ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শিল্পী আমিনুল ইসলামের অপ্রকাশিত লেখা

আমার মধ্যপর্বের জীবন : কলকাতা ১৯৫৮

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১১
আমার মধ্যপর্বের জীবন : কলকাতা ১৯৫৮

[বাংলাদেশের চিত্রকলার অগ্রপথিক শিল্পী আমিনুল ইসলাম। ৮ জুলাই প্রয়াত হয়েছেন।

‘বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর’ নামে তার একটি বই আছে। বইটি প্রকাশ করেছিল শিল্পকলা একাডেমী। তিনি সেই বইতে উল্লেখ করেছিলেন ইতালি থেকে ফেরত আসার পরের অংশ তিনি লিখবেন। তার লেখার ইচ্ছে ছিল ১৯৫৬ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত স্মৃতিচারণ। লেখা শুরুও করেছিলেন। লিখতে পেরেছিলেন ৭১ সাল পর্যন্ত।

ওই সময়ের মধ্যের লেখা পাঠ করতে গিয়ে জানা যায়, ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি তার কয়েকজন শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলেন কলকাতাতে সেখানকার শিল্পজগৎ সম্পর্কে জানতে। তার বই আকারে প্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি থেকে কলকাতা ভ্রমণের সেই অপ্রকাশিত অংশটুকুন পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো। ]

আমার ইচ্ছা ছিল দেবদাস অথবা বিজন আমার সঙ্গে যাবে- যেহেতু ওদের দু’জনেরই কলকাতার শিল্পীদের অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল ঢাকায় আসার আগে থেকেই। কিন্তু দু’জনই ব্যস্ত ছিল নতুন বছরের বই প্রকাশনার জন্য প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন করার ব্যাপারে। অর্থাৎ তারা যেতে পারবে না। প্রথমেই সৈয়দ জাহাঙ্গীর যেতে রাজি হলো সঙ্গী হিসেবে, তারপর নিতুন কুণ্ডু ও কাইয়ুম চৌধুরী। কাইয়ুম তার পূর্ব পরিচিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের হেডলির এখানে থাকতে পারবে বলে জানাল। সে সময় সবারই প্রায় কোনো হোটেলে থাকার সামর্থ ছিল না। আমরা চারজন ১৯৫৮-এর ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে কলকাতা যাত্রা করলাম প্লেনেই, যেহেতু ট্রেন-বাসে যাতায়তের ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল না।

আমরা সবাই বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সত্যজিৎ রায়ের বাসায়। তিনি বাসায়ই ছিলেন। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি শুনে সত্যজিৎ রায় সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আমার কাছে ইতালির সিনেমা জগৎ সম্বন্ধেও বিস্তারিত জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন স্বাভাবিকভাবেই।

যাওয়ার আগে ভড়রাকে জানিয়েছিলাম আমাদের শুধু থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে কি-না। উত্তরে জানিয়েছিল ওটা কোনো প্রবলেমই নয়। ওর বাসার কাছেই ওদের ফার্মের একটা গেস্ট হাউস আছে। ওখানে ব্যবস্থা করে রাখবে এবং ওর ঠিকানাও দিয়েছিল যাথারীতি। এয়ারপোর্ট থেকে আমরা সবাই ওই ঠিকানায় পৌঁছে যাই সন্ধ্যার কিছু আগেই। ভড়রা ছিল আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য। বিরাট তিনতলা বাড়ি। ওর দোতলায় বড় বড় হলরুমে ঢালাও বিছানা পাতা। সেখানে অনেক লোক শুধু রাত কাটায়। ভড়রাদের পূর্ব ভারতের অনেক এজেন্ট আসে দু’চার দিনের জন্য ব্যবসায়িক কারণে। খাবার ব্যবস্থা নেই- সকালে শুধু প্রচুর দুধসমেত মারোয়াড়ি চা আর ডালপুরি অথবা বনরুটি। ভড়রা জানত আমার খাওয়ার কোনো বাহুল্য নেই, ইউরোপের ইয়ুত হোস্টেলে থাকার বিচিত্র অভিজ্ঞতাও আছে। কাইয়ুম তার পূর্ব  পরিকল্পনামতো হেডলির ওখানে চলে গেল। আমাদের যৎসামান্য কাপড়-চোপড়ের ব্যাগটা রেখে ওই ঢালাও বিছানার একটা কোণে বসে আড্ডা জমালাম একপ্রস্থ চা ও ডালপুরিসহ। আমি জাহাঙ্গীর ও নিতুনকে ভড়রা সম্বন্ধে বিচিত্র অভিজ্ঞতা জানালাম। কলকাতাবাসী মারোয়াড়ি হলেও তারা অনেকটাই বাঙালি হয়ে গেছে। একদা জাদুকর পিসি সরকারকে নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শো করে ঘুরেছে অরগানাইজার হিসেবে।

