ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নিউ ইয়র্ক টাইমসে রবীন্দ্রনাথ

নোবেল থেকে মরণ

পলাশ দত্ত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১১
নোবেল থেকে মরণ

আমেরিকা তখনো আমেরিকাই। আমেরিকানরা তখনো আমেরিকানই।

সাধারণ আমেরিকানরা কেমন তা যেমন আমরা এখন জানি না, তখনো জানা যায়নি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক আমেরিকা তখনো এখনকার মতোই। সেই আমেরিকা ‘পশ্চিম’ বলতে কী বুঝতো তা তাদেরই কেবল জানা সম্ভব ছিলো। আমাদের জন্য রয়ে গেছে শুধু সামান্য ইঙ্গিত।

তৃতীয় দুনিয়ার মানুষের কাছে উন্নত জীবনের যাপকই ‘পশ্চিম’। আমেরিকার কাছে আমেরিকাই ‘পশ্চিম’- খারাপ শোনালেও সত্যিটা হলো- আমেরিকার কাছে আমেরিকাই দুনিয়া। এখন যেমন, তখনো তেমন ছিলো। তাই আমেরিকার কাছে রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু কবি’। আমেরিকার হিসেবে তিনি পশ্চিমে পুরোই অপরিচিত।

এই ‘হিন্দু কবি’ত্ব আর ‘পশ্চিমে পুরো অপরিচিত’ থাকার ঘটনা আমেরিকানদের জানায় সেখানকার বহুল প্রচারের দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস।

২.

tagore

নিউ ইয়র্ক টাইমসে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার খবর ছাপতে গিয়ে তার নাম Babindranath ছাপা হওয়ার খবর তো পুরনো। তবু যারা রবীন্দ্রবেত্তা নন, তার জীবনী ঘেঁটে যারা তুখোড় নন, যারা তার ইংরেজি লেখক জীবন সম্পর্কে তেমন জানেন না- সেইসব পাঠকের জন্যে বিষয়টা জানিয়ে রাখাই মঙ্গল : ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার খবর ছাপে পত্রিকাটি। পুরস্কারটি এর ঠিক এক দিন আগে ঘোষণা করা হয় সুইডেনের স্টকহোমে। সেই খবরের শিরোনামেই অপমানের চমক নিয়ে আসে পত্রিকাটি। তারা শিরোনাম করলো ‘একজন হিন্দু কবিকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে’। তবে রবীন্দ্রনাথ যে হেলাফেলার পাত্র নন তা বোঝানোর জন্য শিরোনামের নিচেই পত্রিকাটি লিখে দিলো যে তার পরিবার ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত পরিবারগুলোর একটি। তারপরই খবর শুরু, এবং সেখানেই আসল দুর্ঘটনা। লেখা হলো Babindranath Tagore নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। গুরুত্বের সঙ্গে বলা হলো যে এবারই প্রথম এমন কোনো মানুষকে পুরস্কারটি দেয়া হলো যার গায়ের রং শাদা নয়।

ঠিক পরদিন অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর ছাপা হচ্ছে এই রকম কলাম : “সংকীর্ণতার কারণেই সম্ভবত, এবারের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পশ্চিমের সব গদ্য ও কবিতালেখককে বাদ দিয়ে একজন হিন্দু কবিকে, যার নাম উচ্চারণ করা কঠিন আর মনে রাখা আরো কঠিন, দেয়ায় আমাদের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হওয়ার চেয়ে বিস্মিতই হয়েছে বেশি। এটা হয়তো ঠিকই আছে, কিন্তু একটু কঠিন লাগে ব্যাপারটা, আর বিষয়টা আমাদের প্রচলিত ধারণার মধ্যে পড়ে না। নোবেল কমিটি ছাড়া আমাদের সবার ভেতরে ই টাকা আর গরিমা নিজের পরিবারে রেখে দেয়ার ধারণাটা খুব প্রবলভাবে প্রোথিত।

