা হয়তো সরিয়ে নেয় রোকেয়া। হঠাৎ জোর মোচড়ে ছিঁড়ে দু’ভাগ হয়ে যায় শিকড়। শিকড় ছেঁড়ার শব্দের মত করে ওঠে ভেতরে। সেখানটায়, যার উপরে মরা লাল রঙের ব্লাউজ সাঁটা। শাড়ির বড়সড় আঁচল থাকতে, তা তো টেনে নিয়ে মধ্যবয়সী এই মহিলা ডান বগলে চেপে রেখেছে , ভেতরে আর কি কি অন্তর্বাস আছে চোখে পড়ে না।

ঝোঁপের পাশে মুরগিকে ছুঁতে না পেরে গলা টান টান, সামান্য বাঁকিয়ে মোরগ ডেকে যাচ্ছে - কককক...। রোকেয়া হুশ হুশ শব্দে তাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে এ শব্দও মিলিয়ে যায়। কিন্তু মোরগের বৃথা আস্ফালন তাকে রেহাই দেয় না। কিছু যেন খুঁজে পায়। এর সঙ্গে মন মিলিয়ে রোকেয়া এবার বাতাসে মিশিয়ে দেয় নিশ্বাস। উত্তরা বাতাসে এই নিরাশার মগ্নতা আকুলতার বিন্দু বিন্দু শিহরণ হয়ে পৌঁছে যায় দক্ষিণে। জমিতে কাজ করে যাচ্ছিল রোকেয়ার স্বামী ফিরোজ তালুকদার। সঙ্গে একই কায়দায় হাত মিলিয়ে যাচ্ছে ছেলে হাবিব। হাঁটু পানিতে কচুরিপানা সরিয়ে সরিয়ে বাপ-- বেটায় কত কী করছে। রোকেয়া তাদের দেখে আর ভাবে- কত্ত বড় আকাশ। ঠিকানাবিহীন মেঘ ডানা ভেঙে ভেঙে উরগ দেহ নিয়ে চলে স্বচ্ছ রঙ উবে দিয়ে। তারই ছাপ পড়েছে বাপ-বেটার পায়ের তলায়। মনে হচ্ছে আকাশটা আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নিচ্ছে। শুধু বাপ-বেটা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছে সেখানে নেই, কিছুই নেই সেখানে। না পানি, না কচুরিপানা, না হাঁটু আর জলের ঘোলানী। শুধুই চারটি আদিম পা। নুয়ে পড়া পাট গাছগুলো ফিরোজের হাতে পড়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পলকহীন তাকিয়ে থাকে রোকেয়া। এক প্যাঁচে পরা শাড়িটা কুচির অভাবে খুলে খুলে যায়। শরীরের কোথায় কোথায় পাড়ের দেমাক মুখ দেখিয়ে ভেংচি কেটে যাচ্ছে?

   শুষ্ক চাহনিতে আঙুলের ভোতা আহ্বানে স্বামী সন্তানকে উঠে আসতে বলে রোকেয়াÑ ছয় গণ্ডা জমি, মাথার উপর বিশাল আকাশ আর মাঝখানে তারা তিনটা জীব। ঘরে ফেরে রোকেয়া। একটু পরেই উঠে আসে বাপ-বেটা। ফিরোজ গামছা দিয়ে শুষে নেয় হাঁটুর পানি। হাবিব ডেকে ওঠে-- ‘মা আইছি। দুপুরে খাইয়া আবার নামমু। আমার খালি জমিনের পানিতে নামতে মন চায়। ’ ছেলেকে বুঝ দেয় রোকেয়া-‘ ঠিক আছে। তয় খায়া ল। তর বাবা কই। হেরে ডাক। আইজ রাইতে কী মাতবর আইবো। ’ স্ত্রীকে সাড়া দেয় স্বামী-‘ হু, মনে আছে। আব্বা জানে, হেয় আইবো। ’ এবার রোকেয়া চোয়াল ঝাকুনি দেয়-- ‘ বাড়িতো দুই দিন বাদেই ছাইড়া দিমু। একদিনের ঠেস নাই। তার উপর কথার চোট। ’
 
