ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ঈদ সংখ্যা ও সাহিত্যিক সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে

খালেদ হামিদী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১১
ঈদ সংখ্যা ও সাহিত্যিক সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে

সৈকত হাবিবের ‘ঈদ সংখ্যা : সাহিত্যের রাজনীতি, সংস্কৃতির বাণিজ্য’ শীর্ষক বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী গদ্যটি একই সঙ্গে সচেতন ও নিরাশ পাঠকদের জন্যে ভরসার জায়গা তৈরি করে। এমনকি আপাত-অবহেলিত বা কম মূল্যায়িত কোনো লেখককেও কেবল নির্ভরতার সন্ধান দেয় না, নির্ভীকও করে তোলে।

কীভাবে? তাঁর গদ্যটির অংশবিশেষ উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে ধরার বদলে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার চুম্বক উল্লেখের মাধ্যমে সৈকত হাবিবের আলোচ্য রচনার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে চাই। এভাবে সৈকতের বক্তব্যের সাথে বর্তমান লেখকের অভিন্নতা প্রতিষ্ঠার সাহায্যে ওই ভয়শূন্য পরিপূর্ণতা অনুভবের বিষয়টিকে বাঙ্ময়তা দিতে চাই।

‘সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক’--এই স্বঘোষণা-সংবলিত পত্রিকার প্রাক্তন সাহিত্য সম্পাদকের পৃষ্ঠপোষকতায় গেল শতকের আশির দশকের দু-তিনজন কবি নিজেদের মিথিক্যাল ক্যারেক্টার বা পৌরাণিক চরিত্র ভেবে বসেছেন প্রায়। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য : মিথ বা পুরাণের অতিরঞ্জন প্রসঙ্গে ফ্রান্সিস বেকন যে বলেন ‘নাস্তিকরা ঈশ্বরকে অস্বীকার করে আর মিথপ্রেমীরা ঈশ্বরকে করে অপমান’-- তাতেও মিথের নেতিবাচকতা পুরোপুরি উন্মোচিত হয় না। কেননা প্রাচীন মিথ ধর্ম ও সামন্তীয় শাসকদেরই শুধু অনড়তা দেয় না, ধনতন্ত্র-সৃষ্ট আজকালকার মিথ জনবিরোধী (সেই সঙ্গে প্রকৃত অর্থে জনবিমুখ) চরিত্র ও বিষয়গুলোকেও, নানান মিডিয়ার প্রশ্রয়ে, অমর করে তোলার প্রয়াস পায়।

আরেকটা কথা, পৌরাণিক চরিত্রগুলোর ডিকনস্ট্রাকশন বা অবিনির্মাণ কিংবা পুননির্মাণও শেষ অব্দি আসলে হয় না। কেননা, স্বদেশকে দ্রৌপদী ভাবলে আপাত-রূপকের ব্যঞ্জনা মেলে বটে, কিন্তু দ্রৌপদীর ‘মহাভারতী’য় ইমেজ বদলায় না। কেননা হৃত অবস্থা থেকে স্বদেশকে রক্ষা করবে কি দ্রৌপদীরই সম্ভ্রমরক্ষক শ্রীকৃষ্ণতুল্য অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তি বা মহাপুরুষ? মোটেও নয়। যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হেরে গেলে মাশুল হিসেবে পঞ্চপা-ব তাঁদের অভিন্ন স্ত্রী দ্রৌপদীকে কৌরবদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। উপস্থিত সকলের সামনে দ্রৌপদী দুর্যোধনের হাতে বিবস্ত্র হবার মৃহূর্তে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে অদৃশ্য রেখে সেখানে হাজির হন। এবং দ্রৌপদীর আঁচলকে অনন্ত পর্যন্ত দীর্ঘ করে তোলেন। এতে দ্রৌপদী আর বেআব্রু হন না।

