ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | শাফিনূর শাফিন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৬
প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | শাফিনূর শাফিন

বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি শাফিনূর শাফিনের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প। 

কবি শাফিনূর শাফিনের জন্ম ২১ এপ্রিল, ১৯৮৭। চট্টগ্রামেই জন্ম, বেড়ে ওঠা।

পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে একটি উন্নয়ন সংস্থায় গবেষণা বিভাগে কাজ করছেন। প্রাচ্য রিভিউ নামে একটি অনলাইন ম্যাগাজিনের কবিতা বিষয়ক সম্পাদক। কবিতার পাশাপাশি অনুবাদ করেন ও গল্প লেখেন মাঝেমধ্যে।

বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি শাফিনূর শাফিনের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প।  


প্রিয় পাঁচ কবিতা

অভিসার
আতর আর আগরবাতির ধোঁয়া ওঠা পূর্বগন্ধে 
আমার মৃত্যু শুয়ে পড়েছে দেহে
ঝুঁকে পড়ছে যেন ঝড়ো কুঁজো মেঘ
তুফান তুলবার অপেক্ষায় নিয়েছে শরণ
এসো প্রিয়তম সাঁতার, ডুবে যাই
ক্লোরিন জলস্রোতের আলিঙ্গনপাশে
বিহ্বল করে দিয়ে তাঁর দুর্ভেদ্য প্রাচীর,
অপ্রতিভ নখের আঁচড়ে এঁকে যাই 
বিপরীত এক খরস্রোতা নদী
উড়াল-দিনরাত্রির ছায়ায় মিশে আছে
আদিম সম্মোহনে বিস্মৃত চুম্বন

এসো অভিসার, পাশে এসো
দেখো, ডুবে যাওয়ার কী ভীষণ ভয়
তবু সাঁতার জানিনি কখনো!

রোজনামা
*
কোত্থেকে রাতে স্বপ্নে আবার সেই পরিচিত কুকুরটা এলো। তার জ্বলজ্বলে বাদামি চোখ জানে স্পর্শকাতর অজস্র সব গুপ্ত তিলের খবর। স্বপ্নের কোনো তালগোল নেই। চেনা-জানা কুকুর, খাবার না পেলে নিজের লালা নিজেই চেটে খায়। কিছুটা করুণাবশতই গলায় লাল বেল্ট জড়িয়ে, তার সামনেকার ডানপায়ের নখে নেইলপলিশ লাগাতে লাগাতে ঘুমটা ভাঙতেই বললাম, সান অফ বিচ!

**
তোমার অপেক্ষার প্রহর গুনছি আমিও।
কবে আসবে দোল!
রঙ ছোড়া।
ত্বকের অ্যালার্জি।
ছিটকে বেরিয়ে আসবে প্ল্যাটফর্ম।
দমদম পার্কের পরিত্যক্ত ট্রামের সারি।
উপর থেকে ছুড়ে ফেলা চাবি।
গেট খুলে একপেশে হয়ে ঢুকে পড়বে শরীর।
পা টিপে টিপে সিঁড়ি ভাঙা।
নিত্যকার খিটিমিটি।

জানি, অপেক্ষা করে আছে
দেয়ালে মাছের নতুন বাচ্চা,
কমলা পর্দার নিচে দাঁড়িয়ে কুকুরের ঘেউ,
পাতার বিড়ির ঘ্রাণ,
ধ্যানের ভঙ্গি 
নতুন কোনো প্রহসন!

শূন্যম্পর্ক
*
ময়ূর!
নিথর করে দেয় আমার সমস্ত শরীর। তার তিরতির মেলতে থাকা ডানাজুড়ে সহস্র রজনীর লবণাক্ত চোখের পলক আঁকা। আমি কাঁপতে থাকি অর্ধ-বৃত্তাকারে... আমার মনে হতে থাকে আমি ইসাডোরা আর সে ময়ূর না, এসেনিন। আমি উঁচু হতে থাকি গ্রীবা বাঁকিয়ে, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ভর দিয়ে- আমার দুহাতের তর্জনী পরস্পরকে ছোঁবে বলে ঊর্ধ্বমুখী... 