কিন্তু ব্যবসায়িক সাফল্য খুব একটা হয়নি। পরে বর্তমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে আর এক মারোয়াড়ি বন্ধুর সঙ্গে ইতালিতে ছিল দু’বছর। ফ্লোরেন্সের খুব কাছে প্রাতো নামে ছোট্ট একটা শহরে থাকত এবং আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সস্তা কম্বল রফতানি করত। কিছুদিন আগে ফিরে এসে ওদের হেড অফিসে যোগ দিয়েছে। ইচ্ছা আছে কলকাতায় সিরামিক ফ্যাক্টরি দেবে এবং ফ্লোরেন্সের বন্ধু জন ফ্রেঞ্চকে নিয়ে আসবে প্রাথমিক পর্যায়ে সাহায্য করার জন্য। পরে জন এসেছিল  ১৯৫৮ সালে এবং আমার পরামর্শমতো প্রভাস সেন ও ভড়রার সঙ্গে স্টুডিও সিরামিকের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছিল। এছাড়াও বেশকিছু সিরামিক দ্রব্যসামগ্রী বাজারজাত করার ব্যবস্থাও করেছিল; কিন্তু ওই সময়ে বাণিজ্যিক সাফল্য সহসাই তারা করে উঠতে পারেনি। এরই মাঝে জন ১৯৫৮ সালে শেষের দিকে এক সময় ঢাকায়ও এসেছিল তার কলকাতায় করা কিছু কাজ নিয়ে। আমি কিছু কিনেছিলাম এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলাম। জনের ইচ্ছা ছিল সুযোগ পেলে ঢাকায় একটা সিরামিকের ফ্যাক্টরির ব্যবস্থা করা যায় কি-না। জয়নুল আবেদিন স্যারের ইচ্ছা থাকলেও সরকারি সমর্থন সহসা পাওয়ার কোনো আশা নেই জেনে, তখনকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রধান আজিজুল হক সাহেবকে বিষয়টি বলেছিলাম। তারও তখন একই বক্তব্য ছিল। দু’একজন ইন্ডাস্ট্রি করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির সঙ্গেও জনকে নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু তাদেরও ইচ্ছা ছিল বড় করে দৈনন্দিন ব্যবহার্য প্লেট, চায়ের কাপ ইত্যাদি তৈরি করার স্টুডিও সিরামিকের দিকে কোনো ঝোঁক ছিল না।

Aminul ismal
দ্বিতীয় জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সাদেকাইন ও মুর্তজা বশীরের সঙ্গে আমিনুল ইসলাম, করাচি, ১৯৫৮