   সন্ধ্যায় কুপি জ্বালিয়ে আসর বসায় মা-ছেলে। পাশের কামরায় শুয়ে থাকে ফিরোজ, সারা দিনের পরিশ্রমটা সন্ধ্যা এলেই শিকল পরায়। শুধু শরীরটাকে মেলে ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দেহ আর মনে গোলমাল হলে ঘুম ছোটে সোনার হরিণের পিছু পিছু। মা-ছেলে কী সব আজগুবি বকছে। এমন এলোমেলো কথার আসর শ্রোতাহীন ভালো জমে। হঠাৎ কথায় ভান আনে হাবিব -‘ মা কাইলকাও ইশকুলে যামু না। পানিতে নামমু। ’
- তর স্যারেরা কিছু কইবো না?
- ইশকুল কামাই দিলে রহিম স্যার কাইট্টা চেঙ্গি দেয়। কিন্তু স্যারে জানে, আমরা আর এইহানে থাহুম না। ’
   মা-ছেলের গল্প ফুরোয় না। খানিক বাদে বাদে নড়েচড়ে শোয় ফিরোজ। চৌকির খটমট শব্দ শোনা যায়। রাত বেশি নয়, তবু মনে হয় কত রাত। বাড়ির পূবের গোরস্তান থেকে শেয়ালের ডাক আসে সময়ে সময়ে। ভাঙা চেয়ারে রাখা কুপিটায় তেল আছে কি পুরিয়েছে খেয়াল নেই কারোর। বাইরের আন্ধারের ভেতর থেকে ডাক আসে, স্পষ্টই শোনে রোকেয়া, কানে নয়, মনে। হাবিব আবার বলে- ‘মা, আমাগো ঘরডা এহন অনেক সোন্দর হইছে। গত কাইলকা ইশকুলের সামনের রাস্তায় আইসা দেহি, নতুন টিন সুরজর আলোয় চকমক চকমক করতাছে। আলোর ঝলক মারা দূর থেইকা দেইখা হানিফরে কইছি, দেখ ঐডা আমাগো ঘর। ’
    দু’কামরার ঘরে এবার নিরবতা নামে। হাবিব ঘুমিয়ে যায়। পাশের কামরাটাও চুপচাপ। শুধু রোকেয়া একা-একা জেগে বসে আছে। আলোক শিখা হেলে দুলে নেচে চলে। মনে হয় আলো ছায়ায় ঘরটা সবাক। যে বোবা-- তার হৃদয়ের অপ্রকাশিত দুঃখ বেদনার মতোই যে দৃশ্যটা।
    ও কামরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় রোকেয়া, ‘মাতবর তো আইলো না। রাইতও মেলা হইছে। ’
 উত্তর না পেয়ে ঠোঁটের পাতে ঝাল তোলে রোকেয়া,‘মানুষটা কথা কয় না কেন? হগল চিন্তা খালি  আমার। ঘর বাড়ার কী অইলো?’