একবার পথে কালো পোশাক এবং মাথার কালো ফেট্টি গায়ের রঙের সাথে ভূতের মতো মিশে যাওয়া এক হাফসি বৃদ্ধা কুঁজো হয়ে পাশ কাটানোর সময় ঠুক ঠুক লাঠি ঠুকে বলল- ব্ল্যাক ম্যাজিক গার্ল! আমি ততদিনে শিখে গেছি কীভাবে ছানিপড়া ঘোলাটে দৃষ্টি এড়িয়ে প্রতিক্রিয়াহীন পায়ে হেঁটে আসতে হয়।  
তুমি এখন কোন শহরে হে নাবিক? অপেক্ষা শব্দটা বুকে নিয়ে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছ বাসের অপেক্ষায় নাকি কোনো সরাইখানার টালমাটাল সিঁড়িতে হাঁটুতে থুঁতনি গুঁজে বসে?
**
হেঁটে আসা ভেজা আঙুল আর নখের আবদারে ভেসে গেলো সন্তুরের সুর। ভান নেই, ভঙ্গিমা নেই- এমন করজোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো পাঁজরের হাড়। হাড়ের ভিতরে কোনো রাত্রে ফেলে আসা মোচড়, ব্যথাময় যূথ মূর্তি। মানুষ তাঁর নিজের ভিতর আরও আরও একা হয়ে পড়ার মুহূর্তে টের পেয়ে যায়- বেঁচে থাকার ভুল তালিকা থেকে বাদ গেছে নিঃসঙ্গতা।
***
শূন্যের সাথে যেকোনো সংখ্যার গুণ দিলেই সমাধান শূন্য হয় জেনে অনেক দূরে নিভে যাওয়া তারার শরীরের পাশে কাঠগোলাপের গন্ধ নিয়ে দাঁড়ালো কতো নভোযান! কুয়াশায় কেন ছায়া দেখা যায় না তুমি জানো? রাত্রিচেরা এক কুয়াশায় হারিয়ে ফেলা ঘুমে তুমি জেনে যাবে কাঁটার চেয়েও কাঁটাতার অনেক বেশি ইতিহাসের কথা বলে।

মেয়েরা
মদ খেলে মেয়েরা শুধু পেয়ারা গাছের গল্প বলে।
ঘোরগ্রস্ত চোখ ভুলে যায়
চন্দ্রাবতীর অন্তহীন অপেক্ষা আর অপমান।
তারা এলাচ বনে তুমুল নৃত্যের ঘোরে
একের পর এক তির গাঁথতে থাকে শরীরে।
রক্তাক্ত হবার মুহূর্তেও মেয়েরা ভাবে,
মিটসেফে তুলে রাখা খাবার গরম করার কথা।  

ডানা নেই, ছায়া নেই
সমুদ্রের গল্প আমি কখনো করি না। সমুদ্রের কাছে গেলেই আমি অসুস্থবোধ করি। ঢেউগুলো কেমন বিশ্রী মুখ-হাঁ করে সিংহের মতো গর্জন করতে থাকে। আর সবাই তাতে কেমন হ্যাংলার মতো পা ডুবিয়ে থাকে আর কোনো এক শিশু সেই ঢেউয়ে লাফাতে-লাফাতে বলে “দ্যাখো দ্যাখো! আমার পা সমুদ্রে হারিয়ে গেলো!” 
আমার শরীরে কোনো শিশুপ্রীতি নেই, পশুপ্রীতি নেই, তাই কোনো সমুদ্রপ্রীতিও নেই।
অথচ এবার ঘর পালানোর জন্য তুই সেই সমুদ্রকেই বেছে নিলি! সেই মুখ-হাঁ করা গর্জন হয়ে উঠবে তোর দুপুর!
তোকে ধার দেওয়ার পর আমার আর ডানা নেই, ডানার ছায়া নেই।


কবিতার পেছনের গল্প
অভিসার কবিতাটি মূলত ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে লেখা। আলেক্সান্ডার বেলায়েভের ইকথিয়ান্ডার। ভাবছিলাম যদি এমন কেউ থেকে থাকে আমার চেনা, যিনি জল ভালোবাসেন। জলকে ভালোবেসে জলের ভিতর যিনি হারিয়ে যাবেন। মূলত আমি নিজেই সেইজন যে সাঁতার জানে না। জলে নামলে যার জানা নেই ডুবে যাওয়া এড়ানোর উপায়।  
রোজনামা আমার এক মেয়েবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লেখা। তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসার কিছুদিন পরে সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। সিজোফ্রেনিক হয়ে পড়ে। অমন একটা সময়ে সে রোজ আমাকে খুঁজত। আর আমি তখন বাংলাদেশে এসেছি, চাইলেও  যেতে পারছি না- পরে আমাদের দোলের সময় দেখা করার কথা ছিলো, তাও দেখা হয়নি। তো এসব রোজকার চিৎকার চেঁচামেচি, না পারা নিয়ে লেখা।  
‘শূন্যম্পর্ক’ সিরিজের কবিতাগুলো আমার খুব প্রিয় এক মানুষ ও কবির সাথে লেখা। বিদেশ বিভূঁইতে যখন খুব নিঃসঙ্গ সময় কাটছিল তখন এই কবিতাগুলো লেখার তাড়না কিছুটা সঙ্গ দিয়েছিল আমাকে।  
‘মেয়েরা’ কবিতাটা যা লিখেছি তাই। একবার এক প্রেমিকা মদ খেয়ে ফোন করে তাঁর শহরে কেন কোনো পেয়ারা গাছ নেই বলে অকারণ চেঁচাচ্ছিল। আমি ফোন রেখে এই কবিতাটা লিখেছিলাম মনে আছে।  
জুয়েইরিযাহ মউ আর আমি দু’জন দুই দেশে থেকেও একসাথেই সমুদ্র দেখা নিয়ে ‘ডানা নেই, ছায়া নেই’ কবিতাটা লেখা।  
যেকোনো পুরুষ থেকে আমি মেয়েদের বেশি ভালোবাসি। তাই আমার প্রায় সব কবিতাতেই আমার চেনাজানা মেয়েরাই থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।