ভড়রাদের গেস্ট হাউসটা ছিল ক্যামাক স্ট্রিটে। সন্ধ্যার কিছু পর আমরা তিনজন কাছেই নিউমার্কেট ও পার্ক স্ট্রিট এলাকায় রাত দশটা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করে আমজাদিয়ায় বিরিয়ানি খেয়ে গেস্ট হাউসে ফিরেছিলাম পরদিন আর্ট স্কুলের প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে। সকালে নাশতা খেয়ে আমরা বের হলাম আর্ট স্কুলের উদ্দেশে। এর মধ্যে কাইয়ুমও চলে এসেছিল আমাদের সঙ্গেই থাকবে বলে। সাড়ে দশটার দিকে আমরা চলে গেলাম প্রদর্শনী দেখতে। যথারীতি হতাশ হলাম ছাত্রদের কাজ দেখে। আমাদের ছাত্রদের মতই গতানুগতিক প্রাধান্য- জলরঙের ল্যান্ডস্কেপ। দৈনন্দিন জীবন নিয়ে কিছু কম্পোজিশন এবং প্রতিকৃতিও ছিল মুখ্য বিষয়। কারিগরি দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ দেখতে পাইনি। শিক্ষকদের কাজও ছিল না ওই প্রদর্শনীতে। তবে কমার্শিয়াল বিভাগের কাজ ছিল উন্নত মানের। ওই সময় স্কুল বন্ধ ছিল বলে খুব বেশি ছাত্রদেরও দেখা মেলেনি। শিক্ষকদের মধ্যেও সবাই ছিল অনুপস্থিত। আমাদের মতোই সবাই মনমরা হতাশাগ্রস্ত।

আর্ট স্কুলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম স্তালীগঞ্জ অভিমুখে পরিতোষ দার বাসায়। সৌভাগ্যক্রমে উনি বাসায়ই ছিলেন, আমাদের সাদরে আহ্বান করলেন এবং ঢাকার কথা, বিশেষ করে মুর্তজা বশীর এবং আবেদিন সাহেবের কথা জানতে চাইলেন। আমি সম্প্রতি ফ্লোরেন্স থেকে এসে ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করছি শুনে বর্তমানে ইউরোপিয়ান শিল্পধারা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা করলেন এবং বললেন,  আপনারা ভাগ্যবান,  নতুন স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন কিছু করার অনেক সুযোগ পাবেন যদি আপনি নিজে উদ্যোগ নেন। কলকাতা স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা শতাব্দী প্রাচীনকাল, এর কোনো সংস্কার সহসা সম্ভব নয়। আমি লন্ডনে আবেদিন সাহেবকেও একই কথা বলেছিলাম সেই ১৯৫১ সালেই। কিন্তু তখনকার সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাই শিল্পকলা শিক্ষা কেন্দ্রে আধুনিকতার প্রধান বাঁধা। ছাত্র শিল্পীদের জীবিকার প্রশ্নই সবার আগে উঠে আসে। এখানেও কেউ শুধু ছবি এঁকে চলতে পারে না- আপনাদের তো আরো বেশি সমস্যা নিশ্চয়ই। এসব আলোচনার আগেই আমরা পরিতোষ দার ছবি দেখতে চাইলে তিনি জানালেন, এই ছোট ঘরে ছবি আঁকা হয় না বিধায় আমি অনেকদিন থেকেই আমার চাকরিস্থল গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউটেই ছবি আঁকছি, আর আমার সব ছবি ওখানেই। ছবি দেখতে চাইলে ওখানেই যেতে হবে। আমরা একটি দিন ঠিক করলাম ওখানে গিয়ে ছবি দেখতে। ওই পর্যায়ে উনি বললেন, চলুন সত্যজিৎ বাবুর বাসায় যাই। তিনি খুব কাছেই থাকেন আর আমার বিশেষ বন্ধুও বটে। ইতিমধ্যে আমি ফ্লোরেন্সের একটা ফিল্মক্লাবে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি দেখে এসেছি, আর এ সুবাদে আপনার মতামত জানতে সত্যজিৎও উৎসাহিত হবেন।