বলা বাহুল্য, আমাদের দেশকে স্থানীয় ও বিদেশি লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে দলিত জনমণ্ডলির জাগরণসম্ভব সম্মিলিত শক্তি, কোনো পৌরাণিক চরিত্রের অলৌকিকতা নয়। অনস্বীকার্য যে, উপর্যুক্ত কতিপয় কবি প্রতিভাদীপ্ত। তাই তাঁদের ওই পৃষ্ঠপোষকের ধারণা, এই কজন কবিই বাংলাদেশের কবিতাকে অকাব্যিকতা থেকে অলৌকিকভাবে উদ্ধার করবেন। কিন্তু পরিণতি লাভের আগেই উক্ত কবিবৃন্দ বিদেশের নাগরিক হন। তদুপরি তাঁদের কাব্যিক অঙ্গীকারের প্রশ্নেও, প্রথম থেকেই, তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন থাকেন। দেশত্যাগের পর থেকে তো হয়ে পড়েন বাংলার অভিজ্ঞতাশূন্য। তাই তাঁদের কাব্যভাষা, কাব্যালঙ্কার ইত্যাদি কর্পোরেট পুঁজির ক্রিম ও বর্ণবিভার অনুকূল হয়ে ওঠে। সেই সাথে কয়েকজন অকবি উক্ত দৈনিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সম্পাদকের প্রীতিভাজন হওয়ায় এর ঈদ সংখ্যার কবিতা অংশের কোরাম পূরণ করেন।  

সৈকত হাবিব-উল্লিখিত উক্ত কোরাম-বহির্ভূত দুয়েকজন কবি দৈনিকটির কোনো কোনো ঈদ সংখ্যায় ঠাঁই পেলেও পরে তাঁদের প্রায় খারিজ করে দেওয়া হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের কাব্যবিচারের আদৌ কোনো মানদণ্ড আছে কিনা বোধগম্য হয় না। কিন্তু এতে বঞ্চিত কবিদের আত্মপ্রকাশের আশা, নিগৃহীত কারুর ছেঁড়া জামার মতো, প্রশ্নের ডগায় বিদ্ধ হয় না। বরং তাঁদের উত্তরোত্তর সৃজনশীলতার ফলে তা তাঁদেরই সত্তার শিরে নিজস্ব পতাকার মতো ওড়ে। তাই পত্রিকান্তরে তাঁদের সংবেদের পরিচয় আমরা পাই।

কিন্তু তাঁরা প্রথমে ওইভাবে বাদ পড়েন কেন? এমনকি উক্ত বড় কাগজে দীর্ঘকাল ধরে প্রায়-নিয়মিত কবিতা প্রকাশের পরেও? ওই দৈনিকের সাহিত্য বিভাগ থেকে তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে কবিতায় বদল ঘটানোর মৃদু অভিযোগ তোলা হয় (মৌখিকভাবে, পাঠকদের অগোচরে)। পরে এর সাপ্তাহিক ‘সাহিত্য সাময়িকী’ থেকেও তাঁদের নির্দ্বিধায় তালিকাচ্যুত করা হয়। কিন্তু ওই পরিবর্তন মানে কবিতা থেকে কবিতাতর রচনায় অবতরণ নয়, কবির ব্যষ্টিকতা থেকে সামষ্টিকতায় উত্তরণ কিংবা আত্মরতি ছেড়ে রাজনীতিসচেতন হবার প্রয়াস। শুধু আলোচ্যমান কাগজ নয়, সব বড় কাগজই সূক্ষ্মভাবে সমষ্টিবিমুখ বলেই এগুলোর ঈদ সংখ্যা বা সাহিত্যের পাতাও প্রকৃত অর্থে ব্যষ্টিবাদী পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যের প্রতি উন্মুখ। প্রবন্ধ বা কথাসাহিত্যের চেয়েও বাংলাদেশের কবিতার ওপর পত্রিকাকেন্দ্রিক বড় প্রতিষ্ঠানের এই ভয়ংকর ভার জেঁকে বসে। বড় দৈনিকের বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদকদের কেউ কেউ প্রতিবেশী দেশের বাংলাভাষী কবির সঙ্গে মিলে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামের সংকলন প্রকাশের ধৃষ্টতা দেখান। এতে অনেক অকবিকে টেনে তুলে আর কিছু প্রকৃত কবিকে উপেক্ষার অস্ত্র হেনে বিদেশে দেশের কবিতার প্রকৃত চেহারা গোপন করা হয়। আরো অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষণীয়, উক্ত সম্পাদকদের কেউ কেউ কবি-পদ্যকার হিসেবে অবিকশিত কিংবা স্বেচ্ছায় অবসরপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও উক্ত প্রকার সংকলনে নিজেদের পদ্যও অন্তর্ভুক্ত করেন।    

