ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শিল্পী রবীন্দ্রনাথ : শিল্পীদের চোখে

রবাব রসাঁ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১১
শিল্পী রবীন্দ্রনাথ : শিল্পীদের চোখে

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন পরিণত বয়সে। তাহলে কি তিনি যে কথা গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধে প্রকাশ করতে পারেননি, তা-ই প্রকাশ করতে চেয়েছেন চিত্রকলায়? শিল্প-সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা’ নামের প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক কল্পনার সঙ্গে শেষ ঝগড়ার ফসল তার চিত্রকলা’।

এমন ধারণাটিই পাওয়া যায় অধিকাংশ রবীন্দ্র-শিল্প-সমালোচকদের কাছে।

তবে চিত্রশিল্পীরা কী ভাবেন শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে?

কবির শিশুকালের আঁকাজোকার কথা থাক। ষাটের বেশি বয়সে, ১৯২৪ সালে, রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতা এবং সেই সময়ে তার কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’র পরিমার্জনা বা কাটাকুটি যেন রবীন্দ্রনাথের শিল্পী হয়ে ওঠার শুরুর গল্প। লেখায় বা বইয়ে কাটাকুটি তিনি আগেও করেছিলেন। তবে ‘পূরবী’তে তিনি এনেছিলেন একটি বিশেষ ধরন। পুরোনো শব্দ কাটতে গিয়ে তিনি কিছু রেখার জাল সৃষ্টি করেছেন।

এই রেখার জাল ক্রমেই পেয়ে যায় তরঙ্গরূপ। পেয়ে যায় অবয়ব। আবার এই রেখাগুলোই পরবর্তী সময়ে রঙের ছোঁয়ায় ভিন্ন রূপ পায়। ‘শিল্পকলা বিষয়টি মানুষের সহজাত। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলাকে তাত্ত্বিক ও উপলব্ধির দিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে,’ শান্ত কণ্ঠে বললেন শিল্পী নিসার হোসেন।

‘রবীন্দ্রনাথ শিল্পচর্চায় স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। আমরা, বিশেষ করে, এ সময়ের শিল্পীদের অনেকেই অন্যদের বা ক্রেতাদের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে শিল্পচর্চা করে থাকি। রবীন্দ্রনাথ সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে ছবি এঁকেছেন। ’

নিসার হোসেনের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ সব শিল্পপরম্পরার ঊর্ধ্বে উঠে যে শিল্পচর্চা করেছেন তাকে আমরা ‘উইনিভার্সাল আর্ট’ বা ‘শাশ্বত শিল্প’ বলতে পারি। তিনি অনন্য। ’

‘মানুষ রহস্যপ্রবণ’-- এই ভাবনাটি রবীন্দ্র-শিল্পকলায় রয়েছে গভীরভাবে। সাহিত্যে তিনি যত বেশি গভীরে অবস্থান করেছেন, শিল্পকলায় তার চেয়েও বেশি গভীরে কাজ করেছেন। শিল্পী নিসার হোসেন তাই রবীন্দ্র-চিত্রকলার বিশ্লেষণ করেছেন এই গভীরতা দিয়ে। বলেন, ‘শিল্পের ‘গভীরে’ ইউনিটি থাকে বেশি, ডিটেইল থাকে কম। ’

রবীন্দ্রনাথ কাটাকুটির ছলে যে আঁকিবুকি করেছেন তা বৃথা যায়নি। সেই রেখাগুলোই এনে দেয় কিছু কিছু পরিচিত ও অপরিচিত জীবজন্তুর আভাস। ক্রমেই প্রাণ পায় তারা। এটা অর্জন করা খুব কঠিন কাজ বটে। তিনি এই কঠিন কাজটিই তার শিল্পকলার মাধ্যমে করে গেছেন।

শিল্পী ঢালী আল মামুনের কাছে ‘রবীন্দ্রনাথ চিত্রকর হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ’। কেননা, ‘পরাধীনতার মধ্যে থেকে তিনি হীনম্মন্যতার বাইরে এসে ছবি এঁকেছেন। রেখা-রঙ-বিষয় দিয়ে তিনি নিজের কথা প্রকাশ করেছেন। ’
tagore-3
শিল্পী মামুনের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ তার মনোজগতের জটিল বিষয়গুলোকে সচেতন মনে তুলে ধরেছিলেন সাহিত্যে আর অবচেতন মনে তুলে ধরেছিলেন চিত্রকলায়। এখানে আমি রবীন্দ্রনাথকে স্যালুট করি। ’

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় মামুন বিস্মিত, বিমুগ্ধ। তবে, তিনি বললেন, এটি তার নিজের কাজে কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি।

অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ তার চিত্রকলায় যে মরমীভাব সৃষ্টি করেছেন তার অভিব্যক্তিগুলো একজন শিল্পী হিসেবে কনকচাঁপা চাকমাকে খুব আকৃষ্ট করে।
‘রবীন্দ্রনাথের ফিগারেটিভ কাজগুলো বেশি ভালো লাগে। তিনি আধুনিক চিত্রকলার জনক। তার আধুনিকতায় সরলতা আছে। সীমাদ্ধতার ভেতর তিনি অসাধারণ রঙ ব্যবহার করেছেন। তিনি খুব সুচিন্তিতভাবেই রঙ ব্যবহার করেছেন,’ বলেন শিল্পী কনকচাঁপা।