pother pachaliআমরা সবাই বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সত্যজিৎ রায়ের বাসায়। তিনি বাসায়ই ছিলেন। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি শুনে সত্যজিৎ রায় সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আমার কাছে ইতালির সিনেমা জগৎ সম্বন্ধেও বিস্তারিত জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন স্বাভাবিকভাবেই। আমিও ইতালির পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত পরিচালকের যেসব ছবি দেখেছি তাদের কথা বলে গেলাম এবং আমার বন্ধু রবিউদ্দিন ও বরীনের সংবাদ দিলাম। ডিসিকার সঙ্গে কাজের ফিরিস্তি এবং সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ যা কিছুদিন আগে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখানো হয়েছে এবং প্রশংসিত হয়েছে। এমনকি আমিও অনেক বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ফ্লোরেন্সেই দেখেছি শুনে সত্যজিৎ আগ্রহভরে আমার অভিজ্ঞতা শুনে গেলেন মনোযোগ সহকারে। ইতিমধ্যে বৌদি চা-মিষ্টি পরিবেশন করে গেলেন। আমরা সবাই সত্যজিতের বই এবং অসংখ্য রেকর্ড সংগ্রহ দেখে বিস্মিত। তার বিদেশি এবং দেশি সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহে সবিশেষ মুগ্ধ হলাম। এদিকে বেলা প্রায় দেড়টা বাজে। আবার দেখা হবে বলে সেদিনের মতো সত্যজিতের বাড়ি থেকে বিদায় নিলাম।

পথে নেমেই পরিতোষ দা বললেন, আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। চলুন, কাছেই একটা মাদ্রাজি দোকান আছে, আর আমিও মাদ্রাজ আর্ট স্কুলের ছাত্র অবস্থায়ই মাদ্রাজি খাবারের ভক্ত হয়ে গেছি। ওদের দোসা খুবই উপাদেয় আর সস্তাও। আমরা সেদিনের মতো দোসা দিয়েই দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করলাম। ওই দিনই আমার প্রথম দোসা খাওয়া। আমি খাদ্যবিলাসী না হলেও দোসা খুবই উপাদেয় মনে হলো। খেতে খেতে পরিতোষ দাকে কলকাতার কোন কোন শিল্পী একটু অন্য ধরনের কাজ করছে জানতে চাইলে একজনের নাম বললেন। তিনি একজন ল’ইয়ার। নাম সুনীল মাধব সেন। স্বশিক্ষিত হলেও আধুনিকতার অর্থাৎ কিছুটা এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় কাজ করছেন এবং বেশ কিছু কাজ কলকাতার অন্যান্য শিল্পীর তুলনায় ভালোই। আমরা তার ঠিকানা ও ফোন নম্বর জেনে নিলাম। কোনো একদিন যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম আবার একদিন তার ছবি দেখতে যাব বলে।

সেদিন সকালেই হেডলির বাসা থেকে কাইয়ুম আমাদের গেস্ট হাউসে চলে এসেছিল। পরিতোষদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে এলাম গেস্ট হাউসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে। সে বছর একাডেমী অব ফাইন আর্টসের কোনো প্রদর্শনী হয়নি। সুতরাং আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে নিতে কলকাতার শিল্পচর্চা নিয়ে আলোচনা-আড্ডা দিয়ে বিকেলের দিকে বের হলাম দেবদাসের একদা বন্ধু সুকান্ত আর অজিতের আস্তানার দিকে- ধর্মতলায় একটা পুরনো বাড়ির দোতলায় একটা ছোট্ট ঘরে। ওরা একসময় দেবদাসের সঙ্গে আর্ট স্কুলে পড়ত। এখন বেকার। মেস করে থাকে। সঙ্গে অরুণ বোস নামে আর এক শিল্পীর সঙ্গে। অজিত ভাস্কর; আর দু’জন ড্রয়িং-পেইন্টিং বিভাগ থেকে পাস করেছে। সবারই দারুণ অর্থকষ্ট। বেকার থাকলে যা হয়। ওরা ঢাকা থেকে আগত বিশেষ করে আমার ইতালির কাপড়-চোপড়, কথা বলার ঢং আর জাহাঙ্গীরের স্টাইলিশ পোশাকে কিছুটা অভিভূত।