অনেক বৃটিশ সমালোচক বাবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় এমন প্রমাণ পেয়েছেন যাতে তাকে জীবিত সব কবির মধ্যে সবচেয়ে আত্মিক স্পৃহা সম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে তাদের। পরীক্ষার জন্য তার লেখা এখন এখানেও পাওয়া যাচ্ছে। আত্মিক স্পৃহাই কি একজন কবিকে মহৎ করে? আর কিছু লাগে না? সূক্ষ্মতা, অন্তর্দৃষ্টি, সুষমা এবং সমকালকে বোঝার সমব্যথী চোখ- একজন কবিকে মহত্তর বলতে গেলে এসবও কি বিবেচনায় নেয়া উচিত না?

একজন হিন্দুকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ায় হতাশ হওয়া সহজ। কারণ তাকে যে লেখার জন্য পুরস্কার দেয়া হয়েছে তার পুরোটাই অনুবাদ। ”
Rabindranath-Tagore-in-sm
পুরস্কার পাওয়ার খবর ছাপানোর নয় দিন পর ২৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ বড় একটি লেখা ছাপা হলো পত্রিকাটির ম্যাগাজিন অংশে। এতে জানিয়ে দেয়া হলো যে নোবেল পাওয়া হিন্দু কবিটি নিজের দেশের বাইরে একেবারেই অপরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দেয়ার ঘোষণা যে মহাআশ্চর্যজনক এক খবর সেটা উল্লেখ করা হলো ওই লেখার শুরুতেই। তারপর বলা হলো তাকে পুরস্কারটা দেয়া মহা আশ্চর্যের এই কারণে যে এই লোক তো ইউরোপ ও আমেরিকাই পুরোই অপরিচিত। পত্রিকাটি যখন এই বিশেষত্ব তুলে ধরছে তার আগের বছর দেড়েক ধরে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথারে অবস্থাটা কী? ঠিক এর আগের বছরের জুন মাসে তার কবিতা প্রথম প্রকাশ হলো ইংল্যান্ডের ‘দ্য সাময়িকী’তে। জুলাইয়ে চারদিন- ১৩, ১৬, ২৬ ও ৩১ তারিখ- তার সম্পর্কে খবর ছাড়া হলো টাইমসে। এরই মধ্যে নভেম্বরের এক তারিখ বেরুলো ‘গীতাঞ্জলি’র ইন্ডিয়া সোসাইটির সেই সংস্করণ যা কিছুদিন পরই পুনর্মুদ্রণ করবে ম্যাকমিলান; এবং ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য তিনি পাবেন সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার। নভেম্বরের সাত তারিখে ইন্ডিয়া সোসাইটির গীতাঞ্জলির আলোচনা ছাপা হলো টাইমস সাহিত্য সাময়িকীতে।

ওইদিনই বইটির আলোচনা ছাপা হলো The Westminster Gazette-এ। এরপর নভেম্বরের ১৬ তারিখে একই সঙ্গে বৃটিশ দুই পত্রিকা The Athenaeum I The Nation-এ বইটির আলোচনা ছাপা হলো। আর ১৯১৩ সালে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বৃটেনের নয়টি পত্রিকায় ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে আলোচনা হলো, রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড যাওয়ার খবর ও তার নাটক নিয়ে আলোচনা হলো। বৃটেনে যখন এতো কিছু হচ্ছে আমেরিকানরা তার কিছুই খবর রাখছে না তখন!

রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ে- জয় শব্দটা পত্রিকাগুলোই ব্যবহার করছে- নোবেল কমিটির সমালোচনাও করছে পত্রিকাটি। তার নোবেল পাওয়ায় দুটি বিশেষত্বের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে : প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ কবিতাগুলি লিখেছিলেন বাংলা ভাষায়, প্রাচ্যের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী, মূলত প্রাচ্যেরই বিশাল পাঠকগোষ্ঠীর জন্য। দ্বিতীয়ত পরে সেগুলোকে ইংরেজি ভাষায় ভাষান্তর করা হয়। এরপরই নোবেল কমিটির সমালোচনা করে বলা হচ্ছে : বাংলা ভাষায় কবির বৈদগ্ধ্য ও দক্ষতা বিবেচনা করেই তাকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছে নোবেল কমিটি। তবে ঘটনা সম্ভবত যেটা ঘটেছে সেটা এই যে তার কবিতার ইংরেজি ভাষান্তরের ওপর নির্ভর করেই তাকে পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে।