    যত কাছ থেকে উত্তরটা শুনতে চেয়েছিল রোকেয়া, পায়নি। আরেকটু দূর থেকে  ভেসে এল শব্দটা। কান বসানোর আগেই আদেশ এল-- ‘ঘর পাওন-টাওন বুঝি না। বাড়ি দ্ইু এক দিনের মধ্যে ছাড়বি। তোগরে আরনা...। ছয় গণ্ডা জমি তো দিছি। বাড়িঘর কইরা লইতে পারছ না। মাগির ঘরের মাগির পরের বাড়ি থাকার আউস কত?’  
   তবে কী আজ আবার! আপনারা জানেন, সাক্ষী থাকুক আন্ধারের গহীন ডাক, গোরের শেয়াল, কুপির আলো-ছায়া, পৃথিবীর শাশ্বত ডাইনীর নাম বিমাতা। রোকেয়া কিছু বলার আগেই হেঁকে ওঠে ফিরোজ - ‘চুরি কইরা বাড়ি লেখাইয়া লইয়া মহারানীর দেমাক দ্যাহো। ওই খানকির পোলা বুড়া বয়সে আবার সাঙ্গা মারছে। ভাইসা আইছি নাকি। ’
   চুপ থাকে না রোকেয়াও। নিজে আর স্বামী-সন্তান মিলে এরাও আরেক দল শক্তি। নয় বছর ধরে সইছে জ্বালা। সে  জ্বালা এখন আগুনতর খাঁটি, ‘ দজ্জাল মহিলা। আমরা কী কইছি থাকমু। এই মাসেই তো ছাইড়া দিমু বাড়ি। তহন দুই রান চেগাইয়া শুইয়া থাহিস। ’
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/babar aovidhan56-Pic20110926192955.jpg
এমন কথার পর যে কোনো জাতীয় ঝগড়া কোথায় গড়াতে পারে তা বলতে হয় না। শুধু উত্তর- প্রতিউত্তরে রাত বাড়ে। চাঁদটাও যেন স্থির হয়ে শুয়ে থাকে বাঁশ বাগানের মাথায়। এর আর গ্রামের জন্য নতুন কথা কী। তবুও এ বাড়ির মাথার উপরের চাঁদটা বড় বেশি গ্রাম্য। দু’একটা পাখিও হয়তো ডাকে। কিন্তু এ অশান্তির জগতে বসবাস কিন্তু মন কি আর চাঁদ চায়, তারা চায়, আন্ধারে লুকিয়ে থাকা গুমোট ঝোঁপের বিজাতীয় অচেনা কোন ফুল-তৃণের সঙ্গ চায়, নাকি আর পাখির ডাক। যদি সেনদের অত্যাচারে ‘সাহিত্যের অন্ধকার’ সত্যি হয় তবে কি তাতে কোনো দিন রাতে কি অরাতে বৈষ্ণব কীত্তনের সুর ওঠেনি পাড়ায়-পাড়ায়? কেউ কি যায় নি, নাচেনি?

    ফিরোজ চুপ মেরে যায়। ভাবে- এ বড়ই কঠিন, এ বড়ই পাষাণ, এর নাম বিমাতা। সৎ মা। ফিরোজ আবার মুখ খোলে-- ‘দুনিয়ায় আর কেউ দুইডা বিয়া করে নাই! ছেলে সন্তান রাইখা জায়গা জমি সব বউয়ের নামে লেইখা দেয় কেউ! মা মরলে বাপ হইয়া যায় তালই। জুডাইয়া আনছে একটা রাক্ষসী। ’

 বড় ঝগড়াটা হয়ে গেছে মাস কয়েক আগে। সেদিন বাড়িটাকে মনে হয়েছিল গ্রামের কেন্দ্র। পুরো গ্রামের চোখ ছিল এ বাড়ির ওপর। বিমাতার অনুমতি না নিয়ে ঘরটার ভিটায় মাটি ফেলে কয়েক ফুট বাড়িয়ে নতুন টিন লাগানো হয়েছিল। প্রথমে শাশুড়ি বউয়ে তর্ক যুদ্ধ, তারপর রক্তারক্তি। ঝগড়াটা তুমুলে গেলে ফিরোজ হঠাৎ উৎসে গিয়ে আঘাত হানে, বাপের মাথায় বাঁশের কটা খাড়া বাড়ি মেরে বলেছিল--‘লাগাইয়া দিয়া মুখে রাম নাম। বউয়ের নামে ঘর বাড়ি দিলি, আগের ঘরের ছাও কী মাগির পেড দিয়া বাইর হইছে। ’ কেউ কেউ ছুটে এসেছিল, দিনে দুপুরে একটা খুন না হয়ে যায়! কিন্তু লাভ হল না। বুড়ো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলছিল, ‘এই ছিল বিধানে। আমারে কইছে নতুন জমির দলিল। আমি কি জানি। ’
   ওই দিন রাতেই বসে সালিশ। অপরাধ-- বাপের গায়ে হাত, আর জায়গা-জমি বিষয়ক জটিলতার অবসান। ফিরোজের বিমাতার বাপের বাড়ির লোকজন লাঠি হাতে হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। দলিলের নড়চড় একদম চলবে না। বুড়োর ঘরে যুবতী দিয়েছি কী কম সাধে। এ ঘরবাড়ি, সম্পত্তি তো কমই।