যথারীতি বিজন ও দেবদাসের খোঁজ-খবর নিয়ে তাড়াতাড়ি আমাদের নিয়ে বের হলো ওদের দৈন্যদশায় কিছুটা কুণ্ঠিত হয়েই। শিল্পীদের ওই ধরনের অবস্থা ইউরোপেও আছে বলে তাদের আশ্বস্ত করে সবাইকে আমাদের সঙ্গে চা খেতে আমন্ত্রণ জানালাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রায় জিসিলাহার দোকানের কাছে এলাম এবং সুকান্তের পরামর্শ অনুযায়ী একটা চায়ের দোকানে ঢুকে কফি এবং ভেজিটেবল চপের অর্ডার দিলাম, মাংস খায় কি-না তা না জানা থাকায়। প্রথম থেকেই সুকান্তকে আমার ভালো লেগেছিল ওর কথাবার্তায়। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে আবার দেখা হয়েছিল দিল্লিতে। ও তখন ন্যাশনাল গ্যালারির রোস্টারেশন বিভাগে চাকরিরত; আর বিয়ে করেছিল এক অবাঙালি শিল্পীকে। উনি তখন ভারতীয় ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের অ্যাম্পোরিয়ামের কর্ণধার। সুকান্তের কাছেই জানতে পেরেছিলাম, অজিত শান্তিনিকেতনের ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষকতা করছে, আর অরুণ বোস আছে আমেরিকায়।

Aminul ismal
শিল্পী কিবরিয়ার সঙ্গে সর্ব ডানে আমিনুল ইসলাম, ১৯৫৯

পরিতোষদার ছবি দেখার উদ্দেশ্যে একদিন গেলাম টালিগঞ্জ এলাকায় গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউটে। সঙ্গে ছিল জাহাঙ্গীর। কাইয়ুম ও নিতুনে প্রথম কলকাতা দর্শন। সেজন্য ওরা সম্ভবত ব্যস্ত কলকাতার জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং চিড়িয়াখানা দেখতে। পরিতোষদা তার কাজ দেখালেন। অনেক বড় বড় ক্যানভাসের মধ্যে বেশ কিছু কাজ ছিল মন কাড়ার মতো। এগুলোর মধ্যে পুরনো কাজই বেশি। সদ্য করা কাজ প্রায় ছিলই না। আমাকে জানালেন, এদেশে এখনো ছবি বিক্রি প্রায় হয়ই না। বোম্বে এবং দিল্লিতে মাঝে মাঝে প্রদর্শনীতে অংশ নিই। বছরে দু’একটা ছবি বিক্রি হয় মাত্র। ছবি অনেক জমে যাচ্ছে- ভালোভাবে রাখা দায়। এই চাকরিটাই ভরসা। আমি ইদানীং এখানে শিক্ষকতা এবং রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার মতো বাংলা টাইপ উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানকার কয়েকটি ছাত্র আমাকে সাহায্য করছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়। আমাদেরও কিছু কিছু দেখালেন ওইসব অসম্পূর্ণ কাজগুলোর অংশ। বললেন, অনেক কাজ বাকি। বিশেষ করে যুক্তারক্ষরগুলোই প্রধান সমস্যা। এসব আলোচনা শেষে আমরা পরিতোষদাকে আবার কোনদিন আসব বলে বেরিয়ে এলাম।

তখন বেলা প্রায় ২টা; ক্ষিদে পেয়েছিল খুব। হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট খাবারের দোকান পেলাম- বিশুদ্ধ হিন্দু হোটেল। জাহাঙ্গীর বলল, এখানেই খেয়ে নিই। আমার আপত্তি ছিল না। দু’জনেই মাটিতে বসে কলাপাতায় খেতে বসলাম- মাছ, সবজি আর ডাল দিয়ে। কাঁসার বাটি ও গ্লাস। এক পর্যায়ে আমি বাঁ হাত দিয়ে পানি খেতেই জাহাঙ্গীর বলল, আরে করেন কী? ডান হাত দিয়ে গ্লাস ধরুন। না হলে আমরা মুসলমান হিসেব চিহ্নিত হয়ে গেলে বিপদের সম্ভাবনা অনিবার্য। যাহোক, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলাম ভালোভাবেই এবং একটা বাস ধরে অ্যাসপ্লানেডে চলে এলাম। আমাদের রেস্ট হাউসে এসে দেখি, আতিকুল্লাহ আর জুনাবুলও এসে উঠেছে এখানেই। ডররা ওদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আতিকুল্লাহর ইচ্ছে শান্তিনিকেতনে যাবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গই ওর প্রিয় হয়ে উঠল। আর সম্ভবত কলকাতায় বিষ্ণু দের মত প্রমুখ কয়েকজন কবির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা। পরীক্ষার ফি জোগাড় হয়নি বিধায় সে গতবার এমএ পরীক্ষা দিতে পারেনি। এবার হাসান ওকে টাকা দিয়ে বলেছে, এবার পরীক্ষাটা যেন দেয়। আতিকুল্লাহ পরীক্ষার ফি না দিয়ে ওই টাকায় এসেছে কলকাতার কবিদের সঙ্গে পরিচিত হতে এবং শান্তিনিকেতন দেখতে।