শিল্পী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মন্তব্য, ‘রবীন্দ্রনাথের শিল্পকলা অত্যন্ত আধুনিক। তার সমকালীন শিল্পীদের তুলনায় তিনি অ্যাডভান্সড ছিলেন। ’ তিনি আরো যোগ করলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কাজের হাত যথেষ্ঠ শক্তিশালী। বিশেষ করে নারীর চিত্রগুলো শাশ্বত রূপ পেয়েছে। ’

হালে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। কেননা, গানে-কবিতায় তিনি কাজ করেছেন শৃঙ্খলিত ছন্দের বৃত্তে। কিন্তু চিত্রকলায় তিনি থেকেছেন চলমান নিয়ম-নীতির বাইরে। কাজ করেছেন শুধু সৃষ্টির প্রেরণায়।

শিল্পী রফিকুন নবীর মতে, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলায় অন্যরকম। ‘কেননা, তিনি পেশাগত চিত্রশিল্পী হওয়ার চেষ্টা করেননি। নিজের খেয়াল-খুশিমতো তিনি ছবি এঁকেছেন। তার সমকালীন ভারতীয় শিল্পীরা এতটা স্বাধীনতা ভোগ করেননি। তিনি ভারতের প্রথম আধুনিক শিল্পী। ’

‘তিনি তার ভূ-দৃশ্যগুলোতে অদ্ভুতভাবে আলো ফেলেছেন। মেয়েদের শাশ্বত চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ’ আরো বলেন রনবী।

রবীন্দ্রনাথ তার চিত্রকলা চর্চা করেছেন এমন একটা সময়ে, যখন ইউরোপ অবস্থান করছিল দুটি মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী যুগে। ইউরোপের সাহিত্যের মতো চিত্রকলাও যে তাকে আকৃষ্ট করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কতটুকু আকৃষ্ট করেছিল সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।

শিল্পী আইভি জামানের কাছে ‘রবীন্দ্রনাথের কাজগুলো খুব সহজ-সরল’।

‘তার ছবিতে ব্যবহৃত মাটির রঙ আমাকে খুব টানে। তার ছবির বিমূর্ততা খুব টানে। মুখচ্ছবিগুলো নিয়ে যায় স্বপ্নের দেশে। ’ বললেন তিনি।
tagore-2
শিল্পী আইভি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ না এলে আধুনিক শিল্পকলা এতো দূর এগোতো না। তাঁর চিত্রশিল্পের রস-আস্বাদন করলে বোঝা যায় আধুনিক চিত্রকলার রূপ।

আইভি জামানের বিশ্বাস, একদিন রবীন্দ্রনাথ শিল্পী হিসেবে আরো খ্যাতি অর্জন করবেন। ‘সারা বিশ্বের প্রধান শিল্পী তিনি। তার ফিগারেটিভ কাজগুলোতে ভাস্কর্যের ছোঁয়া আছে। তিনি এমন একজন আধুনিক চিত্রশল্পী যিনি আধুনিক ভাস্কর্যের আদল তৈরি করে দিয়ে গেছেন। ’

রবীন্দ্রনাথকে তার কাজের প্রেরণা হিসেবে উল্লেখ এই শিল্পী বলেন, ‘তার ছবিতে রঙের এমন ব্যবহার যে অন্ধকারেও অবয়ব দেখা যায়। আমরা যা ভাবি রবীন্দ্রনাথ যেন তা এঁকে গেছেন। ’

চিত্রসমালোচকদের মতে, রবীন্দ্রনাথ তার শিল্পকর্মের মধ্য-পর্ব থেকে শেষ-পর্ব পর্যন্ত আলো-ছায়ার দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তার চিত্রকলায় আলো এসেছে বিভিন্ন উৎস থেকে। তিনি আলো নিয়ে খেলা করেছেন, সৃষ্টি করেছেন রহস্যময়তা।

এই রহস্যময়তাকে সহজে ধরার জন্য রবীন্দ্র্রনাথ যে মাধ্যমটি বেশি ব্যবহার করেছেন তা হলো জলরঙ। ‘এটি তাঁর সবচে পছন্দের মাধ্যম ছিল। দুটি রঙের মাঝে সাদা রঙ ছেড়ে দিয়ে তিনি ‘ডিভাইডেড লাইন’ তৈরি করেছেন। তিনি ভারতের আধুনিক চিত্রকলার জনক। ’ মন্তব্যটি শিল্পী আবদুশ শাকুর শাহর।

শিল্পী ও শিল্প-সমালোচক উভয়কেই তিনি আজও মোহমুগ্ধ করে রেখেছেন, রবীন্দ্রনাথের সরল শিল্পকলার এমনই জটিল গুণ!

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ১৭২৫ ঘণ্টা, ৬ আগস্ট, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।