এরপর ওই প্রতিবেদনে রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক বেশ কিছু তথ্য দিয়ে গোটাদশেক কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হয় তার The Gardener বইটি থেকে।

পশ্চিমে রবীন্দ্রনাথের অপরিচিতির খবর যখন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ তার ১১ মাস আগেই আমেরিকায় তার উপস্থিতির খবর প্রচার করেছে শিকাগোর ‘শিকাগো ডেইলি ট্রিবিউন’। পত্রিকাটি বলছে : ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি ও সঙ্গীতবিদ, শিকাগোয় একটা সপ্তাহ কাটাবেন মিসেস উইলিয়াম ভন মুডির অতিথি হিসাবে। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে পড়াশোনা করছে রবীন্দ্রনাথের ছেলে। গত এক মাস তিনি সেখানে আছেন। শিকাগোয় থাকবেন এক সপ্তাহ। ’ এই খবরের শিরোনাম কী করছে পত্রিকাটি? “ঠাকুর, বাঙালি কবি ও সঙ্গীতবিদ এই শহরে” (Tagore, Bengal Poet and Musician in City) শিরোনামের খবরে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবরও দিচ্ছে পত্রিকাটি : ‘তিনি ইউরোপের উদ্দেশ্যে গত জুনে ভারত ছাড়েন। ’ পত্রিকাটি এও জানিয়ে দিচ্ছে যে কবিতাপত্রিকা পোয়েট্রির ডিসেম্বর [১৯১২ সালের ডিসেম্বরে] সংখ্যায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে; এবং সেটাই তার আমেরিকায় প্রথম প্রকাশ। ২১ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হচ্ছে, পরের সপ্তাহে রবীন্দ্রনাথ নিউ ইয়র্কে ফিরে যাবেন। সেখান থেকে যাবেন লন্ডন, তারপর ভারত।

এসব সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার ১০ দিন পর (২৩ নভেম্বর, ১৯১৩) নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে তিনি পশ্চিমে পুরোই অপরিচিত। অথচ বৃটেনের টাইমস বুক রিভিউতে রবীন্দ্রনাথের কোন বই নিয়ে আলোচনা ছাপা হলো তা ঠিকই জেনে যাচ্ছে পত্রিকাটি, জানাচ্ছে তার পাঠককেও; এবং তা ঘটছে নোবেল পাওয়ার পর; নোবেল পাওয়ার আগে পত্রিকাটি টের পেত না ইউরোপে কোথাও নতুন কোনো কবিকে নিয়ে কোনে আলোড়ন হচ্ছে কি-না!

নভেম্বরের ৩০ তারিখেই অবশ্য তাকে অখ্যাতির গহ্বর থেকে আমেরিকায় দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ছাপা হচ্ছে এক আলোচনা যেখানে তাকে তুলনা করা হচ্ছে আমেরিকার মহান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের সঙ্গে। বলা হচ্ছে পূর্ব আর পশ্চিম কখনো মিলবে না। তবু এই কবিকে পড়তে গিয়ে মহত্বের দিক দিয়ে মনে পড়ে যায় আরেক মহৎ কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানকে। রবীন্দ্রনাথের দুটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচক বলছেন : তার কবিতায় মানুষের আত্মা নিরাবরণ হয়ে উন্মোচিত হয়; আর যখন তা ঘটে তখন সেই আত্মা না পুবের না পশ্চিমের; আর এই তো সেই মহান বাণী যা কবিতার পক্ষে পৌঁছে দেয়া সম্ভব।