   মাতবর প্রথমে বিমাতার কাছেই জানতে চাইলো। বিমাতা মাথায় ঘোমটা দিতে দিতে শুদ্ধ শিশুর মতো নিজের মনের সঙ্গে আত্মীয়দের শেখানো কথার সম্বন্ধ পেতে বলল, ‘আমনেরাতো সবই জানেন। ফিরোজের মা মারা যাওনের পর আমারে তুইলা আনছিল ওর বাবা। ওরে তো লেহাপড়া করাইয়া দিছে। কিন্তু আমার গুলানের কী হইবো?  ফিরোজের বাপতো সব খুশি মনেই লেইখা দিছে। ’ ফিরোজ ছাড়বার পাত্র নয়, সবার সামনে কাতর হয়ে জানায় , আরে লেইখা দিছে! কাউরে না জানাইয়া, না হুনাইয়া। একটা কাক-পক্ষিও তো টের পায় নাই। চুরি-ডাকাতি নাহি। আর সে এখনো যুতসই একটা চাকরিও ধরতে পারেনি। কয়েক বছর আগে চাকরিটা হয়েই যাচ্ছিল। পঞ্চাশ হাজার টাকা বাবার কাছে চেয়েও পায়নি। উল্টো টিপ্পনি কেটেছিল বিমাতা-‘ চামার লেহাপড়া করছে। ঘুষ দিয়া চাকরি লওন লাগবো। ’
   সবশেষে সব পক্ষের সম্মতিতে ফিরোজকে ছয় গণ্ডা জমি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। শীঘ্রই ছেড়ে দিতে হবে এ বাড়ি। এ ঘটনার পর কেউ একজন বলেছিল- ‘এমন মারপিট এর আগে  কে করছে এ গেরামে। এমন চললে গেরাম আর গেরাম থাকবো না। ’

   দহুলিয়া নামের গ্রামটা শেষ পর্যন্ত দহুলিয়াই থাকলো। এ বাড়িতে আর কোনোদিন কলহ হলো না। শুধু তিনজনের একটা চোরের দল খুব প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফজরের আজানের আগেই পালিয়ে গেল। বিমাতা সকালে ওঠে কি ভেবেছিল তা জানা যায়নি। তবে চোরের সর্দার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল-- উপজেলা কচুয়ায় গিয়ে যে করেই হোক একটা ঘর ভাড়া নিয়ে উঠে পড়বে। যাওয়ার পথে চোরের দল এক ডাকাত বাড়িতে ঢুকেছিল। এজন্য ডাকাত বাড়ি, চোরের দল চুরির ফিরতি পথে শুধুমাত্র ডাকাত বাড়িতেই ঢুকতে পারে। এক চোর যে নয় বছর ধরে ব্যবহার করা একটা ভাঙাকুলা আনতে পারেনি, সে ডাকাতদের একজনের গলায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিল-- ‘ যা যা ভালোবেসেছি তার এক দানাও আনতে পারিনি। আরো আনতে পারিনি মায়া। ভুল করে ফেলে এসেছি একটা নারকেল গাছ। ’  ডাকাতদের মধ্যেই কে যেন বললো-‘ যা যা চুরি করে আনতে পারনি কখনো ডাকাতি করেও তা আনা সম্ভব নয়। ’  

    এও পৃথিবীতে সম্ভব। একজন মানুষ পারলো। কিভাবে পারলো, কেন পারলো? হাজার হাজার শব্দের মাঝে নয়টি শব্দের বা পাশে তেরসা করে দাগ কাটা। শব্দগুলো শুনুন- ‘বিমাতা নারকেল কুলা গৃহ অনিকেত কলহ মায়া সালিশ ৯ (লি)’।

‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’র মলাটটা খুলে গেছে। শৈলেন্দু বিশ্বাস এম.এ কর্তৃক সংকলিত ও... ছাপার অক্ষরের ঠিক ডানপাশে কালো কালিতে লেখা, ফিরোজ তালুকদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, তাং-৫/৩/১৯৮২ ইং’। ‘৮২ সালে বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। অভিধানটা কিনেছেন হয়তো পড়েছেন, ঘেঁটেছেন। যে শব্দগুলোর কথা বললাম তা ওই সময়ই দাগ কেটেছিলেন তিনি। কিন্তু কি আশ্চর্য! বাবার অভিধানের দাগ কাটা শব্দগুলো মেনেই এগিয়েছে তার পরবর্তী জীবন। আটটি শব্দের মিল খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু ৯ (লি)র কোনো অর্থ পেলাম না। পাঁচ বছর আগে বাবা মারা গেছেন। বেঁচে থাকলে তার কাছেই জানতে পারতাম এ শব্দরহস্য। তখনও শুয়ে আছি আমি। ভাবছিলাম এক একটি শব্দের কথা। একটি শব্দ মানেই কিছু ঘটনা, জীবনের গন্ধ। শব্দ ধরে ধরে বাবার জীবনের সঙ্গে মেলাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই ফোন করলেন রোকেয়া আক্তার। ধরতেই  ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন-‘ কি করতাছস হাবিব? অনেক রাইত হইছে। ঘুমাস না কেন বাবা। ঘুমাইয়া পড়। ’ বললাম- ‘ অসুবিধা নাই মা। এইতো ঘুমাইয়া যামু। তুমি খাইছো নি, কি করতাছো, ঘুমাইয়া যাও। ’
 
http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2011September/babar 220110926192736.jpgফোন রেখে দিই। আবার ভাবতে থাকি ‘৯’ নিয়ে। অভিধানটায় এর অর্থ করা আছে-‘ নবম স্বরবর্ণ। এই বর্ণের ব্যবহার বর্তমানে বাংলা ভাষায় নাই। ’ মনে হলো মাথায় ৯-র কুণ্ডুলী ঘুরছে। ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমায় এবার স্বপ্নের দেশে নিয়ে যায় বাবার অভিধান।
   কচুয়ার এক কামরার ভাড়া বাড়িটা। দেখতে স্কুলঘরের মতো-‘ইংরেজি ‘এল’, এক দরজা, দুই জানলা সমেত এক কক্ষ-এক কক্ষ। বাবা আমাদের নিয়ে প্রথম এই বাড়িটায় উঠেছিলেন।

   ছোট্ট খাটে শুয়ে আছি আমি, মা আর বাবা আথবা আপনাদের পূর্বের হাবিব, রোকেয়া আর ফিরোজ। আমার মাথার পাশের জানলাটা খোলা। আকাশে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী চাঁদ উড়ছে। কি আশ্চর্য! সঙ্গে আমিও উড়তে চাচ্ছি। নির্ঘুম চোখে পাশের একজোড়া দেহের সকল পিপাসাকে পাশ কাটিয়ে চাঁদ হয়ে যাবো! আমি চাঁদ হই, চাঁদ আমি হয়। কত চেনা অথচ অচেনা ডাক ফিরিয়ে দিয়ে মানুষও চাঁদ হয়ে থাকে ভালো। মানুষের জোছনায় পৃথিবীর কত অমাবস্যা গেছে কেটে। আকাশের বুকে ফুল ফোটে। মাটির পৃথিবী ধূলায় কুড়িয়ে লয় স্বস্তির নিশ্বাস। ঘুমের ছুটি হয়, চোখের ছুটি হয়, এ দেহের ছুটি মেলে না। সব দুঃখ বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায় দুই পাহাড়ের মাঝে। নেমে আসে পাতাদের ঘুম।
 
ক্লান্তির শেষ নিশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছেন মা। বাবা আমার হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন একতলা বাড়িটার ছাদে। মনে হলো রাতটা কেবলই নক্ষত্রের। বাবা তাকিয়ে আছেন পলকহীন। আকাশের বুকে ফুটে আছে অযুত তারাফুল। আঙুল উচিয়ে দেখালেন বাবা,‘ঐ দেখ, ৯। আকাশে তারাগোর ৯। ’ আমি বললাম-‘ হ দেখতে পাইতাছি, কী সোন্দর, কেমনে অইল বাবা?’ বাবা শুধু বললেন- ‘দুনিয়ায় দুঃখ বেচনের কোনো হাট নাই। আমাগো জীবন ৯। ’   

বাংলাদেশ সময় ১৭০০, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১১

                                           

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।