একই কর্তৃপক্ষের অধীনে কর্মরত বলে হয়তো সৈকত ‘কালের কণ্ঠ’র ঈদ সংখ্যার প্রশংসা একটু বেশিই করেন। প্রথমোক্ত দৈনিকের তুলনায় এটির বয়স ঢের কম হলেও প্রাগুক্ত বঞ্চিত-অমূল্যায়িত কবি-লেখকদের অনেকে এতেই নিয়মিত আশ্রয় লাভের স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নও অবশ্য আধেক বা সিকি পরিমাণ অধরা থেকে যায়। কেন? হয় তাঁরা গোত্রভুক্ত হতে জানেন না কিংবা কোনো গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হয়েও স্বাতন্ত্র্যহেতু নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।

কিন্তু আমাদের কবিতার অভিমুখ কী হওয়া উচিত? আত্মরতির পরিবর্তে উত্তর-ঔপনিবেশিক সচেতনতায় পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চৈতন্যে দীপ্ত হওয়াই কি এক্ষেত্রে কাম্য নয়? তাহলে হাফিজ রশিদ খান, মহীবুল আজিজ, জুয়েল মাজহার, সাখাওয়াত টিপু, সৈকত হাবিব ও জহির হাসানদের মতো কবিদের পর্যাপ্ত কদর কেন হয় না সাহিত্য সাময়িকীতে, ঈদ সংখ্যায়? তাঁরা প্রচলবিরোধী বলেই? জনবিচ্ছিন্ন কৈবল্যবাদীদের জনজীবনের স্পন্দনময় কবিতা পছন্দ নয়। তাই বলে প্রাগ্রসর চেতনাদীপ্ত প্রবন্ধও কি ছাপার অযোগ্য?

বয়োবৃদ্ধ লেখকদের চর্বিতচর্বণরূপ গদ্য ছাড়া প্রায় বড় কাগজই উল্লিখিত পরিণত যুবক কবি-লেখকদের মননশীল গদ্যের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করে। এ অসহনীয় যে, আশির দশকের দশ কবির কবিতার বিশদ মূল্যায়ন সংবলিত বর্তমান গদ্যকারেরই প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে’ (ফেব্রুয়ারি ২০০৭) ‘সমকাল’, ‘সংবাদ’ ও প্রাক্তন ‘আজকের কাগজ’ ছাড়া আর কোনো দৈনিকের সাহিত্যপাতায় আলোচিত-সমালোচিত হয়নি। ‘আশির দশকের কবিতার ওপর এমন কাজ আর হয়নি’--এ কথা শুনিয়েও ‘ব্রাহ্মণ’ দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক বইটির মূল্যায়ন করেননি বা করানোর উদ্যোগ নেননি। শুধু তাই নয়, বইটি প্রকাশের খবর পর্যন্ত ছাপেননি। অথচ কবি হিসেবে উক্ত সাহিত্য সম্পাদক বইটিতে আলোচিত হন ঐতিহাসিক কারণে। মিত্রকেও পিঠ দেখানোর সংস্কৃতি তো মার্কিন রাজনীতিরই প্রতিভাষ। এই প্রতিভাহীন ক্ষমতাধরেরা নিঃসঙ্গ অথচ সক্রিয় কবি-লেখকদের সিরাজুদ্দৌলা কিংবা সাদ্দাম হোসেনের প্রায়-অনুরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন করাতে চান। কেবল পারেন না তাঁদের নিশ্চিহ্ন করতে। তবু ভয় নেই। সৈকত হাবিবের গদ্যের ফোয়ারা নিশ্চয় আরো গতিশীল হবে। এভাবে নৈঃসঙ্গ ও প্রাজ্ঞ-বিরুদ্ধতাই হবে আমাদের অমিয় ভূষণ।

[email protected]

সৈকত হাবিবের সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন :

বাংলাদেশ সময় ১৮০৫,  সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।