তবে গোটা আমেরিকা তো আর নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো নয়। তাই দেখা যাচ্ছে ডিসেম্বরের ২ তারিখেই ছাপা হচ্ছে তাদের ওই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ। জোসেফ কামার্লি নামের এক পাঠক পাঠাচ্ছেন সেই প্রতিবাদ। সেখানে তিনি কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতি (Rabindranath Tagore’s Fame) শিরোনামে সম্পাদক বরাবর লেখা ওই প্রতিবাদে পাঠকটি বলছেন : আপনার পত্রিকার ম্যাগাজিন বিভাগে একটা শিরোনাম দেখলাম। তাতে বলা হচ্ছে ভারতের বাংলার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দেশের বাইরে অপরিচিত। আমি ঐকান্তিকভাবে আশা করি যে এটা একটা ছাপার ভুল। তার যথোচিত প্রতিভার মূল্যায়ন হিসাবে নোবেল পুরস্কার দেয়ার বহু আগেই ইউরোপের সাহিত্য ও দর্শনের জগত, বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও জার্মানি, এই প্রতিভা সম্পর্কে জানত। ঠিকমতো বলতে গেলে আপনি বলতে পারেন যে তিনি এই আমেরিকায় অপরিচিত ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।

৩.

Chester-Williams-sm

১৯৪১ সালের ৮ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে দুটি লেখা ছাপা হয়েছিলো নিউ ইয়র্ক টাইমসে। একটি হলো খবর, রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। অন্যটি সম্পাদকীয়।

খবরটার শিরোনাম ধীমান পাঠকের জন্য আগ্রহোদ্দীপক : TAGORE DIES AT 80; NOTED INDIAN POET। ১৯৪১-এ এসে রবীন্দ্রনাথকে আর হিন্দু কবি বলা হচ্ছে না। তবে তাকে কবিও বলা হচ্ছে না কিন্তু। পত্রিকাটির ভাষায় তিনি ‘উল্লেখযোগ্য ভারতীয় কবি’। এবং শিরোনামটি লক্ষ্য করলে দেখা যায় কবি রবীন্দ্রনাথ মারা যাননি; মারা গেছেন রবীন্দ্রনাথ নামে এক ভদ্রলোক যিনি ভারতের উল্লেখযোগ্য কবি। খবরে এও জানানো হচ্ছে যে বাংলায় তিনি এক বিশাল জমিদারির মালিক।

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টিতে তার খ্যাতির পতনের কথা উল্লেখ করে এর কারণ খোঁজার একটা চেষ্টা আছে। এতে বলা হয় : ‘৮০ বছর বয়সে মারা যাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতি কৌতূহলোউদ্দীপকভাবে তার জীবদ্দশাতেই বিবর্ণ হয়ে যায়। বছর ত্রিশেক আগে স্যার উইলিয়াম রোদেনস্টেনি ও ডব্লিউ বি ইয়েটস ঠাকুরের লেখার একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন নজর কাড়ার মতো একটি প্রতিকৃতিসহ। তার খ্যাতির জোয়ারে সুবিধাটা কে নিয়েছিলেন, তিনি নাকি তার প্রকাশক?

খুব দ্রুত তার বই বেরিয়েছিলো একের পর এক। নোবেল পুরস্কার তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। ... ভঙ্গি এবং চিত্রকল্পের একঘেঁয়েমি, অধিবিদ্যা (মেটাফিজিক্স) ও অতীন্দ্রিয়তার (মিস্টিসিজম) চাপ, অতিরিক্ত গীতিকবিতা, নাটক, উপন্যাস, এবং যতো রকম লেখা সম্ভব সমস্ত রকমের বই প্রকাশ এসব কারণেই কী তার খ্যাতি ক্ষয়ে যায়?