এর মধ্যে আরো একদিন আর্ট স্কুলের প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিন আমরা অধ্যক্ষ এবং অন্য কোনো শিক্ষকের দেখা পাইনি একমাত্র গোপাল ঘোষ ছাড়া। ওনার ছবি দেখতে চাওয়ায় আমাকে ঠিকানা দিয়ে জানালেন, একদিন সকালে এলেই আমাকে পাবেন। আগেই শোনা ছিল, উনি আজকাল প্রায়ই অসুস্থ থাকেন এবং বেশ পাগলামিও করেন। ছবি আঁকেন আগের মতোই। জলরঙের স্কেচ। ওইসবের মধ্যেও রেখার টানে তার মানসিকতা টের পাওয়া যায়। আমরা দল বেঁধে গিয়েছিলাম একদিন ওর পুরনো কাজ দেখব বলে। কিন্তু উনি কাজ না দেখিয়ে আমাদের ওর ছোট্ট বাগানে নিয়ে গেলেন এবং তার গাছের ফুল ও অর্কিডের বাহার দেখিয়েই বিদায় দিলেন। তাকে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ মনে হলো।

এদিকে, ২৫ ডিসেম্বর ভোরে আমাকে এবং জাহাঙ্গীরকে দুপুরে তার বাসায় দাওয়াত দিয়েছিল ওর অ্যাপার্টমেন্টে। আমি জীবনে এত ধরনের ভেজিটেরিয়ান রান্না খাইনি এর আগে। খাওয়ার পর তার স্ত্রীকে অনেক প্রশংসা করে প্রায় বিকেলের দিকে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরই কাইয়ুমরা সবাই ফিরে এলো। ঠিক হলো, রাত ৯টায় পার্ক স্ট্রিট এলাকায় ক্রিসমাস পালন উপলক্ষে কলকাতার খ্রিস্টান ও উচ্চবিত্তদের খানাপিনা এবং আনন্দ-উৎসবের ধারণা নেব। আতিকুল্লাহ আর জুনাবুল সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আর আমরা চারজন বেরুলাম নিউমার্কেট ও পার্কস্ট্রিট অঞ্চলে টহল দিতে এবং রাতের খাবার খেতে। আমাদের সবারই পকেট সংকুচিত। সুতরাং কোনো বার অথবা নাইট ক্লাবের মতো বড় রেস্তোরাঁয় না ঢুকে একটা ছোটখাটো বারে বসে এক বোতল করে বিয়ার খেয়েই ক্রিসমাস পালন করেছিলাম এবং কিছু ফুল কিনে ফিরে এসেছিলাম রাত ১২টার কিছু পরে।

