ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আমার বাবার জীবনদর্শন

মৌলি আজাদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১১
আমার বাবার জীবনদর্শন

আমার বাবা বাংলাদেশের একমাত্র প্রথাবিরোধী লেখক প্রয়াত ড. হুমায়ুন আজাদ জন্মেছিলেন বৈশাখে, ১৩৫৪ সালের ১৪ই বৈশাখে, ইংরেজি ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল। বৈশাখ মাস ছিল তাঁর প্রিয়।

আমার মনে হতো, বৈশাখ মাসের তীব্রতাই হয়তো জন্মের সময় তাঁর ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। আর তাই তিনি হয়েছিলেন জেদী, রাগী ও অহংকারী। তাঁর জন্ম তাঁর নানার বাড়ি কামার গাঁওয়ে হলেও তিনি মূলত বেড়ে উঠেছিলেন রাড়িখাল গ্রামে। রাড়িখাল গ্রাম ছিল আমৃত্যু তাঁর বুকের মাঝে।

জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি, রাড়িখালের পুকুর, মেঠোপথ, কড়িফুল, শীতের শিশির, গ্রীষ্মের রোদ, বর্ষার প্লাবন, ফাল্গুনের সবুজ পাতার সৌন্দর্য বারবার বাবার বিভিন্ন লেখায় এসেছে। বাবা রাড়িখাল গ্রামে ছিলেন মাত্র ১৫ বছর। কিন্তু এই ১৫ বছর সময়কালকে আমি দেখেছি তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। মাঝে মাঝে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম তাঁর জীবনের কোন সময়টা সুখকর ছিল? অন্যরা হলে হয়তো বলতেন জীবনের মাঝ বয়সের কথা, কারণ এ সময়ই মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সাফল্য এসে ধরা দেয়। কিন্তু বাবা বারবার বলতেন রাড়িখালের মাত্র পনের বছর জীবনযাপনই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখকর অধ্যায়।
Mouli-Azad-smতিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে থেকে শিক্ষা নিলেও তিনি রাড়িখাল গ্রামের শিক্ষক প্রয়াত বিষ্ণুপদ সেন ও প্রয়াত হোসেন স্যারকে কখনও ভুলতে পারননি, কারণ এ দুজন শিক্ষকই তাঁকে প্রথার বাইরে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি সব সময় সমাজসংস্কৃতির যে কোনো প্রথাগত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন। লেখালেখির স্বার্থে তিনি তাঁর পিতৃপ্রদত্ত হুমায়ুন কবীর নামটিও ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা করেননি। সব কিছুতে প্রথাবিরোধী হলেও সংসার জীবনটা তিনি কাটিয়েছেন একরকম প্রথাবদ্ধভাবেই। সেই সকাল ৮টায় ঘুম থেকে ওঠা, প্রাতঃরাশ সারা, টেলিফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভক্ত ও সাংবাদিকদের সাথে আলাপ করা, নিজের লেখালেখিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকা, রুটিন মাফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া আর বিকেলবেলা আজিজ মার্কেট/সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তরুণ ভক্তদের সাথে যুক্তিতর্কই ছিলো তাঁর বেঁচে থাকা জীবনের রুটিন। সংসারের কাজও করতেন আনন্দের সাথে, প্রথাবিরোধী হবার সুবাদে সংসারকে ফাঁকি দিতে তাকে দেখিনি। খুব বেশি সাদাসিধে জীবনযাপনকেই পছন্দ করতেন। বৈষয়িক চিন্তাভাবনা জীবনে কখনও ঠাঁই তিনি দেননি। তোষামোদি করে উপরে ওঠার ধাত তাঁর ছিল না। সহ্য করতে পারতেন না ধর্মীয় উগ্রতা ও নারীর স্বাধীনতাহীনতা।

বাবার জীবনদর্শনে দেখেছি- তিনি যার যার জীবন তার তার ফর্মুলাতে সাজানো এই ফর্মুলাতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি আমাদের তিন ভাইবোনকেও গৎবাঁধা জীবনে অভ্যস্ত হতে কখনও বলতেন না। তবে পড়াশোনা করে চাকুরী করতে বলতেন। সবসময় আমাদের সাবলম্বী হতে বলতেন, যাতে কখনই আমাদের পরনির্ভর না হতে হয়। তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি বই পড়ার অদম্য নেশা। সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান ও রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ের উপরে ছিল তাঁর বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার। কিভাবে যে তিনি এত বই পড়তেন তা ভেবে অবাক হতাম। আমাদেরকেও বিভিন্ন রকম বই পড়তে বলতেন, পড়তাম আর বইয়ের মূল্য যে কি তা অনুধাবন করতাম। তিনি আমার বাবা না হলে হয়তো বইয়ের প্রতি আমার আজ এত ঝোঁক হত না। তিনি খুব বেশি ভ্রমণ পিয়াসী ছিলেন না মোটেই। তাঁর ভ্রমণ বলতে ছিল কেবল- রাড়িখাল গ্রামে ভ্রমণ। রাড়িখালকে তিনি খুব পছন্দ করতেন, সেই রকমই পছন্দ করতেন বাংলা একাডেমীর বইমেলাকে। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটাই তিনি যারপরনাই উপভোগ করতেন। বই, বইমেলা আর শিক্ষকতাই ছিল তাঁর জীবনের সব। তাঁকে আমি কখনও রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি করতে  দেখিনি।

তিনি ২০০৪ সালে সে সময়কার ক্রান্তিকালের সমাজ চিত্র লিখেন তাঁর ‘পাকসার জমিন সাদবাদ’ নামক বইয়ে। আর তাঁর জন্য নির্মমভাবে ২০০৪ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাএকাডেমীর  বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে তিনি মৌলবাদীদের হাতে চরমভাবে আক্রান্ত হন এবং সেই আঘাতের পরিক্রমায় ১২ আগস্ট জার্মানীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

humayunAzad

২০১১ সালের ১২ আগস্ট আমার বাবা প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে তাঁকে জানাই সালাম। ভাবি আজ তিনি বেঁচে থাকলে ২০১১ সালের এই মুক্ত পরিবেশে তিনি বহু কালজয়ী লেখা লিখতে পারতেন, অগনিত পাঠক আজ যেমন তাঁর লেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তিনি বেঁচে থাকলে তারা আজ তাঁর লেখা থেকে বঞ্চিত হতো না। বাবার হত্যাপ্রচেষ্টার মামলাটি এখনও চলছে। আশা রাখি, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই এ মামলার বিচারকাজ শেষ হবে আর দেশ হবে এক সৎ মেধাবী লেখকের হত্যা প্রচেষ্টার বিচার করে ভারমুক্ত। কারণ আমরাতো এরকম বাংলাদেশই চেয়েছিলাম।

বাংলাদেশ সময় ১২১৫, আগস্ট ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।