যেকোনো হিসেবেই তার সূর্যালোক বদলে গিয়েছিলো চন্দ্রালোকে। হতে পারে এটা ফ্যাশনের একটা অবিচার, কিন্তু অনুবাদগুলি, যা সাধারণত তিনি নিজেই করতেন, স্মরণ করলে মনে হয় না যে, ভঙ্গি বা উদ্দীপনার ক্ষেত্রে ওগুলির ঘাটতি ছিলো? এই হলো সংকলনগুলির শেষ পরিণতি। ঠাকুরের অগণিত বই থেকে যৌক্তিকভাবে কিছু বাছাই করা হলে তা হয়তো কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে তার খ্যাতি পুনরুদ্ধারে। ’

এই অভিযোগ মেশানো মন্তব্য করছে যে পত্রিকা সেই তো নোবেল পাওয়ার এক বছর পর রবীন্দ্রনাথকে ঠেলে দিয়েছিলো আধ্যাত্মবাদের জগতে। যে-জগতে মানুষের চেয়ে কবিতার চেয়ে অপার্থিব এক অস্তিত্বই বড়ো; যে-অস্তিত্ব মানুষকে পৃথিবীতে ধরে রাখে। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫তে প্রকাশ হলো রবীন্দ্রনাথের করা কবীরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ, একই সময়ে বেরুলো তার নিজের The king of the Dark Chamber। এই দুই বইয়ের আলোচনায় টাইমসের আলোচক জানিয়ে দেন যে রবীন্দ্রনাথ আর ‘মিস্টিক’ কবীর একই পথের যাত্রী হলেও তিনি তার অনুকারক নন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ একজন বড় মাপের কবি বটে, তবে তিনি ‘মিস্টিক’ কবি। এবং ওই আলোচনার সমাপ্তি টানা হচ্ছে খোদ খ্রিস্ট ধর্মের ধর্মপুস্তক বাইবেলের সঙ্গে ওই দুজনকে আধ্যাত্মবাদের সম-উপযোগিতায় ফেলে! : “The likeness between the doctrines of the two Indian seers and that of the Gospels is very striking. Kabir’s Lord and Tagore’s King of the Dark Chamber are equally the unknown God to whom the ancient Athenians raised an alter; the same when the Gospel according to St. Jhn names as the Spirit of Truth.Whom the world cannot receive, because it seeth Him not, nether Knoweth Him; but ye know Him : for He dwelleth with you, and should in you.”

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এই বিধ্বস্ত অবস্থায় পার্থিব পৃথিবীর দুর্দশা থেকে পালাতে তথাকথিত আধ্যাত্মবাদই ভালো। কিন্তু ঈশ্বরের আস্থায় যে-আধ্যাত্মবাদ সে তো মেনে নিতে পারে না পশ্চিম, পশ্চিমের মানুষ তাই তারই কাছাকছি কোনো মানুষকে যদি আধ্যাত্মবাদের আলখাল্লা পরিয়ে নিয়ে নিজেদের পালানোর পথটা তৈরি করা যায় সেই তো ভালো। তাই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে লাগলেন, আমেরিকার কাছে, মিস্টিসিজমের পোক্ত ধ্বজ্জাধারী; সাথে রইলো কবীরের  উদাহরণ।

৪.

TAGORE-smঅবশ্য এ জন্য শুধু পত্রিকাটিকে দোষ দেওয়াও হয়তো ভুল হবে। কেননা এক্ষেত্রে ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে বেরুনো রবীন্দ্রনাথের দুটি ইংরেজি বইয়ের ভূমিকাও কম নয়। একটি লিখছেন আর্নেস্ট রিস, অন্যটি লিখছেন বসন্ত কুমার রায়। তখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজিভাষীদের জানারও পথ ছিলো ওই জীবনী দুটিই। দুটি জীবনী মিলিয়ে একটি আলোচনা ছাপা হয় নিউ ইয়র্ক টাইমসে। সেই আলোচনায় বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন সম্পর্কে পাঠকদের জানান আলোচক। সেই আলোচনায় কবি রবীন্দ্রনাথের কোনো হদিস নেই। যদিও তিনি নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিলেন তার কবিতার জন্য।