কলকাতার আর্ট স্কুলে মুকুলদের পরে কয়েক বছর রমেন চক্রবর্তী অস্থায়ী অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করে দিল্লী পলিটেকনিকের গ্রাফিক্স বিভাগে চলে যান এবং পরবর্তীকালে ১৯৪৮ সালের কিছু পূর্বে অধ্যক্ষ হিসেবে অতুল বসু নিযুক্তি পান। কিন্তু ওই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার আমলেই অনেক ছাত্র বহিষ্কৃত হন- ওর মধ্যেই ছিল বিজন ও দেবদাস। আর সোমনাথ হোড়কে তো জেলেই যেতে হয়েছিল। জেল থেকেই শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে আমরা যখন কলকাতা যাই, তার আগেই অতুল বসু চাকরিতে অব্যাহতি নিয়ে যাওয়ার পর আবার রমেন চক্রবর্তী অধ্যক্ষের পদে যোগ দেন। ওনার অবসর গ্রহণের পর বেশ কয়েক বছর কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তী অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেলেন চিন্তা মনিকর। উনি অনেক বছর, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে স্কুলের শিক্ষাক্রমে পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে গেছেন। কলেজ পর্যায়ে ডিগ্রির ব্যবস্থা সরকারি অনীহার কারণে করে উঠতে পারেননি। কিন্তু ১৯৬৪ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলের শতাব্দী পূরণে উপযুক্তভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্কুলের ইতিহাস নিয়ে একটি সারগর্ভ পুস্তিকাও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন, যা আমি ওনার কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে।

Aminul ismal
নাট্যকার সাঈদ আহমেদ ও শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে আমিনুল ইসলাম, ১৯৯৪

২৫ ডিসেম্বরের পর আমরা একদিন গিয়েছিলাম পরিতোষদার দেওয়া ঠিকানায়। গেলাম ওই অ্যামেচার শিল্পী সুনীল মাধব সেনের বাসায় তার ছবি দেখতে ও পরিচিত হতে। বেশ ভালো লাগল তার ছবি, ব্যবহার এবং ছবি সম্বন্ধে তার স্বচ্ছন্দ আলোচনা। আজকের কলকাতার শিল্পীরা তার নামটাও ভুলে গেছে সম্ভবত। এরপর কয়েকদিন কলকাতার নানা জায়গায় দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরেফিরে এবং একদিন কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ মেরে কফি হাউসে কফি খেয়ে ফিরে এসেছিলাম কয়েকটি বই কিনে। কাইয়ুমই কিনেছিল অনেকগুলো। জিসি লাহার দোকান থেকে বেশ কিছু রং-তুলিও কেনা হয়েছিল, যার যার প্রয়োজন মতো। কিন্তু ললিতার আর কোনো কপি পাইনি। ওটাও এতদিনে বন্ধ হয়ে গেছে স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক সমস্যার কারণে। অবশ্য এর কিছুদিন পরই শুভ ঠাকুরের উদ্যোগে সুন্দরম বলে একটা ত্রৈমাসিক শিল্পসম্বন্ধীয় পত্রিকা বেরিয়েছিল, বেশ কয়েক বছর যা আমরা ঢাকা থেকেই সংগ্রহ করতে পারতাম। সেটা সম্ভবত পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে।

আমাদের কলকাতা সফর ছিল ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওইদিনই সবাই ঢাকায় ফিরে আসি ইনিস্টিটিউট খুলে যাওয়ার তাগিদে। ঢাকায় এসে শুনতে পেলাম, তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আমন্ত্রণে পূর্ববাংলা থেকে একাটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল পাকিস্তান সফরে আমন্ত্রিত হয়েছে। এই সফরে যাবে এখান থেকে একদল গায়ক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংস্কৃতিক সংসদের একটা নাটকের  দল এবং একটা চিত্র প্রদর্শনী। এই উদ্যোগে কলিম শরাফী ও সাদেক খানের যথেষ্ট অবদান ছিল। চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে আমার নাম ঠিক করা হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক দলের প্রধান হিসেবে যাবেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীন আহমদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকদলের প্রধান হয়ে যাবেন মিসেস কুলসুম হুদা। গায়ক-বাদকের মধ্যে ফেরদৌসী রহমান, নীনা হামিদ, আবদুল আলীম, ওস্তাদ খাদেম হোসেন প্রমুখ। উপনেতা হিসেবে যাবেন ফতেহ লোহানী এবং আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের দলে ছিল হেনরি, সালমা এবং আরো ১০-১২ জন। ওই দল পাকিস্তান সফর শেষে দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নাটক পরিবেশন শেষে দেশে ফিরবে।

বাংলাদেশ সময় ১৭১৫, জুলাই ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।