যাকে নিয়ে জীবনী সেই লোকটি জীবন্ত আমেরিকায় এলেন পরের বছর। তার সাক্ষাৎকার ছাপা হলো নিউ ইয়র্ক টাইমসে। জীবনী দুটিতে যেখানে তাকে কবি পরিচয় অতিক্রম করে চিন্তাবিদ দার্শনিক, সমাজ-সংস্কারক ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা (এবং সেখানেই রবিখ্যাতির পতনের বীজ বপন) সাক্ষাৎকারে ঠিক তা ছিলো না। এতে কবির সঙ্গেই কথা বলছেন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী। সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সমাজের সঙ্গে কবির কী সম্পর্ক  সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা রবীন্দ্রনাথেরই মুখ থেকে শোনা।

সেই সাক্ষাৎকারে তার কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, কবির কি লেখালেখি করে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত, নাকি অন্য কোনো উপায়ে নির্ভর করবেন তিনি? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘নিজেদের কাজকে সত্যি করতে হলে কবি ও শিল্পীদের বিপুল অবসর প্রয়োজন। ফলে নিজেদের কাজের বাইরে জীবিকার জন্য যেকোনো ধরনের সংযুক্তি তাদের জন্য বিধ্বংসী। অন্যদিকে জনগণের কৃপার ওপর নির্ভর করতে যাওয়াটাও, যারা কিনা কখনোই শিল্পের নতুন ধরনের সৃষ্টির সেরা সমঝদার নয়, এক মারাত্মক ধরনের অপকর্ম। তবে দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টাই তুলনামূলক কম খারাপ। ’ এখানেই তিনি কথা প্রসঙ্গে পশ্চিম ও পুবের কবিদের ভাবগত মিল বিষয়ে বলছেন। বলছেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা আমেরিকান হয়েও তো পুবের ধারণা ও অনুভূতিকে ধারণ করে। পার্সি বিসি শেলি ও ওয়ার্ডসওয়র্থের কবিতাও তো স্পিরিটের দিক দিয়ে পুবেরই ঘরানার।

এ সাক্ষাৎকারেই পশ্চিমে মুক্ত গদ্যে কবিতাচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সবশেষে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী পাঠককে মনে করিয়ে দেন যে ইয়েটস ও তার মতো আরো কিছু লোক কবি রবীন্দ্রনাথকে মহান একজন মিস্টিক ও বিরাট এক অধ্যাত্মবাদী গুরু বলে মনে করেন!

৫.

এরপর এলো ১৯১৮ সাল। সে বছর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে খবর ছাপা হলো নিউ ইয়র্ক টাইমস ও শিকাগো ট্রিবিউনে। তবে তার সঙ্গে সাহিত্যের কোনো যোগ নেই। আন্তরাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের লিপ্ত থাকা নিয়ে খবর বেরুলো। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে ছাপা হলো সেই খবর। খবরে জানানো হলো ব্রিটিশ ভারতে বিদ্রোহ সংগঠনে জার্মানির উস্কানি আর তাতে জাপান ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনাথের যুক্ত থাকার কথা। খবরটি কোনো পত্রিকার নিজের বানানো নয়; স্বয়ং আমেরিকার সরকার বিষয়টি সাধারণের গোচরে আনার জন্য প্রকাশ করেছে! দুটি পত্রিকাই এই কথা দিয়েই খবরটি শুরু করেছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে : “সরকারের প্রকাশ করা নথিতে দেখা যাচ্ছে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি কিনা ব্রিটিশ নাইট এবং কবিতার জন্য নোবেল পুরস্কারজয়ী, ভারতে স্বাধীন একটা সরকার প্রতিষ্ঠায় কাউন্ট ওকুমা এবং তেরাউচির আগ্রহে সমর্থন দিয়েছেন। তবে যে-চিঠিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো ওকমা এবং তেরাউচির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকের যোগাযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করে না। ”

চিঠি থেকে উদ্ধৃতিও দেয়া হচ্ছে : “স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের পরামর্শের সঙ্গে একমত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ওকুমা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কাউন্ড তেরাউচি এর পক্ষে। স্যার রবীন্দ্রনাথও জাপানের অনুল্লেখযোগ্য কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। ”

রবীন্দ্রনাথকে এই আসামী বানিয়ে ছাপানো খবরের পরবর্তী কোনো খবর আর ছাপেনি নিউ ইয়র্ক টাইমস।

৬.

Helen-Keller-With-tagore-sm১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার/সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন ছাপায় ব্যস্ত ছিলো নিউ ইয়র্ক টাইমস। তবে কোনো সাক্ষাৎকারই কবিতাকে ঘিরে বা ভিত্তি করে নয়। ২৭ জুন ছাপা হওয়া খবরে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ইউরোপের দুর্দিনে আমেরিকার কাছ থেকে নেওয়ার মতো কিছুই নেই। আমরা প্রশাসনিকভাবে অন্যের অধীনে থাকলেও আমেরিকানদের তুলনায় আত্মিক দিক দিয়ে অনেক অনেক বেশি স্বাধীন।

১৭ অক্টোবর ছাপা হচ্ছে লন্ডনে নেয়া সাক্ষাৎকার। সেখানে কবি ধুয়েমুছে দিচ্ছেন আমেরিকাকে। মিস্টিক বানিয়ে ছেড়ে দেয়া রবীন্দ্রনাথকে, যার সঙ্গে খ্রিস্টীয় মিস্টিসিজমের মিল খুঁজে পেতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি আমেরিকানদের, জিজ্ঞেস করা হচ্ছে খ্রিস্টীয় সভ্যতা সম্পর্কে তিনি কী মনে করেন? কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলছেন, ‘পুরো এশিয়ায় ইউরোপ বিস্ময়করভাবে তার সম্মান হারিয়েছে। এশিয়া মনে করে আত্মিকতার দিক দিয়ে ইউরোপের এশিয়াকে কিছুই দেয়ার নেই। এশিয়া মনে করে ইউরোপ এখন সত্যি বলে না। ’ সাক্ষাৎকারটিতে রবীন্দ্রনাথ এমনও বলছেন যে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে গিয়ে স্বয়ং যিশুও যদি এখন গরিবের পক্ষে কথা বলেন তবে তাকে জেলে পাঠানো হবে। সাক্ষাৎকারটি যখন নেয়া হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তখন লন্ডনে।

এরপর সাক্ষাৎকারভিত্তিক খবর ছাপা হলো ২২ নভেম্বর। তাতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, আমেরিকার মানুষজন শুধু ব্যবসার পেছনে ছুটছে, ওদের তো বাঁচারই সময় নেই। ওরা পূর্ব ভারতীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি ওদের ব্যবহার খুব খারাপ। আমেরিকা মারাত্মক রকমের আগ্রাসী স্বার্থপর। এই খবর ছাপা হচ্ছে ‘আমেরিকার সমালোচনায় টেগোর’ শিরোনামে।

৭.
১৯৪১ সালের ৮ অগাস্ট রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর নোবেলজয়ী এই কবির নামযশ ইংরেজিভাষী পশ্চিমে হারিয়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে সম্পাদকীয় ছেপেছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস। সেখানে নানা সম্ভাব্য কারণের কথা উল্লেখ করলেও এক্ষেত্রে পত্রিকাটির ভূমিকা কী ছিলো তার কোনো উল্লেখ নেই সেখানে। রবীন্দ্রনাথের নানা বইয়ের আলোচনা, তার সাক্ষাৎকার যে-কৌশলে যে-দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে-ধরনের শিরোনাম দিয়ে পত্রিকাটি ছেপেছিলো তার কি কোনো ভূমিকা ছিলো না মানুষের মনে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে? যদি থাকে, আর তা থাকাই স্বাভাবিক, তাহলে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ হওয়া লেখাগুলি কী বলে তা পাঠকমাত্রই বোঝার কথা; যদি তিনি হন রবীন্দ্রনাথের পাঠক, আর যদি সেই  পাঠকের মন হয় কবিতার মতো সংবেদনশীল।

বাংলাদেশ সময় ২১৩০, আগস্ট ০৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।